কুটুমনামা (১)

হোয়াইট কলার থীফ বলে একটা খতরনাক কনসেপ্ট আছে। মানে চোর, কিন্তু হাইক্লাস। এধরনের চোর সাদাসিধে ছিঁচকে চুরি করে না। সাধারণত জালিয়াতি, ঘুষ, ছকবাজি, জোচ্চুরি – এই গোছের কাজকর্ম এদের লাইনের জিনিস। ধরুন আমি আপনার বাড়ি রাঁধুনির কাজ করি, একদিন আপনি নেই, আমি আপনার আলমারি সাফ করে পালালাম। এটা হল গিয়ে এমনি চুরি। আর যদি এমন হয় যে আমি আপনার পরিচিত, হয়তো আপনার উকিল কিংবা ব্যাঙ্কার বা – বলতে নেই – আত্মীয়, আমি এমন একটা প্যাঁচ করলাম যে আপনার লাখকয়েক টাকা সুড়সুড় করে আমার হয়ে গেল, আপনি হয়তো টেরও পেলেন কিন্তু হাঁ করা ছাড়া বিশেষ কিছু করতে পারলেন না, – এইটে হল গিয়ে হোয়াইট কলার চুরি।



মানে বেসিকালি ঠকবাজি। কিন্তু উইথ স্কিল। আমি জীবনে কয়েকবার এধরনের ঠকবাজের পাল্লায় পড়েছি (হে হে, না, শ্বশুরবাড়ির কথা হচ্ছে না, ওটা টুউ ডার্ক)। সেইসব গল্প ভাবছি ফেসবুকে শোনাব। মানুষের সেবা করা আমাদের কর্তব্য। এইক্ষেত্রে সেবা = এনটারটেনমেন্ট।

ভাবছি লেটেস্ট দিয়ে শুরু করি। আবার, আয়রন ম্যান না দেখলে ইনফিনিটি ওয়ার বোঝা শক্ত, সেও ঠিক। – পোস্টমডার্নিস্ট ফর্মে সব অ্যালাউড, ল্যাজা-মুড়ো-পেটি যেকোনো একটা পিস ধরে শুরু করে দেওয়া যাক।

সাহিত্যচর্চার সাথে ঠকবাজির একটা মিল আছে। দুটোই করা খুব সহজ, সবাইই কখনো না কখনো করে। কিন্তু সাকসেসফুলি লেজেন্ডারি লেভেলের কাজ নামানোটা মোটেই সবাই করে উঠতে পারে না। দু-পাঁচটা কবিতা-টবিতা যেমন সবাইই লেখে। মাঝেসাঝে এক-আধটা গুলতাপ্পিও সবাইই দেয়, স্কুল পালানো থেকে শুরু করে আপিস কামাই পর্যন্ত নানান দরকারে। কিন্তু “কবি” কি আর সবাই হয়? এই লাইনেও, টু প্যারাফ্রেজ জীবনানন্দ – সকলেই গুণী নয়, কেউ কেউ গুণী। সদ্যতম যে অদ্ভুত জুটির পাল্লা থেকে আপাতত বেরিয়েছি, তাদের একজন এদিক থেকে রিমার্কেবল, কারণ সে বোথ কবি এবং গুণী।

 ঘটনার শুরু হচ্ছে ইন দ্য ইয়ার ১২৪৭ খ্রীঃ, যে বছর আমি বঙ্গদেশ থেকে পুণা আসি। নাম-তারিখ সবই অদলবদল হবে বুঝতেই পারছেন, কারণ আমি পুলিশ নই। ওটা হলে ফেসবুক অবধি আসত না। তাই গল্পের মোড়কটা ইয়ে রাখতে এসব করতে হবে। কিন্তু চরিত্ররা এ চত্বরে সব ক’জনাই ভালোরকম পরিচিত, চিনে নিতে প্রবলেম হবে না।

পুণা আসছিলাম চাকরির চেষ্টায়। মাসখানেকের মধ্যে চাকরি জোটানো চাইই চাই, নাহলে মাথার ওপর ছাদ থাকে না। এমনিতেও ধারকর্জ করে চলছিল। কিন্তু আমি তো জিন্দেগীতে পুরুলিয়ার পশ্চিমে কোথাও যাইনি (একবার মাত্র মুম্বই গেছি, তাও আইআইটিতে, ওটা কিছুই না), পুণায় চেনাশোনা কেউ থাকেও না, গিয়ে উঠব কোথায়? — দিন পাঁচ-সাতের জন্য যাওয়া, মাথা তো গুঁজতে হবে কোথাও?

ফেসবুকেই অগ্নিমিত্রাদি বলে একজনের সাথে আলাপ হয়েছিল। তার থেকে খোঁজ পাই পুণার বেনিয়াসহকলা স্কুলের। ইংরেজীর মাস্টার চাই, সাথে ইতিহাসও পড়াতে হবে। কিন্তু কন্ডিশন হচ্ছে চাকরি পাওয়ার আগে ক্লাসরুমে পড়িয়ে ডেমনস্ট্রেশন দিতে হবে, তাতে স্কুলের ম্যানেজমেন্টকে খুশী করতে হবে। যদি সেটা উতরোয়, তবে চাকরি। অগ্নিমিত্রাদির সাথে ইস্কুলের ভাইসপ্রিন্সিপালের আলাপ ছিল, সেই সূত্রে প্রথম কথাবার্তাটুকু হয়ে গেল। এবার সশরীরে হাজির হওয়ার পালা।

এর আগে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছি আমি মাত্র একবার, এক বাংলা কাগজের অফিসে। সে অত্যন্ত ঝুল অভিজ্ঞতা। ক্লাসে পড়ানো জিনিসটা যদিও সম্পূর্ণ আলাদা, তাও সেও তো প্রথমবার! পড়ানো নিয়ে ভাবনা নেই, ভাবনা ওই ‘খুশী করা’ নিয়ে। কে যে নিজের হিসেবমাফিক কী চায়, ভগবান জানে। কিন্তু চান্স নিতেই হবে, কারণ দিনকে দিন ‘নেগেটিভ ক্যাশ ফ্লো’ বেড়েই চলেছে। সুতরাং আমি পুণার তোড়জোড় শুরু করে দিলাম।

প্রথম কাজ, গিয়ে কোথায় উঠব সেটা ঠিক করা। অগ্নিমিত্রাদি বলেছিল ওই ইস্কুলেরই একজন মাস্টারের সাথে কথা বলে দেবে, কয়েকদিনের জন্য তাদের বাড়ি উঠতে পারি। অগ্নিমিত্রাদি ফেসবুক ফ্রেন্ড, জীবনে কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি। যেসব বন্ধু এবং বন্ধুস্থানীয়দের সাথে জীবনে প্রচুর সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদের ৯৯% নিজেদের কাজে ব্যস্ত, আমার ড্রামায় জড়ানোর ফুরসত নেই। যে দু’তিনজন তখনো টিকে ছিল (এগুলো এখনো টিকে আছে, জাস্ট ইমাজিন!), তাদের মধ্যে একজন আমার বিদ্যাপীঠের জুনিয়র, নাম ধরা যাক ভার্গব। বলল, পুণায় তার একজন চেনা লোক আছে, সেখানে উঠে পড়তে পারি।

আমি হিসেব করলাম, ফেসবুক ফ্রেন্ডের চেনা লোক আর এমনি ফ্রেন্ডের চেনা লোক, কোন্‌টাকে ফার্স্ট চয়েস ধরব? অগ্নিমিত্রাদি যার কথা বলেছে, কপাল ভালো হলে সে লোক ভবিষ্যতে আমার কোলীগ হবে। তার থেকে গোড়াতেই একটা বড় ফেভার নিয়ে কেরিয়ার শুরু করতে মন চাইছিল না। সেটাকে সেকেণ্ড অপশন ধরে আমি ভার্গবের পরিচিত পার্টিকে ফোন লাগালাম। এরা দু’জন মিলে থাকে, আমাকে উঠতে দেওয়ার মতো জায়গা আছে ফ্ল্যাটে, এবং মোটামুটি সহানুভূতিশীল, হেল্প করতে পিছ-পা নয়। ভার্গবের সাথে তাদের এক রাউণ্ড কথা হয়েছে অলরেডি, সব স্মুদ, খালি একটাই ডাউট ক্লিয়ার করার। এই দু’জন, নাম ধরা যাক ইন্দিরা এবং প্রতিভা, বেড়াল পোষে। একটা-দুটো নয়, খান আঠেরোটা বেড়াল আছে বাড়িতে। – এটা আমি সামলাতে পারব তো?

ভার্গব জানত আমার জন্তুজানোয়ারে সমস্যা নেই, সেকথা ও ইন্দিরাকে বলেছিল। আমিও ফোন করে কথা বললাম। বেড়াল থাকুক, আমার সমস্যা নেই, আমিও বেড়ালের জন্য সমস্যা হব না। যাবো, উঠবো, স্কুলে গিয়ে ইন্টারভিউ দেব, ফিরে আসব। দিন তিনেকের মামলা। তখন কি আর জানি, সেই তিনদিনের খেল একেবারে তিন বছরে গিয়ে ঠেকবে, আর বিল্লির ঠেলা সামলানোর দায় শেষটায় আল্লার ডার্ক খিল্লি হয়ে খোলতাই হবে? 

যদিও হাইন্ডসাইটে মনে হয়, আমার জানা উচিত ছিল। গোল্ডফিশের কপালে ফিশবোলই লেখা থাকে, আটলান্টিক নয়। আমার নাটকের মোটামুটি যা প্যাটার্ন দেখা গেছে, তাতে মোটামুটি এটুকু পরিষ্কার যে প্রেডিকটেব্‌ল আউটকাম বলে আমার কপালে কিছু নেই, একমাত্র পাকা কথা হল শেষ চ্যাপ্টারে গিয়ে নৌকোয় ফুটো পাওয়া যায়। এ প্রায় সেই ক্লাস নাইন থেকে দেখে আসছি। আগে থেকে আঁচ পেলেও যে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারতাম, হলফ করে সেকথা তাই বলতে পারিনা। স্পেকট্রামের একদিকে যদি মাকিয়াভেল্লি থাকে, আর আরেকদিকে রামকানাই, তাহলে আমাকে চোখ বুজে রামকানাই ঘেঁষে প্লট করে ফেলা যায়।

প্রথমবার পুণা যাবো, কীভাবে যেতে হয় সেসব কিছুই জানি না। মুম্বই কী করে যায় জানি, মুম্বই থেকে পুণা যাওয়া যায় তাও খবর মিলল। এবারে ডু-ইট-ইওরসেল্ফ। শেষটায় প্ল্যান দাঁড়াল যে মুম্বইয়ের টিকিট কাটব, নেমে পড়ব আগেই, তারপর সেখান থেকে বাস ধরে পুণা। পুণায় কোথায় নামতে হবে ইন্দিরা বলে দিয়েছে, সব ঠিক থাকলে রাতের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া উচিত। – আর যদি সব ঠিক না থাকে, যদি ফোনে ইন্দিরা-প্রতিভাকে না পাওয়া যায়, কনফার্মেশন না পাই, তাহলে আমি মুম্বই অবধি চলে যাব। ওখানে অঙ্কন থাকে, কলেজের বন্ধু, তার বাসায় উঠতে হবে। তারপর পরদিন বাস ধরে পুণা।

কনফার্মেশন পাওয়া গেল। আমি বিকেল নাগাদ নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। পকেটে টাকা কম, সস্তা দেখে একটা লাল বাসের টিকিট কেটে তাতে চেপে বসলাম। ঠিক রূটের বাস কি না কে জানে, চারদিকে সব সাইনবোর্ডপত্তর হিন্দীতে লেখা, কয়েকটা বোধহয় মারাঠী, জানি না, লোকে মনে হয় মারাঠীই বলছে আশেপাশে, যতদূর বুঝলাম এই বাসটাই যাবে। বাকি যা থাকে কপালে।

জানলার পাশে বসেছি। পশ্চিমঘাটের কোল বেয়ে রাস্তা চলেছে, আর বাইরে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। এই আমার প্রথম পশ্চিমঘাটের সাথে দেখা। এর আগে মুম্বই এসেছি, কিন্তু আইআইটিতে বন্ধুর কাছে ঘুরতে এসে একঝলক পশ্চিমঘাট দেখা, আর বরাবরের মতো বাংলা থেকে পাট চুকিয়ে বেরোনোর চেষ্টায় একা-একা চাকরির খোঁজে প্রথমবার ভিন্‌দেশে এসে পড়ন্ত বেলায় পশ্চিমঘাট দেখা, – এ দুয়ের মধ্যে তফাৎ অনেক।

কলকাতায় বছরের পর বছর কেটেছে, দিগন্ত দেখিনি মাসের পর মাস, ভালো করে আকাশ দেখিনি তাকিয়ে। সূর্যাস্ত দেখিনি, সূর্যোদয় না, গোধূলির কয়েক মুহূর্তে আকাশের গায়ে মেঘ যে ম্যাজিক আঁকে সে জিনিস দেখিনি কতদিন। একদিন তো নিত্যকার দেখাশোনা ছিল। হাতের মুঠো গলে এরকম আলগা বালির মতো সেইসব ছেলেবেলা উধাও হয়ে যায়? 

বাংলায় আর কিছু নেই সে তো বুঝেইছি। আমার বাপ ঢাকার, মা সিলেটের, একজনের বাড়ি এসে উঠেছিল শিলিগুড়ি, আরেকজনের শিলং। আমি নিজে আবাল্য বাড়িছাড়া, খানিকটা শিকড় বাংলাদেশে পড়ে আছে, বাকিটা এখানে ছিল। কিন্তু সেই অতীত তো মরে গেছে, বর্তমানের কাছে তার কোনো পুরোনো ফোটোও রাখা নেই। কিন্তু সময় যে সার্কল, তা সবসময় পোড়াজমির গল্পে এসে ঠেকে না। সেই সস্তা লাল বাসে যেতে যেতে সন্ধ্যা দেখছিলাম, বাদামী পাহাড়ের সারির ওপর হলুদ-গোলাপী-লাল মেঘের ছিট-ছিট প্যাটার্ন, দিগন্ত ঘেঁষে ব্লু -গ্রে টানের পেছনে সোনালী আলো-গোলা আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড। 

অদ্ভুতভাবে কেমন যেন মনে হচ্ছিল ঘরে ফিরছি। এখনও আবছা মনে আসে – নিজেই হেসেছিলাম কথাটা ভেবে। কিন্তু যাই কোথায়? জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা কথাই বার বার মনে পড়ছিল… পুরুলিয়া।


*** (১ম অংশ সমাপ্ত) ***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *