মুখোশ

এস্থেটিকস বা নন্দনতত্ত্ব বলে একটা সৌন্দর্য বিষয়ক সাবজেক্ট আছে। আমি এস্থেটিকস পড়িনি।

মেয়েদের বুক দেখানো বা না দেখানো নিয়ে যে মুভমেন্ট চলছে, আর তাই নিয়ে যা চলছে, সেটা নিয়ে কিছু কথা আছে। প্রথম কথা হল প্রবলেমটা কোথায়। আধুনিক সভ্য সমাজে মেয়েদের বুক দেখানো যায় না। দেখাতে গেলে সেন্সরড হতে হয়। এর কোনো যুক্তি নেই।


এটা নিয়ে তর্ক করতে গেলে কাকুরা রাগ করে ফেলেন। কারণ মেয়েদের বুক যে অশ্লীল সে তো সবাই জানে। এ নিয়ে আর তর্ক কী? কিন্তু কেন অশ্লীল তার কোনো উত্তর নেই। বড়জোর বলা হবে যে ওটা (ওগুলি?) দেখলে ছেলেদের মনে নোংরা চিন্তা আসে, তাতে সমাজের আবহাওয়া খারাপ হয়। সুতরাং মূলেই উচ্ছেদ করো। চিন্তা আসার যাতে সম্ভাবনাই না থাকে, তাই বুক ঢাকো। কিন্তু এতে হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। প্রথমেই দেখুন আমি ব্র্যাকেটে ‘ওগুলি’ লিখেছি, কারণ কোন বচনের সর্বনাম ব্যবহার হবে সেটা নিয়ে প্রচুর লোকজনই দ্বিধাবিভক্ত, কনটেক্সটের সুযোগ নিয়ে কিন্তু একদম নোংরা চিন্তা করবেন না। এ থেকে বোঝা যায় বুকেরও স্পেসিফিকেশন আছে। বুক একটা হলিস্টিক ব্যাপার। যেটা অশ্লীল সেটা হল স্তন, যেজন্য বহুবচন, কারণ মানুষের স্তন থাকে দুটো। বাচ্চা জেনারেলি একটা হয়। যদি চার-পাঁচটা করে বাচ্চা হত তাহলে স্তনও বেশী থাকত।

কিন্তু স্তন কোথায় অশ্লীল? স্তন সেন্সরড হচ্ছে কোথায়? ও তো পরিষ্কার বোঝা যায়, জামার তলায় পাশাপাশি দুটো স্তন উঁচু হয়ে থাকে। থ্রি-ডি জিনিস, বিছানাচাদরের নীচে বালিশ থাকলে সেটাও পরিষ্কার বোঝা যায়, এটাও পরিষ্কার বোঝা যায়। – তাহলে ঠিক স্তন না, অন্য কিছু নিয়ে সমস্যা। আরো স্পেসিফিক। এখানে এসে পাওয়া যাবে সেই ইংরেজী শব্দ যার বাংলা হয় বিভাজিকা, ইংলিশে ক্লীভেজ। ক্লীভেজ, – এটাই হল সমস্যা, এটাকেই চোখের আড়াল রাখা দরকার। তাই নীচু নেকলাইনের জামা অশ্লীল, তাতে বেশী বিভাজিকা দেখা যায়। এই বিভাজিকা শব্দটাই শালার অশ্লীল, সোজা বাংলায় ভাঁজ বলা যেত। কিন্তু বিভাজিকাতেও ব্যাপার দাঁড়ায় না।

কারণ প্র্যাকটিকালি দেখা যায়, এই ভাঁজ দেখানোটা আজকাল যাকে বলে নট আ বিগ ডীল। আকছার দেখা যায়, অল্প একটু দেখাই যায়, কেউ তাতে খারাপ বলে না, দোষ ধরে না। হ্যাঁ, বেশী দেখা গেলে সেটা হচ্ছে ‘সাহসী’, কিন্তু সেন্সরড হবে না। পেঁয়াজ। ভেজিটেবিল আমিষ। তাহলে সেন্সরড কখন হবে? মুশকিল হচ্ছে ক্লীভেজে সেন্সরশিপের কোনো ব্যাপারই নেই।

সেন্সরটা হয় যেটা দেখা গেলে, সেটা হচ্ছে নিপ্‌ল। মানে বাংলায় স্তনবৃন্ত। সোজা বাংলায় বৃন্ত মানে বোঁটা, কিন্তু বোঁটা বললে আপনি বলবেন অশ্লীল, বাংলার অপমান হবে। এই বৃন্ত দেখানো যায় না, সিনেমায় ছবিতে টিভিতে নাচে গানে। দুই ইঞ্চি হলেও একফালি কাপড় দিয়ে সেটা ঢেকে রাখতে হয়। বাকি স্তন যদি দেখা যায়, ওই আর কী, ‘সাহসী’, তবে সেন্সরড হবে না। ইট ইজ স্টিল ফ্রি।

 ঘটনাটা কোথায় এসে ঠেকল দেখেছেন কি? যে জিনিসটা সেন্সরড, সেটা আদৌ একটা স্ত্রী-অঙ্গ নয়। সেটা সমান গৌরবে পুরুষদের শরীরেও বর্তমান। গৌরব কথাটা একদম লিটারালি নিতে পারেন, সাইজ অর্থে। মেয়েদের স্তন বড় হয় কারণ তাতে দুধ তৈরী হয়। ছেলেদের সেটা নেই, তাই স্তন-স্তনবৃন্ত দুটোই মোটামুটি অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু বড় স্তন না থাকলেও নিপ্‌লের সাইজ মেয়েদেরও যা ছেলেদেরও তাই। তাহলে একই জিনিস এক ক্ষেত্রে অশ্লীল, আরেক ক্ষেত্রে অশ্লীল নয় কেন?

মোদ্দা কথা হল নারীপুরুষের সমানাধিকারের পথে এটা অন্তরায়। তাই মুভমেন্টের নাম ফ্রি-দ্য-নিপ্‌ল। লোকজন হ্যাশট্যাগ শেয়ার করছে। ছবিতে ছেলেদের ও মেয়েদের দেখা যাচ্ছে, খোলা বুকে দাঁড়িয়ে আছে। কারও কারও গায়ে কাজল (বা কিছু একটা কালো কালি) দিয়ে লেখা ‘ফ্রি দ্য নিপ্‌ল’। 

এখান থেকে আমার মূল বক্তব্য শুরু। বক্তব্যটা হল, এখানে একটা হিপোক্রিসি আছে। সমস্ত শরীরই খোলামেলা হয়ে প্রদর্শিত হবার অধিকার রাখে, এই দাবীটা ফাঁকা, মেকি, ধাপ্পা।আমি জানিনা সবার কী মনে হয়, একই রকম মত হওয়া অস্বাভাবিক, অনভিপ্রেতও। কিন্তু পোস্টারগুলোয় দেখুন, যারা মডেল, তারা কিন্তু মোটের ওপর সুদর্শন। আমি সব ছবি দেখিনি। কিন্তু যেগুলো দেখেছি, সেগুলোতে যারা দাঁড়িয়েছে, তারা দেখতে ভালো। তাদের বুকও দেখতে ভালো।

দু’হাজার উনিশ বলে একদম অনিন্দ্যকান্তি কাউকে দাঁড় করায়নি। করালে হিপোক্রিসিটা বড্ড চোখে লাগত।

ভালো দেখতে শরীর দেখানো হচ্ছে, এটা নিয়ে আমার আপত্তি নেই। আমার আপত্তি এইটা নিয়ে যে বলা হচ্ছে নাকি আমরা সবরকম শরীরকেই সমান সম্মানের চোখে দেখতে পারি।

মানুষের শরীর প্রকৃতির সবচাইতে ইল-মেইনটেইনড জিনিসগুলোর মধ্যে একটা। গড়পড়তা আধুনিক মানুষের শরীর মোটেই সুগঠিত বা সুন্দর হয় না। কারণ মানুষের জীবনধারা যেরকম হবার কথা ছিল, যেরকম জীবনযাপনের জন্য মানুষের এই শরীরের ইঞ্জিন তৈরী, সেই জীবনধারা মানুষ পেছনে ফেলে এসেছে কুড়ি-তিরিশ হাজার বছর আগে। এই সোঁদা, বোদা জীবনের জন্য এই বডি তৈরী নয়। ব্রেনও তৈরী নয় যদিও, কিন্তু সে প্রসঙ্গ আলাদা। বনে-মাঠে দৌড়-ঝাঁপ করার দিন গেছে, তাই সেই খামতি পূরণ করার জন্য মানুষ যোগব্যায়াম থেকে শুধু করে ট্রেডমিল অবধি এই সব কিছু উদ্ভাবন করেছে। আদিম মানুষ ক্রসফিটও করত না, ভুজঙ্গাসনও করত না। করত না কারণ লাগত না। এমনিতেই শরীরের স্বাস্থ্য, সৌষ্ঠব বজায় থাকত, হাড়-পেশী সবল সুন্দর হত। এখনকার দিনে মিলিয়ে দেখতে গেলে পোষা কুকুরের সাথে তুলনা করুন। যারা ল্যাব্রাডর বা রিট্রিভার বা আর যেকোনো কিছু পোষে, তারা সেগুলোকে প্রতিদিন প্রচুর ব্যায়াম করাতে নিয়ে যায়। যেসব গান্ডু (সুলভ) সেটা নিয়ে যায় না, তাদের কুকুরের চেহারা দেখে চেনা যায়, মুটিয়ে যায় কুকুরগুলো, থলথলে হয়ে যায় শরীর, দম কমে আসে, রোগ বাসা বাঁধে সহজে, আয়ু যায় কমে।

এই যে মোটা ব্যায়াম-না-করা কুকুর, এটাই আজকের দিনের মানুষের ডিফল্ট কন্ডিশন। আলাদা করে চেষ্টা-চরিত্তির করে যারা ব্যায়াম করে, তারা করে।

তাই, বেশীরভাগ মানুষের শরীরই ঠিক, মানে, প্রদর্শনযোগ্য নয়। মানে দেখা যাক ক্ষতি নেই, দেখা তো কত কিছুই যায়, বাঙালীর ফেসবুকসাহিত্যের মতো, কিন্তু আলাদা করে দেখানোর যোগাড় করতে যাওয়া ঠিক নয়। আমার ফেসবুক পোস্ট আমার ওয়ালে শোভা পেতেই পারে, কিন্তু সেটাকে জোর করে বই ছাপিয়ে বাজারে দেওয়ার মতো কাজ আমার করা উচিত নয়, যদি না আমার লেখার সেই মান থাকে।
দেখুন, সবাইই সুন্দর নয়। কেউ কেউ সুন্দর। যারা সুন্দর তাদের দেখতে ভালো লাগে, যারা সুন্দর নয় তাদের দেখলে কিছু মনে হয় না, যারা অসুন্দর তাদের দেখতে খারাপ লাগে।

সৌন্দর্যই সব নয়। যাকে আমার ভালো লাগে না তাকে আমার দেখতে ভালো লাগতে পারে। যাকে আমার ভালো লাগে তাকে আমার দেখতে ভালো না লাগতে পারে। Not everyone is beautiful. ‘নিজের মতো করে সুন্দর’ কথাটা আর্টের ক্ষেত্রে খাটে, কিন্তু শরীর জিনিসটা তো ঠিক শিল্প নয়, তার নিয়মকানুন আছে। সবারটা সুন্দর নয়। এবং সেইসাথে, মানুষ কেবলমাত্র শরীর নয়। বাজে শরীর থাকা মানেই বাজে হওয়া নয়। এটা বুঝুন। যখন একজনকে জোর করে সুন্দর বলে বর্ণনা করছেন, তখন তাকে আসলে তার শরীরের সাথে মিলিয়ে দিয়ে অপমানই করছেন কি না, ভাবুন।

যেসব মেয়েদের মুখে অ্যাসিড পড়েছে, তাদের চেহারা মারাত্মক কুৎসিত, এটা বলতে শেখা দরকার। তাদের চেহারাটা কুৎসিত। তারা নয়। যেজন্য চেহারার কুৎসিত হওয়াটা ম্যাটার করে না। যে বলে, তাদের চেহারা কুৎসিত নয়, তারা নিজেদের মুখের ওই হাল করতে রাজী হবে? হবে না। কারণ জিনিসটা খারাপ। সেটাকে ‘ওটা কিছু নয়’ করে উড়িয়ে দেওয়ার অধিকার আপনার নেই। 

নিপ্‌ল-ঢাকার নিয়মটা ফালতু, ওটার কোনো দরকার নেই। ফেলে দেওয়াই উচিত। কিন্তু সেইসঙ্গে সব নিপ্‌ল বা সব বডিই সমান ভালো, এই ঢপটা না ছড়ালে মঙ্গল। সবকিছু শুগারকোট করার কী দরকার? নানারকম আছে, সেটা নানারকমই থাকুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *