ইস্কুলগল্প (১)

কোনো পেশাই অন্য কোনো পেশার মতো নয়, সবই নিজের নিজের মতো। কিন্তু তাও, আমার যা পেশা সেটা একটু অদ্ভুত এইজন্য যে আমার কারবার পুরোটাই আগামী নিয়ে। এখন কণামাত্র ফল পাওয়া যাবে না জেনেও এদিকসেদিক থেকে নানারকম মশলাপাতি দিতে হয়, অনেকরকম জল খাওয়াতে হয়। ভবিষ্যতের গ্যারান্টি প্রায় কিছুই নেই এই কাজে। ম্যানহাটান প্রজেক্টে যেরকম বছর বছর হাজার হাজার ডলার খর্চা করেও কিছু আউটপুট বেরোত না – যা দেখে কিনা ট্রুম্যান খেপে গেছিল – এই কাজ সেইধরনের কাজ। 


ব্যাটম্যানের ‘ক্যাট্যাক্লিজম’ স্টোরিলাইনে একটা ছোট্ট এপিসোড ছিল। গথামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিংপিন অসওয়াল্ড কব্‌লপট, ওরফে পেঙ্গুইন, ধ্বসে-যাওয়া শহরে টহল দিতে বেরিয়েছে। ভূমিকম্পে শহরের অধিকাংশই পুরোপুরি ভেঙেচুরে তলিয়ে গেছে, ঘরবাড়ি টাল খেয়ে চুরমার হয়ে এর-তার ঘাড়ে পড়ে আছে, রাস্তাঘাট বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। ভাঙা শহরের ভাঙা রিসোর্স নিয়ে ভাঙাচোরা দমকল আর পুলিশবাহিনী যেকোনোক্রমে হোক মানুষজন উদ্ধার করছে, যতটুকু পারে। এখানে আগুন ধরে গেছে, ওখানে জলের পাইপ ফাটা, সেখানে রাস্তায় গর্ত, কে কোথায় আটকা পড়ে বেঁচে আছে না মরে গেছে, কেউ জানে না। — এই সময়ে একটা তিনপাতার মিনি এপিসোডে লেখক দেখাচ্ছেন পেঙ্গুইনকে। পেঙ্গুইন লাঠি টপ-টপ করতে করতে ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যেতে যেতে ডানপাশে একটা ভাঙা দেওয়াল চাপা পড়া লোক কাতরভাবে কোনোরকমে সাহায্য চাইছে। দয়া করো, আমাকে বাঁচাও, আমাকে বার করো। পেঙ্গুইন নির্বিকার হেঁটে চলে যেতে থাকে। লোকটা বলে ওঠে, যা চাও দেব, – কিন্তু আমাকে বার করো! পেঙ্গুইন এই কথা শুনে ফিরে আসে। জিজ্ঞেস করে, যা চাই দেবে? লোকটা প্রাণপণে হ্যাঁ বলে। পেঙ্গুইন জিজ্ঞেস করে, কী করো তুমি? লোকটা বলে, আমি একটা ল ফার্মে অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করি, প্লীজ আমাকে বার করো, আমার পা ভেঙে গেছে –

পেঙ্গুইন লোকটাকে বাঁচায়। বাঁচিয়ে এগিয়ে যায়। একটু এগিয়ে আরেকটা লোক। দেওয়াল-চাপা পড়েছে। সাহায্য চেয়ে চেঁচাতে থাকে। আমাকে বাঁচাও, যা চাও করব, যা চাও… পেঙ্গুইন ফিরে আসে। কী করো তুমি? লোকটা বলে, আমি স্কুলে পড়াই, প্লীজ, বাঁচাও –   …. পেঙ্গুইন পিছন ফেরে, লোকটাকে ফেলে রেখে চলে যায়। আবার কিছুক্ষণ এগিয়ে আবার একটা লোক। চিত হয়ে পড়ে আছে কয়েকটুকরো দেওয়ালের ওপর, পা দেখা যাচ্ছে না। কোনোমতে ডাক দেয়। প্লীজ বাঁচাও। যা বলবে করব, বাঁচাও। পেঙ্গুইন ফিরে আসে। জিজ্ঞেস করে, কী করো তুমি?

তিনপাতার কমিক্স এইখানে দি এন্ড।

আমার কাছে এই গল্পটার নীতিবাক্য এই ছিল যে ইস্কুলমাস্টারের আসলে সমাজে কোনো গুরুত্ব নেই। স্কুলমাস্টাররা দামে সস্তা এবং মূল্যে তুচ্ছ। তাদের কোনো সুদূরস্পর্শী প্রভাব বাস্তবপক্ষে থাকে না। যেসব কেসে থাকে সেগুলো ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। স্কুলমাস্টারের প্রভাব এতটাই ক্ষীণজীবী এবং আলগা যে তাকে কোনোভাবে ভবিষ্যতে কোনোরকম ম্যানিপুলেশনের কাজে একটা ছোট্ট ঘুঁটি হিসেবেও চেলে দেওয়া যাবে না। বাজারের এককোণে ছাঁটা তোতাপাখির মতো সে তার খাঁচায় বসে গান গায়, কেউ কিছু শুনতে পায় না।

এটা জানা থাকা সত্ত্বেও যে আমি এই চাকরিই করি, সেটার কারণ একটা বিশেষ প্রকারের নির্বুদ্ধিতা, যেটা নিজেকে আয়নায় হিরোইজম বলে চিহ্নিত করে। এর থেকে নিস্তার পাওয়া চাপ। আমি আজকাল চেষ্টাও করি না।

আমার মনে হয়, আমি একটা বিদ্রোহের মধ্যে আছি। উই…লিভ ইন আ সোসাইটি। এই সমাজের বেশীটাই মজে-ধসে যাওয়া, নোংরা, এবং বিষাক্ত। অপ্রাপ্তবয়স্করা একমাত্র গায়ে- এখনো-পর্যন্ত-যথেষ্ট-আঁচ-লাগেনি বলেই কিছুটা নির্মল এবং সপ্রাণ। এদের মধ্যে থেকে এই নোংরামি এবং বিষের বিরুদ্ধ-মন্ত্র আউড়ে যাওয়া এবং এদের মধ্যে তা ছড়িয়ে যাওয়াটা একরকম রেবেলিয়ন বলে আমার মনে হয়। রেবেলিয়ন সফল হল কিনা সে দিয়ে তার সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করা হয় না। একইরকমভাবে স্কুলমাস্টারের ছাত্ররা বড় হয়ে ওই মন্ত্রের ধারক ও বাহক রইল কিনা, সেটাও মাস্টারের সাফল্যের প্যারামিটার বলে গণ্য হতে পারে না। মাস্টারের সাফল্য তার কাজের মুহূর্তে সে কতটা এক থেকে অনেকে চারিয়ে যেতে পারছে, তার মধ্যে। এদিক থেকে তার সাথে গায়নরত শিল্পীর তুলনা করা যেতে পারে। 

