বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা ও শম্ভাজীর ভূমিকা

নিশুতি রাত। রাস্তা দিয়া কোনো সাড়াশব্দ নাই। গাছের ডালে ডালে দুইটি তিনটি জোনাকি মাঝেমাঝে জ্বলিতেছে। রাস্তার একধারে একটি ঝোপের ভিতর দুইজন মানুষ ঘাপটি মারিয়া বসিয়া ছিল।

এমন সময় একজন চটাস করিয়া মশা মারিল। তাহার সঙ্গী চাপা স্বরে বলিল, “আঃ ক্ষুদি, আওয়াজ করিসনে। শুনে ফেলবে!” তাহাতে প্রথমজন অধীর কিন্তু নীচু কণ্ঠে বলিল, “কেউ শুনবে না! বনের মধ্যে এসে তখন থেকে শুনে ফেলবে শুনে ফেলবে করে যাচ্ছে! অত ভয় করলে চলে নাকি?” দ্বিতীয়জন বয়সে বড়, সে ঈষৎ চুপ করিয়া থাকিয়া উত্তর করিল, “ইংরেজের ভয় নয়। আমাকে আসার আগে সত্যেনদা ডেকেছিল। আমরা একা আসিনি। আমাদের পেছনে লোক আছে।” এইবার ক্ষুদির গলা শোনা গেল, তাহাতে বিস্ময়। “আমাদের পেছনে লোক পাঠিয়েছে সত্যেনদা?” – গলাটা যেন একটু আহতই শোনাইল।

পাঠক এতক্ষণ বুঝিয়াছেন আমরা কাহাদের কথা বলিতেছি। প্রথমজন স্বয়ং ক্ষুদিরাম বসু, দ্বিতীয়জন তাহার অগ্রজপ্রতিম বিপ্লবকর্মী প্রফুল্ল চাকী। কিন্তু আমরা যে কাহিনী আজ শুনাইব, তাহা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয় নাই। অঘটনের ঘূর্ণাবর্তে পড়িয়া তাহা আজ বিস্মৃতির অতলে তলাইয়ে গিয়াছে।

ক্ষুদিরামের প্রশ্নের উত্তরে প্রফুল্ল যাহা উত্তর করিলেন, আমাদের কাহিনীর সূত্র তাহারই মধ্যে। প্রফুল্ল বলিলেন, “তুই যা ভাবছিস তা নয়। আমাদের ওপর সত্যেনদার ভরসা এতটুকু কম নেই। এই লোকও আমাদের কেউ নয়। এ এসেছে মহারাষ্ট্র থেকে। মারাঠা দেশের লোক।” এই বলিয়া প্রফুল্ল চুপ করিলেন। কেমন যেন একটা অস্বস্তি গলায় দানা বাঁধিয়া তাহার বাক্‌রোধ করিতেছিল। ক্ষুদিরাম বলিল, “থামলে কেন? কে এ? আমাদের পেছনে এসেছে কেন? এল তো সাথে এল না কেন?”

“বলছি।” প্রফুল্ল চিন্তিতভাবে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। গাড়ি আসিতে এখনও দুই ঘন্টা…

“শম্ভাজীর নাম জানিস? – শিবাজী মহারাজের নাম তো শুনেছিস। শম্ভাজী শিবাজীর বড় ছেলে। শম্ভাজীর জন্মের আগের দিন, শিবাজী যখন দুপুরবেলা খেতে বসেছিলেন, তখন ঘটনাক্রমে টিভিতে “লায়ন কিং” দেখাচ্ছিল। শিবাজীর তাতে চোখ পড়ে যায়। পুরো সিনেমাটা শিবাজী বসে দেখেন।

“পরদিন সকালে শম্ভাজীর জন্ম হয়। শিবাজী ছেলেকে হাতে নিয়ে সোজা দুর্গের ছাদে বেরিয়ে আসেন, সপার্ষদ। তারপর আগের দিন মুফাসাকে যেরকম করতে দেখেছিলেন, হুবহু সেইভাবে সূর্যের দিকে বাচ্চাটাকে তুলে ধরেন। পেছন থেকে তানাজী এটার একটা দেড় মিনিটের ভিডিও করেন, সেটা পরে ভাইরাল হয়।

“শম্ভাজী ছোটোবেলা থেকেই একটু নাদুসনুদুস ছিলেন। তার ওপর আদ্ধেক কাজ বাবা করে রেখেছেন, ফলে তাঁর নিজের কাজকর্মের ভাগটা বেশ কমই ছিল। তো হয় কী, একটু বয়স বাড়তে বাড়তে তিনি বেশ, যাকে বলে একটু ‘হেলদী’ হয়ে পড়েন। কিন্তু শরীরে ইয়ে হলে হবে কী, শিবাজীর ছেলে তো? মনের আগুন বরাবরই তাঁর একটা ছিলই।

“উনিশ বছর বয়সে শম্ভাজী একটা বাঘ মারেন। মারাটাও খুব অদ্ভুত, উনি গাছের ডালে বসে ছিলেন, সেটা ভেঙে নীচে বাঘটার ওপর পড়ে। ডালটা পাশে পড়ে, উনি বাঘের ওপর পড়েন, বাঘটা তাতে মারা যায়। এতে রাজধানী সহ আশেপাশের অঞ্চলে বীর হিসেবে শম্ভাজীর নাম ছড়িয়ে পড়ে।

“পরে ইংরেজরা যখন এদেশে এসে অত্যাচার শুরু করে, তখন শম্ভাজীর সাথে তাদের ঝামেলা লাগে। শম্ভাজী কখনো রাজ্যের রিসোর্স নষ্ট করা পছন্দ করতেন না। এই স্বভাবটা আসলে ওনার বাবার কাছ থেকে পাওয়া, শিবাজী নিজে এই ব্যাপারে খুব কড়া ছিলেন। শিবাজীর রান্নাঘরে কড়া হুকুম থাকত, সবার খাবার জন্য যতটা বরাদ্দ তার চেয়ে খানিকটা কম রান্না হবে। সৈনিক মানুষদের পেটে সামান্য খিদে থেকে গেলে অসুবিধা নেই, কিন্তু খাবার বেশী হয়ে যেন নষ্ট না হয়। – শম্ভাজী পরে যুগের সাথে সাথে সেটাকেই একটু বদলে নিয়েছিলেন, খাবার যত রান্না হয় হোক, যা বাড়তি হবে শম্ভাজী একাই তুলে দেবেন। নষ্ট একদম হবে না। – তা ইংরেজরা এসে যখন এই জিনিস দেখল, তাদের তো চোখ কপালে। বলল, দিস ইজ হিউজ ওয়েস্টেজ অফ ন্যাচারাল রিসোর্স। তোমার রাজ্যে লোকে জলের অভাবে রেডবুল খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে মরছে, আর তুমি রোজ মুর্গী-পাঁঠা-বেদানা-আঙুর সাঁটাচ্ছ? মিসগভার্নমেন্টের ডায়ে টুমাখে পুট ডাউন করিব। – ব্যাস আর পায় কে। শম্ভাজী গেলেন খেপে।

“কিন্তু তুই তো জানিস ইংরেজের স্বভাব, চোট্টামি ছাড়া এরা কথা কয় না। ঠিক যুদ্ধের আগের রাতে শম্ভাজীর পোলাওয়ে কী যেন ওষুধ মিশিয়ে দিল, পরদিন সকাল থেকে শম্ভাজীর অসহ্য হাঁটু ব্যথা। সেসবের কথা মনে করলে এখনও মারাঠারা রাগে কাঁপে।

“তারপর এতদিন বাদে আমরা ইংরেজদের বোমা মারব ঠিক করেছি খবর পেয়ে শম্ভাজী নিজে এতদূর এদেশে এসেছেন। সত্যেনদার সাথে দেখা করে খুব তর্কাতর্কি পীড়াপীড়ি করেছিলেন, এই কাজটা পাবার জন্য। কিন্তু সত্যেনদা কিছুতেই রাজী হয়নি। কিন্তু শম্ভাজী নিজের উদ্যোগে আমাদের পিছু নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, সেটা সত্যেনদার কাছে খবর আসে। আমাকে আসার আগে সত্যেনদা এটাই বলেছিল। তুই হয়তো খেয়াল করিসনি, আমি ব্যাপারটা জানি বলেই আসার পথে বেশী করে কান খোলা রেখেছিলাম। আসতে আসতে অন্তত দু’বার আমি আমাদের পেছনে পায়ের চাপে ডাল ভাঙার শব্দ পেয়েছি। খুব আবছা একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজও টের পেয়েছি কয়েকবার। আমাদের কপাল ভালো, মারাঠারা বাংলা বোঝে না।”

.

.

.

.

.

.

.

.

.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *