কাল এক ঘন্টা ফাঁকা ক্লাস ছিল।
আমিই এদের ক্লাসটীচার। দিনের খুচরোখাচরা অনেকটা সময় এদের সাথে আমিই থাকি। তাই যখন পারা যায় টুকরো টুকরো রঙ চাপানো। পরশু ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের ছোটোগল্প পড়া হতে হতে এদের বলেছিলাম এডগার অ্যালান পো-র “দ্য র্যাভেন”-এর কথা। কেউ পড়েনি, পড়ার কথাও নয়। আমি বলেছিলাম, ‘একদিন শোনাব।” ইউটিউবে ক্রিস্টোফার লি-র আবৃত্তি পাওয়া যায়।
কাল সময় পাওয়া গেল। চালালাম। পো-র লেখা, অনেক শব্দ আছে যার মানে জানে না। অসুবিধা নেই। কবিতার সব শব্দ সবসময় মানে না বুঝলেও চলে।
পুরোটা হবার পর জিজ্ঞেস করলাম, কী মনে হল শুনে। কবিতাটায় তো রক্তারক্তি, মারা কাটা ভূত জাদু কিছুই নেই। কিন্তু তাও একটা অদ্ভুত হিম কেন নামে শুনতে গেলে? কী আছে ওই ঘরের দরজার ওপর বসা দাঁড়কাকের বর্ণনায়, ওই লাইনের পর লাইন ঘুরেফিরে আসা বার বার একই প্রত্যুত্তরের ছায়ায়?
এইখানটা এবার স্টিফেন কিংয়ের একটা কথায় এসে ঠেকে। বলছেন, ভয় তিনরকমের, – gross-out, horror আর terror। গ্রোস-আউট কখন, – যেমন ধরা যায় একটা রক্তমাখা কাটা মাথা সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে এসে পায়ে ঠেকল – এটা হল বীভৎসতা, গ্রোস-আউট। হরর হল অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত অদ্ভুত ভয়ালতা, কালো অন্ধকারে লোমশ কী যেন, কাঁধের ওপর হঠাৎ নোখওয়ালা হাত, – এই হল হরর। আর টেরর? – টেরর আসে তখন যখন বাড়ি ফিরে মানুষ টের পায় যে তালাবন্ধ ঘরের সব জিনিস, প্রত্যেকটা জিনিস কারা যেন পাল্টে ঠিক হুবহু সেরকমই আরেক পিস রেখে দিয়ে গেছে, আর এই জিনিসগুলো একটাও আমার নয়, আমারটার মতোই দেখতে, কিন্তু আমার নয়, যার সাথে থাকি সে এ নয়, এ তার মতোই দেখতে, তার মতোই হাসছে, কথা বলছে, চোখের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু এ সে নয়, এটা অন্য কেউ তার জায়গায়। এই দেখা-না-যাওয়া, ঠিক অন্যেকে বুঝিয়ে বলা যায় না কিন্তু চলতে-ফিরতে ঘাড়ের ওপর কীসের নিঃশ্বাস পাই, – এই হল টেরর। কিং বলছেন, টেরর লেখা সবচাইতে কঠিন।
র্যাভেনের ‘নেভারমোর’ টেররের জগতের জিনিস।
বললাম, গল্পে পড়বি, ভ্যাম্পায়ার ঘরের ভেতর নিজে থেকে ঢুকতে পারে না। দরজার কাছে, জানলার কাছে এসে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে বলে, “আমাকে ঢুকতে দাও! আসি? …আসি???”
আর মানুষ সেই বরফসাদা মুখের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। সেই হাসি, সেই চাউনি তাকে ভেতরশুদ্ধু গিলে খেয়ে নেয়। সে সাড়া দেয়, “এসো!” – আর তারপর সে মরে। একবারই ডেকে নিতে হয় – তারপর থেকে আর ডাক লাগে না। নিজে থেকেই রাতে রাতে তার গলা থেকে রক্ত চুষে যায় ভ্যাম্পায়ার।
মানুষ যদি নিজে থেকে ডাক না দেবার মতো মনের জোর রাখতে পারে, তাহলে ভ্যাম্পায়ার ঘরে আসতে পারে না। বড় মারাত্মক সেই টান। সেই মনের জোর রাখতে পারে, এরকম মানুষকে ভ্যাম্পায়ার মেরে ফেলতে চায় আগে। নিজে না পারুক, তার ভৃত্যকে দিয়ে সে এইধরনের মানুষকে আগে হত্যা করে, কারণ এর ভেতরে অন্ধকারের বাসা দুর্বল, এর ভেতরে আগুন আর আলো আছে। বাকিরা সব চলে আসবে। কিন্তু একে যদি না মারে, এই লোক কোনোদিন ক্রস নিয়ে কাঠের ফলা নিয়ে ভ্যাম্পায়ারের কফিন খুলে তার বুকে সেই ফলা বসিয়ে দিতে পারে।
মানুষের এই যে ভেতরকার অন্ধকার, যা থেকে মানুষ পালাতে পারে না। বাইরে থেকে যখন নিশির ডাক আসে তখন যে অন্ধকার মানুষের মনের ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে সেই ডাকে সাড়া দেয়। টেররের উপজীব্য এই অন্ধকারও। এর থেকে দৌড়ে পালানো যায় না, আমরা যত ছুটে যাই, সাথে সাথে সেও চলে আসে।
ক্লাসকে জিগ্যেস করলাম, “তোরা বোধহয় মান্টোর নাম জানিস না।”
“…মান্টোর লেখা নিয়ে কেউ কথা-টথা বলে না বিশেষ। তোদের সাথে তো আরোই নয়, স্কুলে মান্টোকে নিয়ে আলোচনা ভাবাও যায় না। কিন্তু, আমার একটা ইচ্ছে আছে যে তোদের মান্টো শোনাই। কারণ কী জানিস, আমার মনে হয় মান্টো যা লেখে, তা তোরা বুঝতে পারবি। মানে, একথাই সবাই জানে যে মান্টোর লেখা বড়দের লেখা। কিন্তু আমার মনে হয় বড়রা যে নিজেদের মান্টোর শ্রোতা বলে দাবী করে, সেটা মিথ্যে দাবী। সত্যি হলে মান্টো যা নিয়ে লিখেছে সেসব আজকালকার দিনে আর থাকত না। মানুষ বড় হয়ে গেলে কী হয় জানিস, মানুষের ভেতরের বোধগুলো, কেমন একটা শুকিয়ে যেতে যেতে মরে যায়। রোজ যে খুন দেখে তার আর খুন গায়ে লাগে না। রোজ যে রক্ত ঘাঁটে তার আর রক্তে অস্বস্তি লাগে না। বড় হতে হতে মানুষ এত বেশী মার খায় আর সাঁতরে ফেলে এত বেশী কাদা, যে তার আর মানুষের মতো চিন্তা করার মন থাকে না।”
“কিন্তু তোরা। নাইনে উঠে গেছিস, যা জানার তা সবই জানিস এই বয়সে। যা বোঝার তা বুঝবিও, যত দিন যাবে। কিন্তু বুঝেও নির্লিপ্ত থাকার বয়সটা তোদের এখনো আসেনি। তাই আমার ইচ্ছে, তোদেরকেই মান্টো শোনাবো। শোনানোটা দরকার। হ্যাঁ, সত্যিই এটা ‘ছোটোদের জিনিস’ নয়। কিন্তু তোরাও আর ছোটো কোথায়। পৃথিবীতে কেউ তো আর ছোটো নেই এখন। আসিফার কথা তোদের নিশ্চয়ই এখনো মনে আছে, ওর রেপিস্টরা ছাড়া পেয়ে গেছে প্রমাণ নেই বলে। ছোটো আর কে?”
অডিও-স্টোরি শোনানোর প্ল্যান ছিল। ওদেরকে পার্টিশন নিয়ে আর মান্টোর লেখার বিষয় নিয়ে যা সামান্য জানা ছিল, বললাম। তারপর প্লে করলাম “খোল দো”।
– গল্পের যে জায়গাটায় জোয়ান ছেলেগুলো সিরাজুদ্দীনের সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার সময় “মিল যায়গা, – মিল যায়গা!” বলে ওঠে, সেখানটায় ক্লাসময় একটা অস্ফুট “অ্যাঁ!” শোনা গেল। যাবেই। ওরা এখনো সিরাজুদ্দীন। ওদের অবাক লাগবেই।
তারপর গল্প শেষ হল।
পিরিয়ডও শেষ হল তারপর, আরো বেশ কয়েক মিনিট বাদে। ‘খোল দো’ নিয়ে একটুখানি কথাও হল তারপর, ওরা আর কী বলবে, আমিই বলে গেলাম খানিকক্ষণ। ছেলেতে-মেয়েতে মেশানো ক্লাস, গল্পে নিজেদের সম্ভাবনার ছায়া ওরা সবাইই দেখতে পেয়েছে। কিন্তু এই ছায়া তো আর আগে ওদের কেউ দেখায়নি।
মান্টোসাহেব তো সেই পঞ্চান্ন সালেই বিয়াল্লিশ বছর বয়েসে মরে গেছেন। কিন্তু ভ্যাম্পায়ারগুলো যে মরে না। যে জন্য বেচারা মান্টোসাহেব মরলেন, সেই গল্পগুলো পড়ে অবধি তার দায় কীভাবে মেটাই, ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে সেই চিন্তায় আছি।