এবং অবশ্যই, গায়কের সঙ্গে যে শ্রোতাকেও মনে মনে গাইতে হয়, – পড়ানোর বেলাতেও ছাত্রের তরফে সেই একই দায়িত্ব থেকে যায়, এটা যে কখনো কাউকে পড়িয়েছে সে-ই জানে।

আমার ক্লাসে প্রতিদিনই নানারকম গল্প তৈরী হয়। সেসব মাঝেমাঝে কাউকে কাউকে চ্যাটে বলি। আগে ফেসবুকেও লিখতাম কিন্তু এখন ফেসবুকে লেখা সময় নষ্ট বলে মনে হয়। কী হবে লিখে? কোনো কাজে তো লাগবে না আমার। যদি এমনটাও হত যে যারা পড়ছে তারা আমার পড়ানোর কাজে কোনোভাবে হাত লাগাল, তাহলে তাও লেখার মানে হত। খামোখা আমি লোকের এনটারটেনমেন্টের জন্য সময় নষ্ট করে লিখতে যাব কেন? সেই সময়টা যদি আমি নিজে কোনোকিছু দেখা বা পড়ার কাজে লাগাই তো আমার ক্লাসের ছানাদের জন্য কিছু ভালো খোরাক পাওয়া যাবে।

কিন্তু শারদ্বত বলছিল সেদিন, এই টুকরো ঘটনাগুলো লিখতে। ঘটনাগুলো তো উপভোগ্যই, মানে – যে এসব ভালোবাসে তার কাছে। চার-পাঁচ লাইনের ঘটনাও আছে, আবার দু’শো শব্দের কিসসাও আছে। লেখার উৎসাহের যা অভাব। প্রতিদিন ক্লাসে নতুন নতুন পড়াশোনার সুতো বেরোচ্ছে, আজ ফিল্ম তো কাল ফোটোসিন্থেসিস, পরশু আবার হয়তো জাতীয়তাবাদ। সৎভাবে এসবের গোড়ার সারজল দিতে গেলে নিজের প্রচুর পড়াশোনা করা চাই। সেসব করব না কুমড়োক্ষেতে কথকতা করব।

 গল্প শোনানোর একটাই জাস্টিফিকেশন হয়। সেটা এই যে গল্প ছাড়া মানুষের সম্পত্তি আসলে কিছু নেই। যা আছে তাও শুধু গল্প, আর শেষপর্যন্ত যা থেকে যাবে তাও ওই গল্পই। গল্প, আর সেই গল্পের চরিত্ররা। 


পেরেন্ট-টীচার মিটিং-এ এসে এক মা পরীক্ষার খাতা উল্টেপাল্টে দেখছিল। এনাকে আমি চিনি, ছেলেটা বইপড়ুয়া এবং ভালো লিখিয়েও বটে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে বাকিদের তুলনায় ওর লেখার সফিস্টিকেশনের মাত্রা অন্তত দু’দাগ হলেও বেশী। এরকম চারাপোনা ক্লাসে আর এক-দেড়টা আছে। ঠিক লেখার ট্যালেন্টের কথা হচ্ছে না – সেটা বেশ কয়েকটা বাচ্চার রীতিমতো বস্তাভর্তি মজুত দেখতে পাই, শুধু জিইয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ – আমি বলছি লেখার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক রঙ ধরার কথা। এর লেখা পড়লেই বোঝা যায়, প্রচুর বইপত্তর পড়ে, সেটা লেখায় চুঁইয়ে বেরোয়। এ-জিনিসটা এর ডিবেটিংএও দেখেছি। কথার মধ্যে কখনো কখনো এমন বাক্য বলে যার প্যাঁচ অনেকসময় গড় ক্লাসমেটের কানে ধরা পড়ে না, ফলে সেটা মার যায়।

আমার কাছে ফিডব্যাক চাইতে আমি লেখালিখিটা চালিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। শুনে মা বলে, – স্যার ওর তো বাড়িতে বইয়ের স্তূপ হয়ে আছে। যখনই কোথাও যায় খানকয় বই কিনে আনে। আর ডায়েরীতে লেখে। পরীক্ষার আগের দিনও লাস্ট মোমেন্টে ওই খাতা নিয়ে বসে লিখছিল, তো ওর বাবা এসে টেনে এক ইয়ে লাগিয়েছে। কিন্তু ও কথা শুনবে না, বলে ‘না না, এখন মাথায় এসেছে, এক্ষুণি লিখে না রাখলে পরে আর পাওয়া যাবে না!’

আমি এই বিবাদ-সংবাদ শুনে – যাকে বলে – যারপরনাই প্রীত হলাম। শালার তাল ঠিক আছে।


সিবিএসই নাইন-টেনের বাচ্চাদের জন্য সিক্সথ সাবজেক্ট চালু করেছে। ফিনানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট, ইনফরমেশন টেকনলজি, মিডিয়া, আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স – এই চারটের মধ্যে থেকে একটা নেওয়া যাবে, যদি কেউ নিতে চায়। এরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলতে কী করাতে চাইছে জানিনা। ছাত্রদেরও একই প্রশ্ন। সাবজেক্টের গালভরা নাম দেখে আজকাল কিছু আঁচ করা মুশকিল, – কী পড়ানো হবে, কীভাবে পড়ানো হবে, এবং সর্বোপরি কে বা কারা এটা পড়াবে, সেসব না জেনে বাছবে কী করে?

আমি আবার, সেশনের শুরুতে যেসময় এসব চালু হচ্ছিল, সেসময়টা “ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রীম অফ ইলেকট্রিক শীপ” পড়ছিলাম। সুতরাং আমি গোড়াতেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে বোর্ড আর স্কুল যা পারে করুক, আমি আমার মতো করে এদেরকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কয়েকটা কথা শোনাবই। স্বাভাবিকভাবেই আমি রোবট বানানো শেখাতে পারি না। কিন্তু এ.আই.-এর দার্শনিক দিকটার কথা খানিকটা বলতে পারি। আমি ক্লাসটীচার হবার দরুণ 9F-এর ছেলেমেয়েদেরকে ফাঁকা সময়ে মাঝেমাঝে পাই। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সকে ‘আর্টিফিশিয়াল’ তকমা দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, রোবটের অধিকার বলে কিছু থাকে কিনা, ভবিষ্যতের মানুষ হবে যারা তাদের সামনে এইসব প্রশ্ন এখন থেকে তোলা দরকার।

এসবের জন্য জমি তৈরী করা চাই। আমার দুটো সস্তা পেনড্রাইভ আছে, হুগিন আর মুনিন, তাতে করে আমি আমার কাচ্চাবাচ্চাদের বিবিধ মালমশলা দিই। ‘দ্য টার্মিনেটর’, ‘দ্য মেট্রিক্স’, ‘ব্লেড রানার’, – এইজাতীয় গোটা পাঁচ ছবি এদেরকে দিয়েছিলাম কপি করে রাখতে, অবসরমতো দেখবে এবং আস্তে আস্তে সেসব নিয়ে ক্লাসে কথা হবে। – এবার এই ছবিগুলো পেনড্রাইভে তোলার পরেও অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল, তাই তাতে আমি “পরে দেখিস” মর্মে আরো কয়েকটা ফিল্ম ভরে দিয়েছিলাম – ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’, ‘গুড উইল হান্টিং’, ‘ফাইন্ডিং ফরেস্টার’, এটসেটেরা। — গুদামে জায়গা থাকলে অস্ত্র মজুত করা অবশ্যকর্তব্য।

কাল টিফিনটাইমে দেখি ঋদ্ধি বলে একটা মেয়ে, যাকে ওর বন্ধুরা ‘পারফেকশনিস্ট’ বলে ডেকে থাকে, সে ‘স্যার’ বলে ডেকে আমাকে যেন কী বলছে। মেয়েটা কয়েকদিন আগে জানিয়েছিল যে ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ আর ‘গুড উইল হান্টিং’ দুটোই দেখে ফেলেছে। আমাকে জিগ্যেস করেছিল কেউ আমাকে কখনো ‘ও ক্যাপ্টেন মাই ক্যাপ্টেন’ বলেছে কিনা, আমি দাঁত বার করে উত্তর দিয়েছিলাম “হ্যাঁ ক্যাপ্টেন বলে কেউ কেউ ডাকে বটে, কিন্তু হেঁহেঁ সে অন্য ক্যাপ্টেন।” তা সে কাল বলে, “স্যার, আপনি যদি ওরকম কোনো ডেড পোয়েটস সোসাইটি চালু করতে চান। আপনি কি করবেন? মানে, যদি করেন, তাহলে আমি তাতে জয়েন করতে চাই।” এসব প্রশ্নে মুখে হাসি আর চোখে জল দুটোই একসাথে আসতে চায়। আমি সেসব বন্ধ রেখে বললাম যে দ্যাখ কীভাবে আর করব, এখানে সময় তো নেই, ওখানে ওরা যে হস্টেলে থাকত! তাইতে ঋদ্ধি বলে “হ্যাঁ কিন্তু হয়তো আমরা কয়েকজন ধরুন স্কুলের পরে খানিকক্ষণ থেকে গেলাম, তখন করা হল।” আমি বললাম না রে বাবু, স্কুলের পর তোরা বাড়ি যাওয়ার পরে টীচারদের অনেক আজেবাজে কাজ থাকে। সময় থাকে না রে বাবু।

“কিন্তু তোরা নিজেদের মধ্যে যোগ রাখবি, নিজেরা একটা এরকম কিছু বানাবি। স্কুল থেকে বেরোনোর পর। তখন আমি তাতে ঢুকব। তখন প্রচুর মজা হবে।”

“So, any advice?
Having a daughter. Any advice?”

“Oh…No, not really.

Just love them.
Just… yeah. I mean, they are who they are.”


আমার ক্লাসে একটা মেয়ে আছে তার মা নেই। মেয়েটার নাম এঞ্জেল।

আমি যখন ওকে ক্লাস সেভেনে পড়াতাম তখন দেখতাম স্কুল ছুটির পর ওর বাবা ওকে নিতে আসে। পরে কখন জানি একসময় একটুখানি আলাপ হয়েছিল। খুব ভালোমানুষ, খুব ভদ্র। মেয়েকে একা মানুষ করছেন। মানুষ তো সব বাপ-মা করে না। শুধু বড় করে।

সেই মেয়ে এবছর আমারই ক্লাসে। আদ্ধেক সেশন তো পেরিয়েই গেল, এর মধ্যে মেয়ে এবং বাবা, দু’জনের সঙ্গেই আলাপ আরেকটু গভীর হয়েছে। বাপের সঙ্গে একটু, মেয়ের সঙ্গে অনেকখানি। এটা বুঝি যে বাবা মেয়েকে মরা মায়ের অভাব একটুও টের পেতে দেয় না। কিন্তু আরো দামী হল এই যে মা নেই, কিন্তু মা যে ছিল, এই কথাটা মেয়ের মন থেকে মুছে যেতে দেননি উনি। ক্লাসে এঞ্জেল একদিন কী জানি কথার মধ্যে বলেছিল কীভাবে ওর মা আর ওর বাবার প্রথম দেখা হয়। বলতে গিয়ে চোখটা একটুখানি চকচক করেছিল, আমি সেটা দূর থেকেও খেয়াল করেছিলাম।

এঞ্জেল পড়াশোনায় ভালো, স্পোর্টসেও। এই যে আমি পুণায় বসে এই গল্প লিখছি, এঞ্জেল কিন্তু আজ দু’দিন ক্লাস আসেনি। সে গেছে কলকাতা, ন্যাশনাল লেভেলের একটা ম্যাচ খেলতে। আমি জানতাম না, ওর বন্ধুরা আজ বলল। – এই কিছুদিন আগে, অগাস্টে, ওর আর একটা টেনিস কম্পিটিশন ছিল, ওই ন্যাশনাল লেভেলেরই। ওর নাম উঠেছিল তাতে, কিন্তু ও যায়নি। কেন যায়নি? না ওইসময়টা আমাদের সেকশনের স্পেশাল অ্যাসেম্বলি ছিল, তাতে ওদের স্বাধীনতা দিবসের নাটক ছিল, সেই নাটকে ওর একটা রোল ছিল। সেটা ডিচ্ করতে চায় না বলে চুপচাপ কাউকে না জানিয়ে খেলা থেকে নাম কাটিয়ে দেয়। আমি জানতে পেরেছিলাম পরে, ওর এক বান্ধবীর কাছে। তাও কীভাবে জানলাম সে আরেক গল্প। থাকগে। সেই নাটক লাস্টে কী হয়েছিল, সেইটা বরং জানিয়ে রাখি। দু’দিন আগে স্কুল জানাল অডিটোরিয়াম দিতে পারবে না। অন্য মিটিং হবে ওখানে। একটা ফাঁকা বারান্দা মতো জায়গায় একটা মঞ্চ বরাদ্দ করে দিল, কিছু বক্স স্পীকার থাকবে, লাইট-ফাইটের তো প্রশ্নই নেই। সেখানে সেই নাটক করা হল।

প্রচুর পরিশ্রম করে অনেকরকম যোগাড়যন্ত্র করেছিল ছেলেমেয়েগুলো। ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য স্লাইড বানিয়েছিল, ফৈজের কবিতা দিয়ে ডিজাইন করে নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়েছিল। শেষে পুরো জিনিসটা এইভাবে নষ্ট করা হবে জানলে আমি জোর করেই মেয়েটাকে ওর ম্যাচ খেলতে পাঠিয়ে দিতাম।


 পরশু বিকেলবেলা। বাসের জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, চারটে পঁচিশ বাসের টাইম। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলা পেলাম, ‘স্যার..?’ – ঘুরে দেখি, ভীষণ চেনা মুখ।

স্কুলে প্রতি বছর একটা মোটিভেশনাল ক্যাম্প হয় ছেলেমেয়েদের। এটার কথা আমি জানতে পেরেছিলাম যেবছর ঢুকি সেবারই। গোকানি বলে এক শুভ্রকেশ ডাক্তার আসেন মুম্বই থেকে এই ক্যাম্প করাতে। তিনি আসার আগে আসে তাঁর ইমেল, তাতে লেখা থাকে যে তিনি মহাত্মা গান্ধীর গ্রেট গ্র্যান্ডসান, ডাক্তারি এবং স্টুডেন্টদের ক্যাম্প কনডাক্ট করানোর মধ্যে দিয়ে সমাজের সেবায় রত। এই ক্যাম্প সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয় যদিও, যারা যারা চায় তারা রেজিস্ট্রেশন করাবে। ফি-এর অঙ্ক বেশ মোটা, গোকানিবাবু ডাক্তারি করে বেশী কামান নাকি ক্যাম্প করিয়ে, বলা মুশকিল।

এই ক্যাম্পে আমি ছাত্রদের সঙ্গে গিয়েছিলাম দু’বছর আগে। গিয়ে যা দেখেছিলাম তাতে ভক্তি হয়নি, ভরসাও হয়নি। ওর চেয়ে ভালো ইয়ে আমরা করাতে পারি। শেষে এমন দাঁড়িয়েছিল যে গোকানিবাবু মাইক হাতে ছেলেমেয়েদের যা শোনাচ্ছেন, আমি পরে সুযোগমতো গলা নামিয়ে কথা বলে সেই ধোঁয়াশা ধোয়াচ্ছি। যাকগে সে ব্যাপার।

সেই সেবারে আমার সাথে যেসব ছেলেমেয়েরা গিয়েছিল, তারা ছিল তখনকার নাইন-টেন। তাদের আমি পড়াই না। আমি তখন পড়াই সিক্স-সেভেন, ওদের সাথে আলাপ নেই। সেই ক্যাম্পে গিয়েই প্রথম আলাপ। যারা নাইনে ছিল তাদের পরের বছর আমি টেনের ছাত্র হিসেবে ক্লাসে পেয়েছিলাম, যারা টেনে ছিল তাদের পরে আর কখনো পাইনি। এই তিনদিনের-আলাপীদের মধ্যেই একজন ছিল গায়ত্রী মহাজন।
গায়ত্রী মহাজন হল সেইরকম মেয়ে যাকে করিডোরে দেখলে মুখ মনে থাকে। আমি ক্যাম্পে আলাপ হওয়ার পর আরেকটা কথা জানতে পারলাম। মেয়েটা গান শেখে, ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। – একটা জিনিস পুণায় এসে অবধি খুব দেখছি, এখানে ছেলেমেয়েরা অনেকে ক্লাসিকাল শেখে। বাঙালীরা এতটা শেখে কি? মনে হয়নি কখনো। সেটা যে খারাপ সেকথা বলছি না, হয়তো বাংলার নিজের গানের ভাণ্ডার এত সমৃদ্ধ বলেই ধ্রুপদী অবধি আমাদের নজর পৌঁছয় না, কিন্তু পৌঁছলে হয়তো ভালোই হত। – তা গায়ত্রীদের গ্রুপটার সঙ্গে গানবাজনা নিয়ে কথা হচ্ছে, আমি তখন সদ্য ফরিদ আয়াজকে আবিষ্কার করেছি, সেইসব বলছি, এরম সময়ে অবধারিতভাবে উঠল ভীমসেন যোশীর কথা। গায়ত্রী বলল, “আমার এক পিসেমশাই ভীমসেন যোশীর সঙ্গে বাজাতেন।”

আমার তো শুনে কথা বন্ধ! এশালা বলে কী!

 আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কিছুই জানি না, বুঝিও না। কিন্তু ভীমসেন যোশীর আমি ফ্যান হয়ে গেছিলাম ওঁর বলা একটা লাইন পড়ে। ভদ্রলোক বলেছিলেন, – প্রতি দশ বছর অন্তর গান জিনিসটা রঙ-রূপ বদলায়; প্রত্যেক সঙ্গীতসাধকের এটা মনে রাখা উচিত। ক্লাস ইলেভেনে থাকতে শক্তিদার একটা ক্যাসেটের খাপে ছাপা এই লাইনটা পড়ে আমি জাস্ট খেয়ে গেছিলাম।

 এই মেয়ের পিসেমশাই ভীমসেন যোশীর সঙ্গে বাজাতেন? – এবং এ নিজেও নাকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখে। – এসব সিচুয়েশনে আমার অটোমেটিক একটা গ্রীনরুমে-দাঁড়িয়ে-আছি মার্কা ফিলিং হয়। একদমই একান্তে অবশ্য। বাইরের দুনিয়ায় সেলিব্রিটিদের সাথে কক্ষনো দূরত্ব কমাতে নেই। ক্ষতি হয় তাতে।

গায়ত্রীকে চিনে রেখেছিলাম সেই থেকে। পরে কোলীগদের ভাবেসাবে বুঝেছিলাম, সে মোটামুটি ব্যাচের একজন প্রমিনেন্ট মুখ। 

কতটা প্রমিনেন্ট, সেটা বোঝা গেল গত বছর। সেটা বলার আগে একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার।
গায়ত্রীর এক বোন আছে, সিদ্ধি। এই সিদ্ধিকে আমি ওই দু’বছর আগে থেকেই চিনি, তখন ওর ক্লাস সেভেন। আলাপ হবার পর সিদ্ধিও বলেছিল যে ও-ও ক্লাসিকাল শেখে। আমি শুনে হেবি খুশী হয়েছিলাম। এখন সেই সিদ্ধি ক্লাস নাইনে উঠেছে, এবং হেঁহেঁ, আমারই সেকশনে ঠাঁই পেইছে। এবার, এই গায়ত্রী আর সিদ্ধি দু’বোনেরই যা চেহারা সেটাকে বলা যায় ফর্মুলায়িক সুন্দরী, এবং সেইসঙ্গে খুব ফরসা। মানে, যদি ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নাটক করতে হয়, তাহলে খুব পরিষ্কারভাবে সরস্বতীর রোল এদের কাছে যায়। 

গতবছর দেখি, স্কুলের বড় বড় হোর্ডিং ছাপানো হয়েছে, পথেঘাটে রাস্তার মোড়ে স্কুলের সামনের বোর্ডে লাগানো হবে বলে। নামী স্কুলের টিপিক্যাল বিজ্ঞাপনী বোর্ডিং যেরকম হয়, সাফল্যের হাসি-মাখানো স্টুডেন্ট, সামনে খানকতক বই, হাতে কলম বা ওইরকম কিছু। – আমাদের স্কুলের হোর্ডিং ছাপা হয়েছে, তাতে স্কুলের নাম, আর একটা ক্লাসরুমের ছবি, একজন ছাত্রের ক্লোজ-আপ। পড়তে পড়তে মুখ তুলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছে, হাসি। ছাত্রটি আর কেউ নয়, গায়ত্রী মহাজন।

আমি অবাক হইনি, কিন্তু খুব বিটকেল হাসি পেয়েছিল। হাসিটা পেয়েছিল স্কুলের কাণ্ড দেখে। বাসে যেতে যেতে কোনো পকেটমারকে অতি সন্তর্পণে অন্যের পকেট মারতে দেখে ফেললে যেমন বিচ্ছুমার্কা হাসি পেতে পারে, সেইরকম। বেচারি গায়ত্রী তো পাশ করে বেরিয়ে গেছে, জানেও না যে স্কুলের ক্যামেরাওয়ালা কোন তালে ফোটো তুলেছিল, আরো দশটা ফোটোর সঙ্গে, স্কুলের মার্কেটিং-এর হেড সেই ফোটো থেকে বেছে বেছে উপযুক্ত চাঁদবদন সিলেক্ট করে পোস্টারে সেঁটে দিয়েছে। 

পরদিন সিদ্ধিকে বললাম, “নীচে দেখেছিস? তোর দিদির জায়েন্ট সাইজ থোবড়া বসিয়েছে?” সিদ্ধি ভীষণ জেনুইন চাপের সাথে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, খুব ভয়ানক!” আমার আবার হাসি পেল, মনে মনে বললাম, “সে তোর মনে হচ্ছে।”

তারপর পরশু বিকেলবেলা। 

বাসের জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, চারটে পঁচিশ বাসের টাইম। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলা পেলাম, ‘স্যার..?’ – ঘুরে দেখি, ভীষণ চেনা মুখ। গায়ত্রী। আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসেছে। …কিন্তু এটা কেমন গায়ত্রী? সেই মুখ তো একই আছে, কিন্তু চুল ছোটো হয়ে গেল কী করে? আসল গায়ত্রীকে দেড় বছর দেখিনি, শুধু প্রতিদিন হোর্ডিংগুলো চোখে পড়ে। আসলজন এর মধ্যে কখন চুলের স্টাইল বদলে ফেলেছে।

অল্প কথা হল, বলল ডাক্তারির জন্য রেডি হচ্ছে। ফিজিওথেরাপিস্ট হবে। গানের কথাটা কেন জানি না ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করলাম না। কেন জানি না মনে হল, উত্তর যা পাব তা মনঃপূত হবে না। তার চেয়ে থাক না-জানা।

 ও বাসে উঠে পড়ল, আমারও বাস এসে গেল কিছুক্ষণ পর। সব হয়ে যাবার অনেকক্ষণ কেটে গেছে, হঠাৎ একটা জিনিস রিয়্যালাইজ করলাম, আর রিয়্যালাইজ করার পর থেকে এখনো লিখতে লিখতে হেসে যাচ্ছি। বেটি চুল না ছেঁটে পারে? সারা পাড়া যে লম্বাচুলওয়ালা চেহারার ছবিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে!!! 


আজকে শনিবার, অলটারনেট শনিবার ছুটি থাকে, আজকে ছুটি থাকার কথা ছিল। কিন্তু থাকেনি।

স্কুলের নাম পাল্টেছে সদ্য। যে কম্পানীর স্কুল ছিল, তারা বলেছে আমরা নাম তুলে নিচ্ছি। তাই স্কুল উপায়ান্তর না দেখে নিজেকে রিব্র্যান্ড করেছে। নতুন নাম। বিশেষ কেউ জানে না এই নাম এখনো। তাই প্রোমোর চোট বাকি সারাবছর যা চলে তার চেয়ে বেশী ভারী।

তা এই দেয়ালীর ছুটির পরেই স্কুল খুলল, খুলেই ঘোষণা যে স্পোর্টস ফেস্ট হবে। কেউ জানত না। হঠাৎ করে কোন্ কম্পানী এসে অফার করেছে কোলাবরেট করার, ব্যাস আর পায় কে। হবে ফেস্ট।

গত এক সপ্তাহ এই নিয়ে তোলপাড় চলেছে স্কুলে। ফেস্টুন, ব্যানার, টীচাররা দৌড়োচ্ছে, টীম বানানো, সে এলাহি কনফিউশন।

এবং সেই সাথে ঘোষণা, শনিবার-রবিবার স্কুল চালু থাকবে। সবাই আসবে। কারণ ফেস্ট চলবে ৯ থেকে ১৫। এই ঘোষণায় অ্যাড করা ছিল যে এর কোনো নড়চড় হবে না। স্কুল চালু থাকবে বলেছে যখন, তখন থাকবেই।

তা আজকে তাই সবাই স্কুলে এসেছে। আমার বরাবর এরকম একগুঁয়েপনা দেখলে ভীষণ হাসি পায়। কারণ আমি ‘জুরাসিক পার্ক’ পড়া ছেলে। আমি জানি, আনপ্রেডিক্টিবিলিটি কোথা দিয়ে ঢোকে। এসব লখীন্দরের ঘর বহুৎ দেখা আছে।

আজকে সবাই এসেছে স্কুলে, ক্লাসটাস ঢিলে, কারণ স্বাভাবিকভাবেই আদ্ধেক বাচ্চা কাট মেরেছে। আমি চান্স পেয়ে আমার ক্লাস, মানে নাইন এফ, যার আটত্রিশজন বাচ্চার মধ্যে সতেরোজন এসেছে, – তাদের কিছু জিনিসপত্র দেখাবো বলে বসালাম। বাকি টীচারদের বলে একটা ব্যবস্থা করলাম যাতে আমাকেই পিরিয়ডের পর পিরিয়ড কন্টিনিউ করতে দেওয়া হয়।

দু’জন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করাবো ইচ্ছা ছিল। একজন ডঃ গ্রেগ হাউস। আরেকজন ক্যাপ্টেন ম্যালকম রেনল্ডস। দুটো সিরিয়ালের পাইলট এপিসোড দেখানোর প্ল্যান। “হাউস এম.ডি.” আর “ফায়ারফ্লাই”।

হাউসের পাইলট দেখে সবাই মোটামুটি হাইলি অ্যামেজড, ফায়ারফ্লাইয়ের পাইলটটা মাঝামাঝি অব্দি পৌঁছেছে, এমন সময় হঠাৎ বাইরে গোলমাল। সব টীচারদের বারান্দায় একজায়গায় জড়ো হতে বলা হচ্ছে। – ক্লাসে ল্যাপি চলতে থাকুক, বাচ্চারা অপারেট করে নেবে, – আমি গেলাম কেন ডাকে দেখতে।

প্রিন্সিপাল সবাইকে জড়ো করে বলল, সাড়ে দশটায় স্কুল ছুটি দিতে হবে, কমিশনারের অর্ডার জারী হয়েছে। অযোধ্যা ভারডিক্টের জন্য রাস্তাঘাটে দাঙ্গার আশঙ্কা, সবাইকে যেন বাড়ি পাঠানো হয়।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম টাইম দশটা দশ।

আমাদের বলা হল যেসব বাচ্চা বাসে যাবে তাদের আলাদা করতে, আর যাদের পেরেন্টপিকআপ, মানে বাড়ি থেকে লোক আসে নিতে, তাদের বাড়িতে ফোন করে জানাতে। এক্ষুণি আসতে হবে। তা আমি ক্লাসে গিয়ে ব্যাপার বললাম। যদিও “বাচ্চাদের বোলো না, প্যানিক হবে” বলা হয়েছিল। কিন্তু আমার এরা এসবে অভ্যস্ত। গিয়ে বললাম কেস। পেরেন্ট পিকআপ তিনজন। বৈদেহী, নন্দিনী, আর এঞ্জেল।

এঞ্জেলের বাবা আসতে পারবে না, ওর পিসির আসার কথা ছিল ওকে নিতে। কিন্তু আমার ফোন থেকে চেষ্টা করে দেখা গেল, পিসি কোনো কারণে ফোন তুলছে না। এদিকে সময় বেরিয়ে যাচ্ছে।

আমি একজন টীচারের সঙ্গে কথা বললাম। উনি বললেন উনি ওই একই রাস্তা দিয়েই যাবেন, এঞ্জেলকে উনি ড্রপ করে দেবেন। — এদিকে ততক্ষণে বৈদেহী ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিয়েছে যে ওর মা এঞ্জেলকেও সঙ্গে নিয়ে নেবেন। ঠিক আছে, এদিকটা মোটামুটি মিটে গেল।

এদিকে সব বাচ্চাদের লাইন দিইয়ে নীচে পাঠানো হচ্ছে। যারা বাসে যাবে তারা। পেরেন্টপিকআপ আর ভ্যানের বাচ্চারা কিছুক্ষণ ক্লাসে বসছে, পরে নামবে। আমি ওদের সাথে খানিকক্ষণ ছিলাম ক্লাসরুমে। প্ল্যান করছিলাম, কী করব। মানে, ওদেরকেও বোঝাচ্ছিলাম।

“যদি দাঙ্গা লাগে, আর ঘরে বন্দী থাকি। প্রভিশনস কতদূর আছে। ছ’টা আলু আছে, দেড় কেজি মতো পেঁয়াজ। চাল আছে, ডাল আছে। নুন তেল – আছে। চিনি, – আছে। চা, আছে। — মানে হপ্তাখানেক কেটে যাবে। তারপর যদি আরও চলে, দেন আই স্টার্ট শুটিং ডগস অন দ্য স্ট্রীট।”

“ওদের মাংসে চলবে কিছুদিন। ইলেকট্রিসিটি, – আছে। তেল, – তেল তো আছেই। ব্যাস।”

“বাট দেন এগেইন, কুকুর ধরার চেয়ে মানুষ ধরা সহজ, নহে কি, বালকবালিকাগণ?”

সবাই বলল, হ্যাঁ, কথা সত্য বটে।

“সো দেন আই থিংক আই উইল গো ফর মেন, ইউ নো।”

“কাউকে ডেকে ধর বললাম। দাদা, একটু সুইচবোর্ডটা দেখুন না। চলছে না। এই এইদিকে, একটু দেখুন তো কী। – আর যেই দেখতে যাবে, অমনি পেছন থেকে গলায় কচাৎ। তারপর ফ্রিজ। একমাসের মতো খাবার।”

সবাই জানাল, সাউন্ডস লাইক আ প্ল্যান।

আমাকে বেরোতে হত জলদি। কারণ আমিও বাসেই ফিরি। আমি বললাম, আমি যদি না ফিরি, মানে আমি যদি দাঙ্গায় মরে যাই, তাহলে সোমবার, বা যেদিন ধর আবার স্কুল বসবে, সেদিন তো আমার জন্য বোধহয় একমিনিট শোকপালন-টালন হবে, সেদিন এক কাজ করবি
একটা গান বাজাবি। আমি বলে দিচ্ছি কোন গান। Offenbach-এর Infernal Galop, ইউটিউবে পেয়ে যাবি, সেইটা বাজাবি। পুরোটা বাজাবি, হাফ না।

তারপর গুডবাই বলে বেরিয়ে এসে বাসে চড়ে বাড়ি ফিরে এলাম।



যখন “ফায়ারফ্লাই”-এর পাইলট এপিসোড চলছে, তখন নন্দিনী একবার বাইরে গেছিল। ওরা মাঝেমাঝে এক একজন দরকারমতো গিয়ে বাথরুম-টাথরুম করে আসে, বাকিরা যা চলছে দেখতে থাকে, ডিস্টার্ব্যান্স হয় না, – এটাই মোটামুটি সিস্টেম। তো, কিছুক্ষণ পরে দেখি দরজার কাছে নন্দিনী, কিন্তু ঢুকছে না, আমাকে বাইরে ডাকছে। আরেকটা কেউ একজন ওপাশে আছে, দেখা করতে চায়।

গিয়ে দেখি মান্যা দাঁড়িয়ে আছে। মান্যা আমার ক্লাসের মেয়ে নয়, কিন্তু দু’বছর আগে যখন ও ক্লাস সেভেনে পড়ত তখন আমি ওর ক্লাসটীচার ছিলাম। সেবছরই নতুন-ভর্তি-হওয়া ছাত্র ছিল মান্যা, হিন্দীতে ভালো ছিল, ডান্স কম্পিটিশনে প্রাইজ পেত, মনিটর ছিল। নন্দিনীর সঙ্গে বন্ধুত্বটার পেছনে সম্ভবত আমারই হাত আছে, কিন্তু সেটা অন্য গল্প। আপাতত মান্যা দু’বছর হল আমার ক্লাসে নেই, দেখাসাক্ষাৎ হয় – এইপর্যন্ত। এই দেখা হওয়া ছাড়া টুকটাক খবর পাই, এদিক ওদিক থেকে। দূর থেকে গতিবিধিও চোখে পড়ে। গত দেড় বছরে মান্যা অনেকটা পাল্টেছে। 

এই পাল্টানোর ব্যাপারটা বোঝা কঠিন, বোঝানো আরও কঠিন। কিন্তু না বুঝলে বাকি গল্পটা পড়ে লাভ নেই।

 এরা যখন এইটে, তখনই আমি জানতাম যে মান্যার নাম টীচারদের গুডবুকে আর নেই। বরং সন্দেহ এবং শাসনের চোখে দেখা হয়। মাঝখানে একটা সময় গেছিল যখন ওর সাথে স্কুলের কাউন্সেলরের কয়েকটা মিটিং হয়েছিল (এই খবরটা আমি কাউন্সেলরের থেকেই পাই)। মিটিংএ একটা প্রসঙ্গ নাকি ছিল ওর বাড়ির পরিস্থিতি। ওর টুয়েলভে-পড়া দাদা নাকি নেশা করছিল। বাড়িতে অশান্তি। ইত্যাদি, ইত্যাদি। মান্যার ওপর এর দাগ পড়ছিল।

অন্যরকম দাগও পড়ছিল, সেটা আরো জটিল। এখানে কয়েকটা অস্বস্তিকর জিনিসকে একটু পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া দরকার। স্কুল বলে আরোই অস্বস্তিকর, কিন্তু রক্ত না ছুঁয়ে সার্জারি করা যায় না। 

 এটা শারীরিক বাড়ের বয়স। এইটের সময় থেকেই মোটামুটি মান্যার হাইট সাড়ে পাঁচফুটের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মানে ‘বাচ্চা’ সাইজ নয়, ‘লোক’ সাইজ। এবং জীনগত কারণেই হোক বা নিয়মিত অভ্যাস-করা (এবং প্রাইজ-পাওয়া) ডান্সার হবার দরুণই হোক, মান্যার শারীরিক গড়নও সেই হারে বাড়ে। এবং সেই সাথে জড়ায় ইউনিফর্মের জটিলতা।

মেয়েদের স্কুল ইউনিফর্ম একটা অদ্ভুত রেলিক। আমাদের স্কুলে যেমন, আমি মাঝেমাঝেই দেখেছি টীচাররা (যাদের ৯০% মহিলা) কোনো মেয়েকে একপাশে ডেকে চাপা স্বরে ধমকাচ্ছে, স্কার্টের ঝুল যথেষ্ট লম্বা নয় বলে। এটা একটা স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম। স্কার্ট লম্বা হতে হবে, হাঁটুর নীচ অবধি। তার চেয়ে ছোটো হওয়াটা ঠিক বাঞ্ছনীয় নয়। এই নিয়ম, বলাই বাহুল্য, প্রায় কেউই মানে না। স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের স্কার্ট পরেই বেশীরভাগ মেয়েরা স্কুলে আসে। কোনো সমস্যাও হয় না। 

এবার, আবারও স্বাভাবিকভাবেই, কোনো কোনো মেয়ের স্কার্ট স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের চেয়ে জাস্ট এক চিলতে ছোট হয়। কখনো পিওরলি বাই হ্যাপেনস্টান্স। এবং কখনো ইচ্ছা করেই – বাই ডিজাইন। বাই ডিজাইন হওয়াটা খুব, খুব স্বাভাবিক। সবাই বোঝে।

এইটের সময় থেকেই টীচারদের চোখে মান্যার রেপুটেশন দাঁড়িয়েছিল – মেয়েটা বড্ড ছোটো স্কার্ট পরে স্কুলে আসে।

আমি নিজে এই অভিযোগ শুনেছি, আমার কোলীগ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকেই শুনিয়েছে। অভিযোগ খুব একটা কিছু অন্যায়ও নয়, পেরেন্ট-টীচার মিটিং-এর দিন দেখা গেল মায়ের সঙ্গে মান্যা এসেছে, পরনে ছোটো হটপ্যান্টস। সঙ্গে মা আছে, কাজেই এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই যে বাবা-মাকে কমপ্লেন করে কোনো লাভ হবে। কয়েক মাস পরের পি-টি-এমে আরো বিপদ। মান্যা আসেনি, শুধু মা এসেছে, এবার মায়ের নিজেরই পরনে হাফপ্যান্ট।

 এমতাবস্থায় মান্যাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষাদুষির কথা হচ্ছেও না। কথাটা হল এই যে স্কুলের টীচাররা ভাবে, মান্যা একটা বখা মেয়ে।

মান্যার সঙ্গে আমার ইদানীং অল্পস্বল্প চ্যাট হয়, তাই আমি আরেকটা খবর জানি। আজকাল মান্যার বাড়ির লোকও ভাবে, মান্যা একটা বখা মেয়ে। পড়াশোনা করে না, ঘর গুছিয়ে রাখে না। স্কুলে এসে টীচারদের কাছে বাপ-মা সেই কথা জানায়, আর টীচাররাও হাঁ-হাঁ করে ওঠে, হ্যাঁ তো, মান্যা তো একদম কেমন যেন একটা হয়ে গেছে, একদম ভালো না।

মান্যার নিজের নিজেকে বখা মেয়ে মনে হয় না। রেজাল্টও যা শুনি, খারাপ নয়। টপার না হতে পারে, কিন্তু খারাপ নয়।

কিন্তু মান্যার চারপাশে সবার মনে হয় যে ও একটা বখা মেয়ে।

কয়েকমাস আগে একটা পিটিএম হয়েছিল। আমি মান্যাকে বলেছিলাম, তোর ওদিকে কাজ হয়ে গেলে বাবা-মাকে নিয়ে একবার আমার সঙ্গে দেখা করে যাস। দেখা করলে পরে বলেছিলাম তুই একটা ব্লগ খোল। তুই ভালো নাচিস, ট্রেক করিস, সাঁতার কাটিস। এবং সেইসাথে লিখিস খারাপ না। একটা ব্লগ খোল। তাতে এইসব নিয়ে যা পারিস লেখ। আস্তে আস্তে বাড়ুক। পরে কাজে দেবে।

সেদিনও দেখেছিলাম, মান্যার চোখমুখ অন্ধকার। বোঝাই যাচ্ছে পিটিএমে শিক্ষকে-অভিভাবকে কী ইন্টারঅ্যাকশন হয়েছে।

পরে একদিন, পরশুদিনই ইনফ্যাক্ট, মান্যা আর নন্দিনী একসাথে ছিল, ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম কেন ব্লগ বানাতে বলছি। আমি কিছু সাইকলজিস্ট নই, স্পেশালিস্টও নই, কিন্তু মনে হয়েছিল এই মেয়ে চাকরিজীবনে বসকে খুশী করতে পারবে না। সুতরাং যদি নিজস্ব কিছু একটা থাকে, হয়তো উপকার হবে। সেইজন্য বলেছিলাম ব্লগ বানাতে।

