আচ্ছা, আমি নিরেট লোক, নিরেট লোকের মতোই বলি।
রামকৃষ্ণ মিশন নিয়ে মানুষজনের ম্যানিয়া আর ফোবিয়া, দুটোই আছে। আমি দুই পক্ষকেই কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের চরিত্র হল, মানে, সেই বিশপের মতো, দেয়ার ইজ সো মাচ সাফারিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড, বাট উই ক্যান ডু সো লিটল। সুতরাং, আমরা যে ইস্যু নিয়ে বাজার গরম হয়, সেই ইস্যু নিয়ে জনসেবা করতে প্রাণপণে লেগে যাই। এখন কোনো কারণে কিছু মানুষের মনে হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের কালো হাত ভেঙে দেওয়া গুঁড়িয়ে দেওয়া দরকার, তাই এখন তাঁরা নেমেছেন। কয়েকদিন পরে জল নেমে গেলে তাঁরাও নেমে যাবেন।
রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান চরিত্র হল তা একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এটা হওয়ার দরুণ এর কিছু দুর্বলতা আছে। তার অন্যতম – মিশন নিজের কোডেক্স আপডেট করতে পারে না। ডারুইনপন্থীরা একথা বলেন না যে ডারুইন সাহেব ১৮৫৯ সালে যা বলে গেছেন তাই ধ্রুব সত্য; তার অনেক রদবদল হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। কিন্তু রামকৃষ্ণপন্থীদের হাতে রামকৃষ্ণকে রদবদল করার লাইসেন্স নেই। কারণ ডারুইন মানুষ, রামকৃষ্ণ নির্গুণ গুণময় ভগবান। এই একই দৃষ্টিভঙ্গী সারদাদেবী এবং বিবেকানন্দের ক্ষেত্রেও খাটে। বিবেকানন্দ যদি একশোকুড়ি বছর আগে বলে গিয়ে থাকেন যে ছেলেদের ক্যাল খাওয়া ভালো, তো সেটা বিবাদের ঊর্ধ্বে। কারণ স্বামীজী বলেছেন।
আমরা স্কুলে থাকতে গুজবগল্প শুনতাম – রামকৃষ্ণ মিশনে সাধু হতে গেলে নাকি আগে গ্র্যাজুয়েশন মাস্ট, ভালো রেজাল্ট নাকি লাগেই। এগুলো গুজবই। সাধু যে কেউ হতে পারে, সাধু কিংবা অসাধু পথে। সাধু পথে সাধু হন যাঁরা তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দেওয়া হয়। অসাধু পথে যারা হয় তাদের তো ব্যাপার আলাদা। মোট কথা এই যে রামকৃষ্ণ মিশনেও অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষ অনেক আছেন। তাঁদের হাতে নানা দায়িত্ব থাকে। তাঁদের মানসিক প্রতিবন্ধকতার ছাপ তাঁদের কাজেও পড়ে, এবং মিশন যেহেতু অর্গ্যানাইজেশন, তাই অ্যাজ আ হোল মিশনের সামগ্রিক চরিত্রও ঘোলা হয়ে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব মিল পাই নাইটস ওয়াচ-এর সাথে। একটা অসাধারণ ভিশন নিয়ে বানানো একটা অর্ডার, তাতে কীভাবে অবক্ষয় আসে। এককালে রাজারাজড়ারা গর্ববোধ করতেন যে অর্ডারে যোগ দিতে, আজ তাতে ঘসটাতে ঘসটাতে এসে জোটে যত চোর-ছ্যাঁচোড়-জোচ্চোরের দল। যে ক’জন ভালো লোক আছেন, তাঁদের তাই নিয়েই কাজ চালাতে হয়। সুতরাং অনেক ফুটো অনেক গর্ত তো থাকেই। কিন্তু সব মিলে জিনিসটা থেকে লাভ নেই কিনা, তা অত সহজে বলা যায় না।
রামকৃষ্ণ মিশনে অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা সাধু হয়ে আছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও এতদিনেও রামকৃষ্ণ মিশনের এই জায়গাটায় কোনো বদল আসেনি কারণ তাঁরা কোনোদিনই এমন কোনো লজিক্যাল পথকে এক্সপ্লোর করতে নামতে পারেন না যা তাঁদের একদিন রামকৃষ্ণের বক্তব্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেবে। তাঁরা কোনো চিন্তাসূত্রকে ফলো করার আগে প্রথমে দেখে নেন, ডাউন দ্য লাইন কোনোভাবে ঠাকুরকে কন্ট্রাডিক্ট করা হচ্ছে কি না। যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে চেক করেন যে পাশ কাটানো যাবে কি না। যদি পাশ কাটানো যায়, তো এগোনো যেতে পারে। আর না গেলে ওই পথ বন্ধ। – সুতরাং অন্ধবিশ্বাসের ঝাড় এখনো একইরকম অন্ধকার আছে।
‘এটাই মিশনের আসল চরিত্র’ বলে কিছু হয় না। মানুষেরই ‘এটাই আসল চরিত্র’ বলে দাগানো দুরূহ বলে আমি মনে করি। অনেক মানুষ মিলে তৈরী প্রতিষ্ঠানের বেলায় তো এটা আরোই সত্যি। এসব নেহাত ফাঁকা কথা।”বাজে ছেলেদের নিয়ে ভালো রেজাল্ট করে দেখান দেখি” – টাইপের দাবীও ফোঁপরা। এই যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সব নামী স্কুলের ক্ষেত্রেই তোলা যায়। এমনকী সব নামী কম্পানীর ক্ষেত্রেই তোলা যায়। All men are not equal. সবার ভবিষ্যৎ স্বর্ণময় নয়। রামকৃষ্ণ মিশন, আক্ষরিক অর্থেই একটা মিশন, তার একটা অ্যাজেন্ডা আছে। সে চায় নিজের কর্মযজ্ঞে যথাসম্ভব ভালো ভালো মানুষকে শুষে নিতে। এটা একটা প্র্যাকটিকাল জিনিস। মিশন যখন ভালো ছেলেকে নিচ্ছে তখন সেটা বলা যেতে পারে acquiring of an asset; আর মিশন যখন কোনো খারাপ ছেলেকে নিচ্ছে তখন সেটা বলা যেতে পারে service (কারণ সেটা মিশনের অ্যাজেন্ডার অংশ), – সেই খারাপ ছেলে যদি পরে পালিশ খেয়ে ভালো বেরোয় তাহলে মিশন অবশ্যই চেষ্টা করবে তাকে acquire করতে।
শেষে আসল কথায় আসি। আগেই বলেছি, মিশন সাধারণ মানুষজন নিয়েই তৈরী। আমাদের একজন প্রাক্তন ছাত্র দাদা একবার একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, “দেখো তোমরা বলো মিশনের স্ট্যান্ডার্ড পড়ে গেছে, মিশনের স্ট্যান্ডার্ড খারাপ হয়ে গেছে। আসলে কিন্তু তা না। মিশনের স্ট্যান্ডার্ড পঞ্চাশ বছর আগে যা ছিল তাইই আছে, মুশকিল হল বাইরের দুনিয়াটা অনেক এগিয়ে গেছে। মিশন এখনো সেই একই জায়গায় পড়ে আছে।” —- আমাদের সমাজে কি সামগ্রিক অবক্ষয় এসেছে? রামকৃষ্ণ মিশনেও তারই পাশাপাশিই অবক্ষয় এসেছে। মিশনের সন্ন্যাসীরা কি আমাদের এই গৃহীদের ঘর থেকেই আসেননি সবাই? সমস্যাটা আসলে স্পেশাল নয়, সমস্যাটা আসলে জেনারেল। অসুবিধা হল এই যে বাইরের দুনিয়া যত সহজে সমাধান খুঁজে নিতে চাইছে, মিশন তা চাইছে না। মিশন চাইছে ধামাচাপা দিতে। কেন, তা ওপরে বললাম। অনেক জটিল চ্যালেঞ্জ।
মারধোর অনেক খেয়েছি মিশনে। ফিফটি পার্সেন্ট ন্যায্য, ফিফটি পার্সেন্ট অন্যায্য। আমার ধারণা বাপ-মায়ের কাছেও বাচ্চারা যে শাসন পায়, তারও ব্যাপার মোটামুটি একই হয়, ফিফটি পার্সেন্ট ন্যায্য, ফিফটি পার্সেন্ট অন্যায্য। প্রাপ্তবয়স্করা ওভারগ্রোন শিশু ছাড়া কিছু তো নন, বড় বড় ভুলত্রুটি ওঁদেরও হয়। পুরোনো দিনের ধ্যানধারণা আঁকড়ে আছেন যাঁরা, তাঁদের কাজের দোষাদোষ নিয়ে যত খুশী ওজন করুন, কিন্তু তাঁদের চরিত্র আধুনিক প্যারামিটারে বিচার করা উচিত না। পিটিয়ে পা খোঁড়া আর চোখ কানা করতে বাকি রাখাকে চাইল্ড অ্যাবিউজ বলাই যায়, কিন্তু প্রসন্ন গুরুমশায়কে চাইল্ড অ্যাবিউজার বললে কি মানায়?
প্রচুর মার খেয়েছি। হাড় ভাঙার ঘটনাও ঘটেনি এমন নয়। সাপের ছোবল খাওয়ানোর ঘটনা অবিশ্বাস্য, কিন্তু আমি মিশনের যে বহুবর্ণ ছবি দেখেছি তাতে অ-সম্ভব বলে মনে হয় না। অদ্ভুত মানুষ বহু ছিলেন মিশনে। ভালো-অদ্ভুত আর খারাপ-অদ্ভুত, দুইই।
কিন্তু সব মিলে যা বলছি, – এই সবই অন্ধের হাতি দেখা। এটা একটা দিক। কিন্তু এইটাই সবটা নয়।