বিদ্যাপীঠের পশ্চিম আকাশের অজস্র ছবি আমরা অনেকে তুলেছি বছর বছর।
বিদ্যাপীঠ একদিকে দেখতে গেলে পুরোটাই পশ্চিমমুখো। গেট পশ্চিমমুখো, বড় মন্দির পশ্চিমমুখো, সারদামন্দির পশ্চিমমুখো, এমনকী আমাদের যে ফাইনাল স্ট্যান্ড সারদা সদন, সেও ছিল পশ্চিমমুখো। বিবেক মন্দিরের ট্র্যাজেডি হল তার চারপাশের জমিকে কখনোই তার আর্কিটেকচারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবহার করা হয়নি, তাই বিবেকমন্দিরের সামনের দিক কোনটা জিজ্ঞেস করলে শতকরা নিরানব্বই ভাগ লোক ভুল দিকটা দেখিয়ে দেবে।
পুবদিকে কিছু ছিল না তা নয়। পুবদিকেই তো ছিল রেললাইন। শনিবার রাতে বিবেকমন্দিরের দোতলার স্টাডিহল থেকে দেখা যেত ট্রেন আসছে। সেই ট্রেন পুরুলিয়া জংশনে থামবে, পরদিন রোববারে গেস্ট আসবে বিদ্যাপীঠে।
অদ্ভুতানন্দ ধামের জানলা দিয়েও দেখা যেত সেই রেললাইন। ক্লাস ফোর। উনিশ বছর আগেকার কথা। বিবেকমন্দিরে ফোর বি-তে ভর্তি হয়েছিলাম, দেরী করে, সামার ভেকেশনের পর। প্রথম ক্লাস নিয়েছিলেন গোবিন্দদা।
আমি একদিন ক্লাসে কথা বলতে বলতে বলছিলাম, “হোয়াট আর উই অল বাট স্টোরিজ?” — সব মানুষই জমাটবাঁধা গল্প। আর যদি একদিন সেই গল্প মনে রাখবার কেউ না থাকে, তখন তার মেয়াদ ফুরোয়। কিছুদিন আগে স্যামওয়েল বলছিল না, এই কথা?
…………………………………………………………………………………
ক্লাস নাইন-টেনে যখন পড়ি, তখন আমাদের সাথে শক্তিদা-স্বপনদার পরিচয় বেশ ভালোই। মাঝেমাঝে আমরা কেউ কেউ মাতৃ সদন সারদা সদন যেতাম, গল্প করতে, অ্যাকচুয়ালি কথামৃতের ভাষায় যাকে বলে “সঙ্গ করতে”। ওখানে গেলে মন ভালো হয়ে যেত।
শক্তিদার রুমের পাশে একটা ছোট ছাদ ছিল। সেখান থেকে দুর্দান্ত রেললাইন দেখা যেত, ওরকমটা আর কোথাও থেকে দেখা যেত না। বিদ্যাপীঠে তো আমাদের ছাদ ব্যাপারটাই রেসট্রীক্টেড ছিল। তাই সারদা সদনে গিয়ে একটুখানি ছাদে হাঁটা, ছাদ থেকে মাঠ দেখার স্বাদটাই আলাদা। সামনে সবুজ ক্ষেত, তার ওপারে দিগন্ত ঘেঁষে রেললাইন, একদম কাছেই, তার ওপারে মাঠ, তার ওপারে কী জানিনা। ছাদের গা ঘেঁষা একটা নিমগাছ ছিল, তার ডালপালা বেয়ে একটানা বাতাস বইত। বাঁদিকে মাতৃসদন, ওপারে শিমুল গাছগুলো, হসপিটাল। ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান তো ছিলই। ওরকম ক্যানভাস, একদিন ঠিক ট্রেন যাচ্ছে এরকম মোমেন্টে যদি একটা ছবি তুলতে পারি…।
একদিন গেছি। বিকেলবেলা সেদিন, আর অসম্ভব দখিনা বাতাস দিচ্ছে কতক্ষণ থেকে। বিদ্যাপীঠের সবকিছুই একটু এক্সট্রীম, – “অসম্ভব দখিনা বাতাস” ফ্রেজটা চট করে ব্যবহার হয় না এমনিতে। কিন্তু যা হচ্ছিল তাই বলতে হবে তো!
আকাশজোড়া মেঘের তোলপাড় চলেছে, সামনে বিশাল ক্ষেত, তার ওপরে ছাওয়া বর্ষাভেজা আকাশ। শুধু এই নিয়েই সেই ছাদে তখন এক বিকেল কাটিয়ে দেওয়া যায়। সে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ঝোড়ো দখিনা হাওয়ায় নিমগাছের ডালপাতা ছাপিয়ে একটা হুইসল কানে এলো। উত্তরদিকে তাকিয়ে দেখলাম, ট্রেন আসছে!