আজকে নন্দিনী ডাকল, বাইরে গিয়ে দেখি, মান্যা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফোলা, লাল। কথা বলার জন্য মুখ খুললেই কাঁদবে। কাঁদবেই।

 তখন বাইরে ব্রেক চলছিল। আমি বললাম, নন্দিনী তুই এখন মান্যার সঙ্গে কথা বল, এখন চারদিকে সবাই ঘুরছে, এখন ওকে মুখ খোলাস না। সবাই দেখবে। ব্রেক হয়ে গেলে ওকে আন আমার কাছে। — নন্দিনী ওকে নিয়ে চলে গেল। আমি ক্লাসরুমে ফিরলাম। — তার পাঁচ মিনিট পরে আমার ডাক পড়ল বাইরে, প্রিন্সিপালের স্কুল-ছুটির মিটিংএ।

সবাই স্কুল ভাঙার গোলমালে ব্যস্ত, নন্দিনী আমাকে বলল, স্যার মান্যার ব্যাপারটা। আমি বললাম, শিগগির ডেকে নিয়ে আয়। 

 নন্দিনী ওকে ডেকে এনে নিজে ক্লাসে ঢুকে গেল। করিডোরে শুধু আমি আর মান্যা, ওপাশে আরেকটা ক্লাস, কয়েকটা ছাত্র জানলা দিয়ে এদিকে তাকাচ্ছে। আমি মান্যাকে ঘুরিয়ে দিলাম যাতে জানলার দিকে পিঠ হয়। অনেকক্ষণ ধরে চেপে ছিল, এইবার কান্নাটা ভাঙল। মিনিটখানেক লাগল, কাঁদা থামতে।

‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করে তো উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রথমে বলল স্কুলের কিছু না। তারপর বলল বাড়ির ব্যাপার। তারপর কান্নাটা একটু কমলে শুনলাম ঘটনা। একটা প্রজেক্ট হোমটাস্ক ছিল। সেই খাতা পুরো কমপ্লিট হয়নি। সেটা দেখে কাল রাতে বাবার নাকি খুব মাথা গরম হয়েছে। তাই বাবা আসছে স্কুলে, টীচারদের সঙ্গে কথা বলতে। 

মুখে বলা যায় না এরকম কিছু হয়েছে কিনা, সেটা এনিবডিজ গেস। আমি বললাম, আজকে স্কুল ছুটি হয়ে যাচ্ছে, তোর বাবা আজ আসবে না। মান্যা বলল, স্যার, বাবা অলরেডি আসছে, স্কুলের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিয়েছে। রাস্তায় আছে। আমি বললাম, রাস্তা থেকেই ফিরে যাবে। কমিশনারের অর্ডার এসেছে। কেউ থাকবে না স্কুলে। ওটা নিয়ে ভাবিস না, আজকে অন্তত কিছু হচ্ছে না।

এর পর আমি যে কথাগুলো বললাম সেগুলো নিয়ে বেশীরভাগ লোকেই হয়তো সহমত হবে না। তাতে আমার কিছু আসে-যায় না।

বললাম, তোর বাবাকে আমি চেঞ্জ করতে পারি না। ওটা হাতের বাইরে। 

আমি যেটা করতে পারি। সেটা হল তোকে হেল্প করা, যাতে তুই নিজেকে চেঞ্জ করতে পারিস।

চেঞ্জ বলতে ‘বখা-মেয়ে’ থেকে বদলে ‘ভালো-মেয়ে’ হওয়া বলছি না। তোকে এখন খুব শক্ত হতে হবে। স্ট্রং হওয়ার কথা বলছি।

তোর খাওয়াদাওয়ার খরচ দেয় তোর বাবামা, তোর জামাকাপড়, পড়াশোনার খরচও দেয় তোর বাবামা। থাকিস বাবামায়ের বাড়িতে। এখনও আরও ছয়, সাত বছর অন্তত, তা-ই থাকবি। সুতরাং, যতদিন পরের পয়সায় খাচ্ছিস, ততদিন স্রেফ মুখ বুজে সয়ে যা।

যা বলবে, যে যা করবে, জাস্ট গিলে যা। গিলে যেতে থাক, আর পাথরের মতো ভেতরে রেখে দে। গাল দেবে, অপমান করবে। করতে দে।

বললাম, আমি খুব কাছ থেকে কয়েকজনকে দেখেছি। ‘ইউ আর লাকি দ্যাট ইউ আর নট গোয়িং থ্রু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ অ্যাজ ওয়েল।’ মনে মনে বললাম, ‘অ্যাট লিস্ট দ্যাটস হোয়াট আই হোপ।’

 যা করছে করতে দে। তুই এই পয়সায় খা। এই পয়সায় পড়। আস্তে আস্তে বড় হ। তারপর যেদিন ডিগ্রীটা হাতে পাবি, জাস্ট ওয়াক আউট।

করিডোরে ভিড় জমছিল। মান্যাকেও নিজের ক্লাসে ফিরে ব্যাগ গোছাতে হত। আমি ওকে ক্লাসে পাঠিয়ে দিলাম। বাড়ি ফিরে একটা সংক্ষিপ্ত চ্যাটে ডায়ালগটা শেষ হল, এইমাত্র আধঘন্টা আগে।

বললাম, “গেট দ্য ডিগ্রী, অ্যান্ড টিল দেন, ইউজ দ্য টাইম টু লার্ন হোয়াটএভার ইউ ক্যান, বিকজ ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু পে ফর ইট ইওরসেল্ফ। নাহলে পরে তোকে পড়াশোনা আর চাকরি একসাথে চালাতে হবে। আর, ইট অ্যাজ হেলদি অ্যাজ পসিবল অ্যান্ড ওয়ার্ক আউট। কারণ যদি ভবিষ্যতে স্ট্রাগল লেখা থাকে, তাহলে শরীরকে বহু অ্যাবিউজের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ওটাকে যতটা পারিস রেডি করে রাখ।”

“টুডে অনওয়ার্ডস, টার্ন অল টিয়ার্স ইনটু আ পিস অফ ইওর বম্ব। অ্যান্ড কীপ গেটিং ক্লোজার টু ইওর গোল।”
মান্যা দেখলাম মেসেজ করেছে, “i just don’t know how to thank you 😞 “

বললাম ‘Thank me by succeeding. I’ll see you ten years from now. If you are proud and happy. Then I’ll know you have succeeded.”

* * *
গল্প এখানেই শেষ। বাকিটা আমি লিখব না। মান্যা লিখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *