সপ্তম অংশ
“অমানুষ”
“There must have been a moment, at the beginning, where we could have said — no. But somehow we missed it.”
ছোটো থেকে পড়েছি, মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। কিন্তু এর মধ্যে একটা অদ্ভুত মজা আছে যেটা ছোটবেলায় চোখ এড়িয়ে যেত। গোষ্ঠীর কনসেপ্টটা একাধারে ইনক্লুসিভ এবং এক্সক্লুসিভ। একদিকে যেমন কয়েকজন মানুষ দল বেঁধে একটা গোষ্ঠী তৈরী করে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অন্য যেকোনো কাউকে দূরে ঠেলে রাখার একটা জোটবদ্ধ মানসিকতা সমানভাবে কাজ করে। নিজের দলের বাইরেকার যেকোনো এলিমেন্টকে যথাসম্ভব এলিয়েনেট করা মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। এটা আছে বলেই আমাদের হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতি জীবজগতে এত কম সময়ের মধ্যে এতখানি সাফল্য পেয়েছে। এই স্বভাবেরই আলাদা আলাদা অভিব্যক্তি আমাদের বর্ণবৈষম্য, জাতিবিদ্বেষ, জাতীয়তাবাদ, জিঙ্গোইজম।
স্কুলে থাকতে এই জিনিসটা প্রকাশ পায় গ্রুপবাজি আর গ্যাংবাজির আকারে। ‘গ্যাং’ কথাটা খারাপ অর্থে বলছি না। এই ধরনের গ্রুপে অনেকসময়েই নিজেদের মধ্যে খুব শক্ত ক্যামারেডারি থাকত, নিজেদের মধ্যে আলাদা রকম বন্ডিং, আলাদা রকম বোঝাপড়া থাকত। ‘গ্যাং’ প্রয়োগ করলাম সেই অর্থে, যাকে ইংরেজীতে বলে ‘thick as thieves’। – এরকম বেশ কয়েকটা গ্যাং আমাদের ক্লাসেও ছিল। একেকটা গ্যাং একেকরকম।
সবচেয়ে পুরোনো ছিল ‘Y2K গ্যাং’। এটা মোটামুটি ফোর-ফাইভে থাকতেই ফর্ম করেছিল। এই সিরিজের একদম গোড়ায় যে মস্তানমার্কা ছেলেদের কথা বলেছিলাম, তাদের গ্যাং ছিল এটা। সবাই ইংলিশ মিডিয়াম, চালচলন একটু অন্যরকম। এই গ্যাং শুরু হয়েছিল যাদের হাতে তারা মূলত ছিল অবাঙালী, বিহার-মুজফ্ফরপুরের ওদিককার ছেলে। কেউ কেউ বলত ‘বিহারী গ্যাং’। এদের চরিত্র মোটের ওপর সরল, – এদিকে ওদিকে মস্তানি আর হালকা তোলাবাজি (‘তোলা’ বলতে স্টক) করা, খেলার মাঠের পলিটিক্সটা কন্ট্রোল করা, ব্যাস। এর বেশী সফিস্টিকেশন এদের ছিল না।
সফিস্টিকেটেড ছ্যাঁচড়ামো দেখা গেল আরেকটু উঁচু ক্লাসে উঠে। এটাও একটা গ্যাং, তবে গুণ্ডা গ্যাং নয়। এর মধ্যে যারা ছিল তাদের স্বভাবটা খানিকটা ফেউয়ের মত, নিজেরা প্রেডেটর না হলেও একরকম শকুনবৃত্তি করে এরা সময় কাটাত। ক্লাসের যে ছেলেরা একটু মার্জিনালাইজড, একটু অন্যরকম, যাদেরকে দল বেঁধে হাসির খোরাক করা সোজা, তাদের পেছনে লাগত এই ছিঁচকে মস্তানের দল।
ক্লাসে প্রেম-টেম তো আকছার লেগে থাকত। এবার, প্রেমে পড়ার মত ছেলে তো তত বেশী নেই, মেরেকেটে হয়তো দশ পনেরোজন মিলবে যারা খবরের কাগজের ভাষায় ‘প্রকৃত সুন্দরী’। যারা প্রেমে পড়ছে সবাই এই কয়েকজনের প্রেমেই পড়ছে। এবং তাদের মধ্যে যারা এলিজেব্ল, সফলভাবে জুটি বাঁধতে পারছে কেবলমাত্র তারাই। সপ্তর্ষি সেনের রূপ দেখে স্বরাজ মিত্র আর সুধীর পাত্র দু’জনেই মজে থাকতে পারে, কিন্তু গোল তো করবে স্বরাজ মিত্রই। কারণ সুধীর পাত্র দেখতে আদৌ ভালো নয়, মোটা বলে তাকে বন্ধুরা ‘গোলাকার পাত্র’ বলে খ্যাপায়, বেঙ্গলী মিডিয়ামের ভেতো স্বভাবের ছেলে সে। – সুধীর পাত্র কোনোদিন কারো কাছে কনফাইডই করবে না যে সে মনে মনে সপ্তর্ষিকে চায়। পারলে নিজের কাছেও নয়।
কিন্তু যদি দৈবাৎ কখনো এরকম কোনো গ্ল্যামারবিহীন সুধীর পাত্র-মার্কা ছেলে সপ্তর্ষি সেনের মতো কোনো ডিভার প্রেমে পড়ে যেত, তাহলে হয়ে যেত মুশকিল। মুশকিল আরো কারো না, মুশকিলটা হত সুধীর পাত্রের। শুধু এজন্য নয় যে সে প্রেমের প্রতিদান পাবে না, – প্রতিদানের আশা তো কোনোদিনই ছিল না, – নেহাত প্রেমে পা পিছলে গেছে, বেচারি সামলাতে পারেনি। – সেসব না, মুশকিলটা বাধাত ছিঁচকে গ্যাং।
ছিঁচকেরা এরকম পরিস্থিতিতে প্রথমেই খবরটাকে মশলা দিয়ে মুখরোচক করে ক্লাসে ভালো করে ছড়িয়ে দিত। তারপর লেগে যেত ক্রিয়েটিভিটিতে। বেশ কয়েক স্ট্যানজা লম্বা ছড়া লেখা হত, এবং তারপর তাতে সুরারোপ করে গান। এই ছড়া এবং গান লেখার জন্য বাঁধা এক্সপার্ট ছিল। তারপর সেই গান গেয়ে, প্যাঁক দিয়ে, টোন কেটে, গুজব রটিয়ে, কয়েকদিনের মধ্যে সুধীরের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হত। রস পুরোনো হয়ে গেলে আস্তে আস্তে উৎসাহ মিইয়ে যেত, হয়তো ততদিনে অন্য টার্গেট পাওয়া গেছে। একবারে নিষ্কৃতি মিলবে না, হয়তো সুধীর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, ছিঁচকে গ্যাং সেটা দেখতে পেল। তারপর কোনো একটা গাছের দিকে তাকিয়ে, ঠিক সুধীরের কানে যাতে যায়, সেইভাবে একটা বাছাই লাইন আওড়াতে আওড়াতে বেরিয়ে গেল। কাটা ঘা যেখানে কাঁচা আছে সেখানে ওইটুকু নুনের ছিটেই যথেষ্ট।
স্কুলের নিত্যনৈমিত্তিক ইয়ার্কি আর হাসাহাসির থেকে এই জিনিসটা আলাদা ছিল এইজন্যে যে এই পুরো ব্যাপারটা একটা নির্দিষ্ট দল মাথা খাটিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে রেগুলেট করত। এদের শিকারের বাছবিচার তেমন ছিল না, এরা ক্লাসের ল্যাবাদের নিয়েও যেমন ছড়া বাঁধত, তেমন গুণ্ডাদের নিয়েও টিটকিরি শানাত। কিন্তু গুণ্ডাদের বেলায় সামনাসামনি কিছু করত না, আর ল্যাবাদের বেলায় চান্স পেলেই খোঁচা লাগাত। এদের সবচেয়ে বড় যে কীর্তিটা দেখেছিলাম ক্লাস সিক্সে থাকতে, আজকে সেই কথা বলব।
সিক্সে আমাদের ক্লাসে এক নতুন ছেলে ভর্তি হল, নাম অসীম ব্যানার্জী। ছেলেটা কেমন যেন আজব টাইপের, দেখে মনে হয় মাথা খারাপ। তাকানোর ভাব, কথা বলা, মেশার ধরন, সবটাই অদ্ভুত। অদ্ভুত বলতে হাস্যকর ধরনের অদ্ভুত। পাগল বলে খ্যাপানো আমাকেও হত, কিন্তু এ অন্য জিনিস। নিজের চালচলনের ওপর কন্ট্রোল নেই, জিনিসপত্র জায়গামত রাখতে পারে না। স্নান করতে পারে না ঠিক করে, পায়খানা গিয়ে পরিষ্কার হয়ে আসতে পারে কিনা তার কোথাও কোনো গ্যারান্টি নেই। মূর্তিমান ঝঞ্ঝাট, দেখলেই আলগা বিতৃষ্ণা আসে। আর যত দেখি তত ধারণা বদ্ধমূল হয় যে এ ছেলের প্রবলেম আছে। এ মনে হয় সত্যি সত্যিই অ্যাবনর্মাল।
অসীমের সত্যিই একটা অ্যাবনর্মালিটি ছিল। সেটা আমরা জেনেছিলাম পরে। কিন্তু বারো বছর বয়সের হস্টেলজীবন তো আর মানবিকতার তোয়াক্কা করে না। অসীমের বাবা ছিলেন কলকাতায় ইংরেজীর প্রফেসর, রামকৃষ্ণ মিশনের ভরসায় ছেলেকে বিদ্যাপীঠে দিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে পুরুলিয়ার রেসিডেন্শিয়াল স্কুলে এসে অসীম একেবারে অথৈ জলে পড়ত। কিন্তু সেই সময়ে হঠাৎ এসে হাল ধরলেন স্নেহাশিসদা।
আমরা শুনলাম, আমাদের ইংরেজী পড়ান যে স্নেহাশিসদা, সেই স্নেহাশিসদা নাকি এই অসীমের বাবার ছাত্র।
এটা ড্রামাটিক ডেভেলপমেন্ট। আমরা সিক্সে পড়ি, খবর সব জানতে পারি না, যেটুকু শুনি সেটুকু আবার সবটা বোধবুদ্ধিতে কুলোয় না। আমরা মোটের ওপর আইডিয়া পেলাম, অসীমের বাবা খুব বড়, খুব ভালো ইংলিশের প্রফেসর। স্নেহাশিসদা কলেজে থাকতে অসীমের বাবার ছাত্র ছিলেন। অসীমের নাকি ছোটোবেলায় কী একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, সেই থেকে নাকি অসীম এরকম হয়ে গেছে। এখন বিদ্যাপীঠে স্নেহাশিসদা আছেন, অসীমের বাবা তাই আরো বেশী করে ভরসা পেয়ে ছেলেকে এখানে দিয়ে গেছেন, স্নেহাশিসদাকে বলে গেছেন যেন উনি একটুখানি খেয়াল রাখেন। আলাদা করে স্পেশাল পাহারাদার বসিয়ে যাওয়ার মত খেলো লোক উনি নন, শুধু অনুরোধ করে গেছেন, মানসিকভাবে অশক্ত ছেলের যদি কোনো বিশেষ অসুবিধে হয়, স্নেহাশিসদা যেন একটু সাহায্য করেন।
অসীমের ব্যাকগ্রাউন্ড আমরা জানলাম। মনে মনে ইস বলে মাথাও নাড়লাম। কিন্তু শকুনদের তাতে নিবৃত্তি হল না।
আমার মনে আছে ব্যাপারটা কীরকম সাজানো হয়েছিল। ছিঁচকেদের গ্যাং-এ ছিল রমেশ দাশ, তমাল পাল, বিজন বোস, আরো দু’একজন। এরা প্রথমেই অসীমের সঙ্গে বেশ পিঠ-টিট চাপড়ে ভাব জমিয়ে নিল। ভাব বলতে ঠিক মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব হলে যেরকম হয় সেরকম নয়। এরা অসীমকে দেখত একটা মজাদার পোষা প্রাণীর মতো। “অসীম, জিভ দিয়ে নাক টাচ কর তো!” “অসীম, বাস কীরকম আওয়াজ করে যায় করে দ্যাখা তো!” “আর অটো?” “আর ট্যাক্সি??” ” এই তমাল এদিকআয়না জলদি – অসীম জিভ দিয়ে নাক টাচ করাটা দেখা দেখা আরেকবার!” — এরকম চলতে থাকত। অসীম উৎসাহের সাথে যা ফরমায়েশ পেত তাই করে দেখাত, ক্লান্ত হলেও বোঝা যেত না। ওর মনে হত ওকে সবাই মিলে খুব খাতির করছে।
তারপর শুরু হল অসীমকে পাঁঠা করে স্যারদের কাছে পাঠিয়ে ফাঁসানো। অসীম ততদিনে রমেশদের কাছে কেনা হয়ে গেছে, যা বলা হবে তাই মানবে। ওকে বুঝিয়ে দেওয়া হত, – ঠিক যেমনি যেমনিভাবে বলছি সেইভাবে করবি, যেরকম শিখিয়ে দিচ্ছি সেইরকমভাবে বলবি। আর স্যার যতই জিজ্ঞেস করুক কিছুতেই বলবি না কে বলেছে। যদি কখনো অসীমের তরফে একটুও দোনামোনা দেখা যেত, একবার চোখ পাকিয়ে কড়কানি দিলেই সেসব ম্যানেজ হয়ে যেত, তারপর আবার পিঠ চাপড়ে উৎসাহপ্রদান।
স্নেহাশিসদার ক্লাসেও এটা করার চেষ্টা হয়েছিল বারকয়েক। ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে কড়া বলে স্নেহাশিসদার নাম ছিল, তাই চেষ্টা হত যদি অসীমকে ফাঁসিয়ে সবাই মিলে একটু রগড় দেখা যায়। প্রবলেমটা হল স্নেহাশিসদা ছাত্রদের এইসব বদমায়েশি ভালোই টের পেতেন। নিজেও বিদ্যাপীঠেরই ছাত্র ছিলেন, হস্টেললাইফের পাল্স বিলক্ষণ জানা ছিল। তাই অসীম কোনো বেচাল করে ফেললেও তার চোটটা অসীমের ওপর ফেলতেন না। এবং এসব ক্ষেত্রে ইন্টারোগেট করে বিশেষ লাভ হয় না জেনে সবসময় খুব একটা খোঁচাখুঁচিও করতেন না।
একটা দিনের কথা ছবির মতো মনে পড়ে। ডিসেম্বরের শেষ, সারদা মন্দিরে স্কুল একজিবিশন চলছে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ঘরটায় দাঁড়িয়ে আছি। দেয়ালে সারি সারি চার্ট, গার্জেনরা ঘুরে ঘুরে সব দেখছে, ডেমনস্ট্রেটররা বোঝাচ্ছে। অসীম ওর বাবার সাথে দাঁড়িয়ে দেখছে একটা চার্ট। হেডিং-এ লেখা, “আ শেক্সপীয়রিয়ান স্টোরি।” তাতে শেক্সপীয়রের নাটকগুলোর নাম ব্যবহার করে একটা সংলাপের মত করে লেখা। একেকটা সাজানো প্রশ্ন, আর তার উত্তর হিসাবে একটা করে নাটকের নাম। অসীম তাকিয়ে আছে, আর ওর বাবা রীড অ্যালাউড করে ওকে শোনাচ্ছেন। আমি কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আড়ি পেতে ওর বাবার পড়া শুনছিলাম। “A Midsummer Night’s Dream” কথাটুকুকে অত সুন্দর করে অতটা বাঙ্ময়ভাবে পড়া যায়, শুনে এত নাড়া খেয়েছিলাম যে এখনো আবছা আবছা মনে আছে। সেই আড়ি-পাতা আমার জীবনের প্রথম শেক্সপীয়র ক্লাস।
অসীম বিদ্যাপীঠে থাকেনি। চলে গিয়েছিল সেই বছর* শেষ করেই। ওর পক্ষে বিদ্যাপীঠে থাকা সম্ভব ছিল না। আমাদের হেডমাস্টার মহারাজ মাঝে মাঝে অ্যাসেম্বলিতে বলতেন, – এই বিদ্যাপীঠ একটা পরিবার, তোমরা সবাই সেই পরিবারের অংশ; শুধু আজ নয়, চিরদিনের জন্য তোমরা বিদ্যাপীঠ-পরিবারের অঙ্গ হয়ে থাকবে।
অসীমদের কথা মনে পড়লে কখনো কখনো ভাবি, বিদ্যাপীঠ পরিবারের অঙ্গ হওয়ার জন্য বিদ্যাপীঠে ভর্তি হলেই হয়, নাকি বিদ্যাপীঠ থেকে ভালো রেজাল্ট করে বেরোনোটাও দরকার – এই প্রশ্নের জবাবটা আজও অজানা থেকে গেল।
********
*সংশোধন: অসীম সিক্সে বিদ্যাপীঠ ছেড়ে যায়নি, গিয়েছিল সেভেনে। এক বন্ধুর থেকে কনফার্মেশন পেয়ে এখানে জুড়ে দিলাম।
(আগামী অংশে সমাপ্য)