নীল-কালো (৮)

অষ্টম অংশ

“নীল”

“There is no document of civilization that is not also a document of barbarism.”

সিরিজ শুরু করার সময় লিখেছিলাম, ‘স্কুললাইফে যত ভায়োলেন্স আর নিষ্ঠুরতার গল্প চাপা থাকে, স্মৃতিচারণের সময় আমরা সেগুলোকে খুব একটা ভেসে উঠতে দিই না।’

তারপর যেসব ঘটনা নিয়ে একেকটা পর্বে কথা হয়েছে, সেগুলোর সবই বিভিন্নরকমের বুলিইং-এর ঘটনা। শারীরিক, মানসিক, – স্কুলে থাকতে নানারকম উৎপীড়ন বাচ্চাদের সহ্য করতে হয়, – এবং তার একটা বড় অংশ আসে সহপাঠীদের তরফ থেকে। বিদ্যাপীঠে আমরা আমাদের সহপাঠীদের সঙ্গে কীরকম অপব্যবহার করতাম, তা নিয়ে একেকটা পর্বে কথা হয়েছে।

সিরিজের শেষে এসে এমন একটা বিষয়ে হাত দিতে হচ্ছে যেটা ঠিক এই পর্যায়ে পড়ে না। নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, এই সিরিজে এই প্রসঙ্গ তোলা ঠিক হবে কি না। কিন্তু ভেবে দেখলাম, বিষয়টা ঠিক বুলিইং না হলেও, অন্য একরকম ভায়োলেন্স বটে। সেটার কথা একেবারে না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

আমাদের বিদ্যাপীঠ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠান। মিশনের সাধুরা প্রতিষ্ঠান চালান। আমাদের বেড়ে ওঠা যেসব মূল্যবোধকে ঘিরে, সেসব রামকৃষ্ণ মিশনেরই মূল্যবোধ। এই সিরিজে অনেকে মন্তব্য করেছে (সিংহভাগ আমাদেরই স্কুলতুতো ভাই) যে এই সিরিজটার প্রয়োজন ছিল। – এই যে সত্যকে স্বীকার নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করা, এই মূল্যবোধও অনেকাংশেই বিদ্যাপীঠ থেকেই পাওয়া।

কিন্তু ব্রহ্মচর্যধর্মী রামকৃষ্ণ মিশনের মধ্যেও এমন কিছু চোরা অসুখ ছিল, যা আমাদের স্কুলজীবনের সঙ্গে লতায়-পাতায় জড়িয়ে যেত। এই অসুখ রামকৃষ্ণ মিশনের একার সমস্যা নয়, ক্রিশ্চান ক্যাথলিক চার্চের দীর্ঘ চাইল্ড অ্যাবিউজের ইতিহাস পৃথিবীতে কুখ্যাত। আমাদের বিদ্যাপীঠ আবাসিক ছিল, এবং একই সঙ্গে একই ক্যাম্পাসে দিন-রাত সকাল-সন্ধ্যা সবাই মিলে পার করতাম বলে এ সমস্যার থেকে আমরাও একেবারে নিরাপদ ছিলাম না।

কিন্তু সেই কথা বলার আগে অন্য আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন। আমরা কিন্তু এখানে পিডোফিলিয়া নিয়ে কথা বলতে বসিনি।

যদি কেউ আপনার সঙ্গে কেউ কখনো পাদ্রীদের ‘পিডোফিলিয়া’ নিয়ে আলোচনা করতে চান, প্রথমেই তাকে থামিয়ে দেবেন। কারণ চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজ আর পিডোফিলিয়া এক জিনিস নয়।

পিডোফিলিয়া একধরনের মানসিক বৈশিষ্ট্য যা কারো মনে বাচ্চাদের প্রতি যৌন আগ্রহের জন্ম দেয়। এটা একধরনের প্যারাফিলিয়া, – অর্থাৎ ভিন্নধর্মী যৌন রুচি। যে পিডোফাইল, সে শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে, যেরকম সাধারণ হেটেরোসেক্সুয়াল পুরুষ অনুভব করে নারীর প্রতি। এই যৌন আকর্ষণের অবস্থান পিডোফাইল মানুষের মনে, – এটা তার মানসিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মনে মনে শিশুশরীরের প্রতি যৌন টান থাকলেই যে একজন সেই টানে পড়ে কোনো শিশুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করবে, এমন নয়।

অন্যদিকে, চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার সে, যে শিশুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। ধর্ষণ করেছে না কনসেনসুয়াল সেক্স করেছে সে প্রশ্ন অবান্তর, কারণ যেহেতু অন্যপক্ষ শিশু, তাই তার কনসেন্টের কোনো দাম নেই। একে আইনের ভাষায় বলে স্ট্যাচুয়েটরি রেপ, সংক্ষেপে স্ট্যাচ রেপ। – যে লোক চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার, তার কিন্তু চাইল্ডের প্রতি যৌন আকর্ষণ না-ই থাকতে পারে। সাধারণ ধর্ষণের বেলায় যে দেখা যায়, একেবারেই কোলের শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, অথবা সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, – এগুলো কোনোটাই কিন্তু যৌন কামনার অভিব্যক্তি নয়। ধর্ষণ জিনিসটাই আসলে যৌন ক্রিয়া নয়। ধর্ষণ ভায়োলেন্সের প্রকাশ, সেক্সুয়ালিটির নয়। – যে লোক নাবালকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করছে, সে যে সবসময় যৌন আসক্তির থেকে তা করছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই সে সেটা করছে নাবালককে সহজে শিকার বানানো যায় বলে। অনেক ক্ষেত্রেই সে সেটা করছে এইজন্য যে প্রকৃতপক্ষে যে জিনিসের প্রতি তার যৌন আকর্ষণ, তার যোগান হাতের কাছে নেই। হাতের কাছে যাকে পাচ্ছে, তাকে সাবস্টিটিউট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র।যে পিডোফাইল, সে কোনো বাচ্চার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। অন্যদিকে যে চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার, তার পিডোফিলিয়া থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। কিছু পিডোফাইল থাকে যারা চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার; আবার কিছু চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার থাকে যারা পিডোফাইল।

অনেক পিডোফাইল আছেন যাঁরা চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার নন। এবং বহু চাইল্ড-সেক্স-অ্যাবিউজার আছে যারা পিডোফাইল নয়, সাধারণ হেটেরোফাইল।

পিডোফিলিয়া নিয়ে আলোচনা করব না বলেছিলাম, – সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙছি না। কিন্তু পরে কাজে লাগবে বলে একটা জিনিস দিই। টেকনিক্যালি পিডোফিলিয়ার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করতে গিয়ে ‘ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিজঅর্ডারস’ বলছে –

A. Over a period of at least 6 months, [the person has had] recurrent, intense sexually arousing fantasies, sexual urges, or behaviours involving sexual activity with a prepubescent child or children (generally aged 13 years or younger);
B. The person has acted on these sexual urges, or the sexual urges or fantasies cause marked distress or interpersonal difficulty; and
C. The person is at least 16 years and at least 5 years older than the child or children in Criterion A.

এর সঙ্গে যোগ করতে হবে যে ‘পিডোফাইল’ বলতে শুধু সেই বাচ্চাদের প্রতি আকর্ষণই বোঝানো হচ্ছে যাদের শরীরে যৌবনোদগম হয়নি। যৌবনোদগম বা পিউবার্টি এসেছে, এমন বাচ্চাদের প্রতি কারো আকর্ষণ থাকলে তাকে বলা হবে ‘হেবেফাইল’। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ২০০৩ সালের এক গবেষণাপত্রে এক বিজ্ঞানী বলেছেন, এই শ্রেণীবিভাগগুলো বাস্তবপক্ষে বাচ্চার বয়সের ভিত্তিতে করা চলে না, করতে হয় বাচ্চার বডি টাইপ এবং বিল্ডের ভিত্তিতে। তার মানে, যদি কোনো পিডোফাইল চাইল্ড-সেক্স-অফেন্ডারের কোনো বিশেষ এজ-গ্রুপের প্রতি পক্ষপাত থাকে, তাহলে সেই পক্ষপাতটা আসে সেই নির্দিষ্ট এজ-গ্রুপের টিপিক্যাল বডি টাইপ কীরকম, সেই থেকে। কোনো পিডোফাইল (সেক্স-অফেন্ডার নয়) যদি কোনো এক চাইল্ডকে দেখে যৌন আকর্ষণ বোধ করে, তাহলে সে সেটা করছে চাইল্ডের শারীরিক চেহারা কীরকম তার ভিত্তিতে, – চাইল্ডের বার্থ সার্টিফিকেট চেক করে তার ভিত্তিতে নয়। — এই গোলমালটা বহু ক্ষেত্রে চাইল্ড-সেক্স-অফেন্ডাররা নিজেকে ডিফেন্ড করতে ব্যবহার করে। “কী করে বুঝব ওর বয়স ষোলো? দেখে মনে হয় ওই মেয়ের বয়স ষোলো???” – যুক্তিটা কিন্তু জায়েজ। আপনি নাইটক্লাবের সামনে থেকে একজনকে তুললেন, সে গাড়ি করে আপনার বাড়ি এসে আপনার সঙ্গে কনসেনসুয়াল সেক্স করল। দিব্যি বিশ বছরের মেয়ে, আপনি জানলেন আপনি রেপ করেননি। কিন্তু আসলে যদি দেখা যায় যে মেয়েটার বয়স সতেরো, কিন্তু শরীরের বাড় বেশী বলে আপনি গুলিয়েছেন, তাহলে আপনি পড়ে গেলেন স্ট্যাচ রেপের দায়ে।

সেসব যাক। আমাদের বেলায় ব্যাপারটা কীরকম হত?

ক্যাম্পাসে কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা কিছু কিছু ছেলের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করার চেষ্টা করতেন। এঁদের মধ্যে কিছু ছিলেন সন্ন্যাসী। কিছু ছিলেন অসন্ন্যাসী শিক্ষক কর্মচারী। ব্যাপারটাকে ‘শারীরিক সম্পর্ক করার চেষ্টা’ বললে আসলে ভুল বলা হবে। আমি এক উকিলজেঠুকে চিনতাম, তেনার সাথে বিজয়ার সময় দেখা করতে গেলেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, “কীরে কতটুকু লম্বা হল?” – এইটা কোনোভাবেই ‘যৌন লালসা’ বা ‘শারীরিক সম্পর্ক করার চেষ্টা’ নয়, একধরনের কুরুচিকর, গ্রাম্য রসিকতা মাত্র। কিন্তু পোশাকী রীতি অনুযায়ী এটাও সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ। আমাদের ক্যাম্পাসের যাদের কথা বলছি, তাদের মধ্যে যেমন একজন ছিলেন, মাঝে মাঝে কাউকে ছদ্ম শাসন করতে করতে তার হাফপ্যান্টের তলা দিয়ে লাঠি গলিয়ে দিতেন। এটা রেপ নয়, যৌন উদ্দেশ্যে উৎপীড়নও নয়, কিন্তু উৎপীড়ন। এবং যে করল সে যৌন চিন্তা থেকে না করলেও, যার ওপর করা হল, তার মনে ব্যাপারটা যৌন কালশিটে রেখে যেতে পারে।

সন্ন্যাসীদের প্রসঙ্গে আসি। প্রথমেই যেটা বলে রাখব সেটা হল রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের মধ্যে আমি যত ভালো ভালো মানুষ দেখেছি, তেমনটা সহজে দেখা যায় না। সেসব মানুষের গল্প আজ নয়। এখানে যাদের কথা বলছি তারা ব্যত্যয়, পড়তে গিয়ে যদি কেউ এদেরকে রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের ওভারঅল প্রতিনিধি ঠাওরান তাহলে সেটা সম্পূর্ণ তাঁর প্রবলেম। পুরো রামকৃষ্ণ মিশনে যেমন প্রকৃত শ্রদ্ধার্হ সন্ন্যাসী আজ দুষ্প্রাপ্য, তেমন এদের মতো একেবারে মেরুদণ্ডহীনরাও ব্যতিক্রম। যৌন রিপ্রেশন অনেক সাধুরই থাকতে পারে; কিন্তু তাঁরা সবাই সেই যৌনতার আউটলেট খুঁজতে ছাত্রদের ব্যবহার করেন না। – কেউ কেউ করে।

সরাসরি কোনো মহারাজের সঙ্গে কোনো ছেলের যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, আমাদের ব্যাচে এরকম ঘটনা আমার জানা নেই। আমি জানি আমার জুনিয়র ব্যাচে এ জিনিস হয়েছে, একাধিকবার গল্প শুনেছি। কিন্তু সে গল্প যাদের ব্যাচে হয়েছিল তাদের কলম থেকেই আসবে, আমি লিখব না। আমি অন্য দু’এক কথা বলে সেরে ফেলি।

একজন ছিলেন, তাকে আমরা বলতাম ‘ব্লু বাবা’। আসল নাম অনাবশ্যক, বানানো নামও দিলাম না, এমনিতেই এক জীবনে তিনটে নাম বয়ে বেড়াতে হয়েছে, আর চাপিয়ে দরকার নেই। ‘ব্লু বাবা’ বলতাম কারণ গুজব ছিল মহারাজের ব্লু -ফিল্মের আড়ত আছে। এর কোনো সলিড প্রমাণ আমরা কেউ পেয়েছিলাম বলে জানি না – অন্য কারো জানা থাকলে থাকতে পারে – কিন্তু সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স যাকে বলে, সে জিনিস ছিল প্রচুর। কিছু বাছাই ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করত, অকালে-বিকালে। তাদের প্রতি আলাদা ফেভার ছিল, মাঝেমধ্যে এটা-সেটা খাওয়ানো, প্রতিদিন বিকেলে রুমে ডাকা, ব্যাডমিন্টন খেলা (আমাদের জন্য বিদ্যাপীঠে ফুটবল-ক্রিকেট-ভলি-বাস্কেট-টিটি-ডজবল সব ছিল, কিন্তু ব্যাডমিন্টন ছিল না, এটা মহারাজের পার্সোনাল ইকুইপমেন্ট এবং পার্সোনাল কোর্ট), ‌এসব লেগে থাকত। পার্সপেক্টিভের খাতিরে এখানে বলা দরকার, ‘বিশ্বাসঘাতক’ পর্বে যে চন্দ্রদীপের কথা শুনিয়েছিলাম, সেই চন্দ্রদীপ বড় হয়ে এই ব্লু-বাবার সহচর হয়েছিল। দীনবন্ধুদার ঘটনাটা ঘটে ক্লাস সিক্সে, আর চন্দ্রদীপের সঙ্গে ব্লু-বাবার সখ্যতা হয় এইট-নাইনের আশেপাশে।

ইলেভেন-টুয়েলভে পড়াকালীন এক ব্রহ্মচারী এসেছিল, নাম ধরা যাক রথীন মহারাজ। রথীন মহারাজ গভীর বিদ্রোহী সাধু ছিল, রামকৃষ্ণ মিশনকে ভেতর থেকে উড়িয়ে দেবার জন্য সন্ন্যাসী হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে ইতিহাস নীরব। সে আমাদের ব্যাচের কয়েকজনকে আন্ডার-দ্য-টেব্‌ল পর্নোগ্রাফি সাপ্লাই করত। ততদিনে মোবাইলে ইন্টারনেট এসে গেছে, মহারাজরা ট্যাব-ল্যাপটপ রাখছেন, কাজে এবং অকাজে দুইই। রথীন মহারাজ টরেন্ট দিয়ে পর্ন ডাউনলোড করে ছেলেদের সঙ্গে শেয়ার করত। এ বিষয়ে ছেলেদের কাছে তার কোনো ভনিতা ছিল না। একবার কথায় কথায় বলেছিল, “আরে ভাই এখানে ইন্টারনেটের যা স্পীড, আমি তো টরেন্টে ডাউনলোড দিয়ে জপে বসি! এক ঘন্টা জপ করে এসে তবে দেখি ডাউনলোড হয়েছে।” – এ হেন ব্রিগ্যান্ড চরিত্র সম্পর্কে আপনি কী রায় দেবেন তা আপনার ওপর, মা বলেছিলেন আমজাদও আমার তেমনি ছেলে। রথীন কিন্তু কখনো কোনো ছেলের সঙ্গে শারীরিক সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেনি। সে জিনিস আমরা আবার দেখেছিলাম কলেজে উঠে, সেও রামকৃষ্ণ মিশন, কিন্তু সে অনেক পরের কথা। ততদিনে আমরা খবর পেয়েছিলাম যে রথীন রামকৃষ্ণ মিশন ছেড়ে দিয়েছে।

এখানে একটা খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ্য করবার মত। যেখানে সাবজেক্টের মনের মধ্যে কোনোরকম রিপ্রেসিভ দ্বন্দ্ব নেই, যেখানে সে নিজের যৌন খিদে সম্পর্কে সজাগ এবং অপরাধবোধরহিত, সেখানে কিন্তু সে কোনো ছেলের সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা করতে চাইছে না। সে যেটা করছে সেটাও সেক্স-অ্যাবিউজ – আন্ডার-এজ কাউকে অ্যাডাল্ট কেউ ওভাবে পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট দেখাতে পারে না – কিন্তু সে অ্যাবিউজটাকে শরীরে হাত দেওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে না। সে শুধু তার হাতে পর্ন-ভরা পেনড্রাইভ গুঁজে দিচ্ছে। এটা একরকম মিসপ্লেসড ফ্রেন্ডশিপ বলা যেতে পারে, – রথীনের উচিত ছিল পর্ন-কালেকশনটা তার সমবয়সী কাউকে দেওয়া, তার আধাবয়সী ছাত্রস্থানীয়কে নয়। মিশনের সহকর্মীদের মধ্যে সে তার সোশ্যাল সার্কল খুঁজে পাচ্ছিল না বলেই সে ছেলেদের মধ্যে সেটা খুঁজে নিচ্ছিল। তরুণ টীচারদের মধ্যেও পর্নোগ্রাফির চাহিদা থাকতে পারে, কিন্তু তাদের সঙ্গে সে নিয়ে কথা বলতে গেলে তারা “মহাআরাআজ আপনিইই??” বলে কৃত্রিম একটা নাটক করবে। ছেলেদের মধ্যে সেই হিপোক্রিসি নেই, তারা জানে, আসলে সব গরু ঘাস খায়।

লুকিয়ে গায়ে হাত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে তাদেরই, যারা মন না রাঙিয়ে বসন রাঙাতে বদ্ধপরিকর। তারা না পারে সঙ্গী ধরতে, না পারে গেরুয়া ছাড়তে, – গৃহী হওয়ার দায়িত্ব এড়াতে সন্ন্যাস নিয়ে তাদের সাপের-ছুঁচো-গেলা দশা হয়। স্বামীজী এটা খুব ভালো জানতেন, এবং সেইজন্য বার বার বলেছিলেন, আগে ভোগ কী জিনিস বুঝে নাও; নইলে সারাজীবন পিছু চাইতে হবে। ভোগের মাত্রা পূর্ণ না হওয়া অবধি ত্যাগ করার মতো মন তৈরী হয় না। – আমাদের ব্লু-বাবা যদি মঠে না ঢুকে বিয়ে করত, তাহলে তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতে হত না। কিংবা কে জানে, হয়তো সে সত্যিকারের পিডোফাইল ছিল। বাইরের কোনো কোনো দেশে পিডোফিলিয়া নিয়ে সচেতন গবেষণা হয়, যথাসম্ভব আলোচনা হয়; পিডোফাইলদের জন্য হেল্পলাইন নম্বর থাকে, যেখানে তারা ফোন করে কাউন্সেলিং চাইতে পারে, ইমিডিয়েট সাপোর্ট ও গাইড্যান্স চাইতে পারে। আমাদের এখানে সহজ পথই শ্রেষ্ঠ পথ। পিডোফিলিয়ার স্বীকারোক্তি এলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে রাস্তার ওপর পিটিয়ে মারা হবে। – লোকে সত্যি কথা বলবে কেন?

বিদ্যাপীঠের রীতি ছিল, বছরের শুরুতে বিদ্যার্থী হোম করে নতুন ছাত্রদের পরিবারের অংশীভূত করে নেওয়া হত। উপনিষদের শ্লোক উচ্চারণ করে নতুন ছেলেরা শপথ নিত, হোমের টীকা কপালে পরিয়ে দিয়ে তাদের বিদ্যাপীঠ জীবনের উদ্বোধন হত। আমি ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়েছিলাম। আমাদের যেদিন নবীন-বরণ হয়েছিল, সেদিন তারিখ ছিল চব্বিশে এপ্রিল। আজ থেকে ঠিক কুড়ি বছর আগে।

বিদ্যাপীঠ পরিবারের অংশ হয়ে অবধি কুড়ি বছর কেটে গেল। বিদ্যাপীঠ ছেড়েওছি আজ এগারো বছর। বদলে গেছি অনেক। বিদ্যাপীঠের খবর পাই দূর থেকে। সেও বদলে গেছে।

কিন্তু বিদ্যাপীঠকে আমরা বয়ে বেড়াই আমাদের নিজেদের ভেতর। সেই শিক্ষা ফুরায় না, সেই দায়বদ্ধতা ফুরায় না। ‘And above all, Love.’

ভালোবাসার অনেক রঙ। আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।

~ শেষ ~

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *