ভাস্কর্য

পোস্টটা করার আগে একটু ইনট্রো দরকার।

একটা গল্পে ছিল এক ভাস্করের কথা। শ্বেতপাথর খোদাই করে অসামান্য মূর্তি তৈরী করেছেন। একজন তা দেখে জিজ্ঞেস করছে, এমন অপূর্ব জিনিস সৃষ্টি করেন কী করে? উত্তরে ভাস্কর বলছেন, আমি তো সৃষ্টি করিনি, মূর্তি তো আগে থেকেই ছিল, ওর ভেতরেই; আমি শুধু ছেনি দিয়ে বাড়তি পাথরের আবরণটুকু সরিয়ে দিয়েছি। 

স্কাল্পচার বা ভাস্কর্যের এটা একটা বিশেষ দিক। ‘গড়ে তোলা’-র চেয়ে ‘উন্মোচিত করা’-র ওপরেই সে গুরুত্ব দেয় বেশী। এখানে যে জিনিসটা দেখব, সেটাও একটা স্কাল্পচার। পাথর বা অন্য জড় মাধ্যমের বদলে এটার প্রকাশ জীবন্ত শরীরে। ডাকনাম বডি-স্কাল্পটিং। একে বডিবিল্ডিংও বলে, কিন্তু বডিবিল্ডিং শব্দটা মিসলিডিং। 

একটা প্যান্থারের শরীর আর একটা মানুষের শরীরের মধ্যে তফাত কী? মানুষ যেহেতু বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে বৌদ্ধিক প্রাণী, তাই আজকের দিনে গড়পড়তা মানুষের শরীর অপটিমাম লেভেলে গড়ে ওঠে না। স্বাভাবিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গেলেও আমাদের নিয়মিত ব্যায়াম করতে হয়। বাঘের বেলায় এটা নেই। সেডেনটারি বাঘ বলে কিছু হয় না। মানুষের পার্ফেক্ট ফিজিক্যাল স্পেসিমেন খুঁজতে গেলে আমাদের অলিম্পিক অ্যাথলিটদের মধ্যে খোঁজ করতে হবে। বাঘের বেলায় তার দরকার নেই। সব বাঘকেই অ্যাথলেটিক হতে হয়, যেমন হতে হয় সব কাককেই, বা সব বাইসনকেই। 

বডি-স্কাল্পটিং-এর লক্ষ্য হল পার্ফেক্ট হিউম্যান ফিজিক। ওস্তাদদের ভাষায়, the human body at its most athletic and aesthetically pleasing. লক্ষ্যণীয়, শুধু এসথেটিকালি প্লিজিং নয়; সেটা হলে অনেকেই বলতে পারত যে আমার একটু মোটাসোটা চেহারাই সুন্দর লাগে। কিন্তু এখানে সেকথা হচ্ছে না। 

এটা চালু করেছিল গ্রীকরা। গ্রীক সভ্যতায় ক্রীড়াবিদরা একটা আলাদা শ্রেণীর মতো ছিলেন, যাঁদের বলা যায় ফিজিক্যাল এলিট। খেলাধূলা, শরীরচর্চাকে গ্রীকরা ভীষণ সম্মান করত। শরীর নিয়ে কোনো শুচিবাই ছিল না, তারা মনে করত যে সুগঠিত শরীর একটা শিল্পোত্তীর্ণ এবং দর্শনীয় জিনিস, শরীরচর্চার সময় গায়ে জামাকাপড় রাখা অর্থহীন এবং অবাঞ্ছিত। জিমনাসিয়াম কথাটা যা থেকে এসেছে – সেই gymnós শব্দের মানেই হল নগ্ন। গ্রীক জিমনাসিয়ামে কেউ জামা পরে ব্যায়াম করত না। সেযুগের অলিম্পিকেও যারা অংশ নিত, তারাও নগ্ন হয়েই প্রতিযোগিতায় নামত। 

আর ঠিক এই কারণেই মেয়েদের অলিম্পিকে যোগ দেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। 

গ্রীকরা আর পাঁচটা সভ্যতার তুলনায় কিছু কম পুরুষতান্ত্রিক ছিল না। তাই তাদের দার্শনিকরা, শিল্পীরা, ক্রীড়াবিদরা যখন মানুষের শরীরকে এক্সপ্লোর করছেন, তার ‘এসথেটিক আইডিয়াল’ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন, হেরাক্লেস একিলিস জেসন ইত্যাদি মহাবীরদের কাহিনী লেখার পাশাপাশি তাদের মূর্তি গড়ছেন সেই অ্যাথলেটিক আইডিয়াল মাথায় রেখে, তখন এই পুরো গল্পটায় তাঁরা মেয়েদের কোনো ঠাঁই দেননি। 

তাই আধুনিক যুগেও যখন বডিবিল্ডিং শুরু হল, তখন প্রথমদিকে মেয়েরা সেখানে অপাংক্তেয়ই থেকে গেল। কয়েক দশক লাগল মেয়েদের সেখানে ‘অনুপ্রবেশ’ করতে। আজকের দিনেও মহিলা বডিবিল্ডাররা পুরোপুরি সমাদৃত নন, সম্মানের চেয়ে তাদের ভাগে বিদ্রূপ আর ঘৃণাই বেশী পড়ে, কিন্তু তাও গ্রীকদের তুলনায় আজ আমরা অনেকদূর এসেছি।

বডিবিল্ডিং শব্দটা যদিও মিসলিডিং। কারণ শুধুমাত্র কে কত বেশী পেশী জমা করল, সেটা এর প্যারামিটার নয়। শুধু muscle size বা muscle mass নয়, তার সাথে সমান সাবধানে বজায় রাখতে হয় নিখুঁত সিমেট্রি আর প্রোপোরশন। এটাই কঠিন। বিশালদেহী হওয়াটা তেমন কিছু নয়, প্রচুর খেলে আর প্রচুর ডামবেল ভাঁজলে যে কেউ বিরাট শরীর বাগিয়ে ফেলতে পারে। কাজটা কঠিন হয় তখনই যখন কেউ চেষ্টা করে ‘এসথেটিক আইডিয়াল’ আনার। হাল্ক আর ক্যাপ্টেন অামেরিকার শরীরের মধ্যে তফাৎ কী? সেই একই তফাৎ এতেও। 

খুব মেপে খাওয়াদাওয়া করে, খুব মেপে ব্যায়াম করে, খুব মেপে বিশ্রাম নিয়ে – তবে ওই আইডিয়ালে পৌঁছনো যায়। তাও তো সবাই ফার্স্ট প্রাইজ পান না, কারণ জেনেটিকালি সবার শরীরের প্রোপোরশন এক নয়। কাঠামোটা তো আর বদলায় না। আর্নল্ড যে আর্নল্ড হয়েছিলেন, তার পেছনে প্রথমত ছিল ভালো কাঠামো। এবং তারপর প্রাণপাত পরিশ্রম। 

 এইজন্যে যাঁরা বডিস্কাল্পটিং করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা টিপিক্যাল ‘মীটহেড’ নন। একধরনের শিল্পীই। ক্যানভাস তাঁদের নিজের শরীর। পার্থক্যের মধ্যে এই শিল্পকর্ম টানা মেনটেন করে যেতে হয়। শেষ আঁচড় বলে কিছু নেই। কন্টিনিউয়াস আঁকা চালিয়ে না গেলেই ছবি নষ্ট হয়ে যাবে। 

————————————————————————————————–

 লোকে কয়েকটা জিনিসে গোলমাল করে ফেলে। 

বডিস্কাল্পটিং-এর প্রধান লক্ষ্য কিন্তু শারীরিক শক্তিবৃদ্ধি নয়। শারীরিক শক্তিবৃদ্ধি তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কারণ ব্যায়াম করলে গায়ের জোর বাড়বেই। কিন্তু সেটা মূল লক্ষ্য নয়। এখানে স্পেশালাইজেশনের ব্যাপার থেকে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে ফিজিক্স জানতে হয়, কিন্তু ফিজিক্স পড়া আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া এক কথা নয়।

বডিস্কাল্পটাররা যখন কম্পিটিশনের আগের রাতে স্টেজে ওঠেন, তখন তাঁরা শারীরিক রূপের দিক থেকে (রূপ বলতে ফর্ম, নট বিউটি) পীক ফর্মে থাকেন। কোনো বাড়তি ফ্যাট থাকে না, এমনকি কোনো বাড়তি জলও শরীরে থাকে না। পরপর কয়েকদিন ধরে ডায়েট করে তাঁরা একরাতের জন্য শরীরকে এই অবস্থায় নিয়ে যান। একে বলে ‘Competetion shape’ – এঁরা প্রতি দিনের হিসেব মেপে এগোন, 7 days from competiton, 6 days from competition, 5 days from competiton ….  অ্যান্ড সো অন। ফাংশানালিটির দিক থেকে দেখলে কোনোভাবেই এটা একটা শরীরের পীক ফর্ম নয়। শরীর সবসময় খানিকটা বাড়তি ফ্যাট, খানিকটা বাড়তি জল জমিয়ে রাখে, ইমার্জেন্সির জন্য। তাই বডিবিল্ডিং আর পালোয়ানীর মধ্যে গোলাবেন না। একটা বিশুদ্ধ ভিজ্যুয়াল আর্ট; অন্যটা ফাংশানাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *