চতুর্থ অংশ
“বিশ্বাসঘাতক”
“It is silly to go on pretending that under the skin we are brothers. The truth is more likely that under the skin we are all cannibals, assassins, traitors, liars and hypocrites.”
এই অংশে শুধু একটা মাত্র গল্প বলব। খুব ছোট গল্প। মনে থেকে গেছে। ইচ্ছে ছিল এই গল্পটা লেখার সময় নাম-ধাম বদলাব না। অন্য যে সব ঘটনা বলেছি, তাতে চরিত্রদের নাম পাল্টে দিয়েছি যাতে এখন, আজ আর কারো গায়ে আঁচ না লাগে। এই গল্পটা মনে হচ্ছিল খোলাখুলি লিখি। লিখলাম না।
শিবানন্দ সদনে ছিলাম যখন, ক্লাস ফোর-ফাইভ-সিক্সে, তখন আমাদের অঙ্কের স্যার ছিলেন দীনবন্ধু দে। আমাদের দীনবন্ধুদা। ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়ে প্রথমদিন এঁকেই ক্লাসে পেয়েছিলাম। সাদা শার্ট, সাদা ধুতি, সাদা চুল। ছোটোখাটো, রোগা চেহারা। কিন্তু মুখ দেখে মনে হয়েছিল খুব কড়া, কিছু হলেই বকা দেবেন।
তা বকুনি খেতাম আমরা দীনবন্ধুদার কাছে, ভালোরকমই খেতাম। ফাইভে ওঠার পর দীনবন্ধুদা আমাদের ভূগোলও পড়াতেন। অঙ্ক হোক বা ভূগোল, দীনবন্ধুদার ক্লাসে খুব একটা গোলমাল করা যেত না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও, আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মাস্টারমশাইদের মধ্যে ছিলেন দীনবন্ধুদা।
কিন্তু এই লেখা তো নস্ট্যালজিয়ার জন্য লেখা নয়। সেসব কথা থাক।
দীনবন্ধুদার ইলেকট্রনিকসের শখ ছিল। অনেকরকম টুকিটাকি জিনিসের মধ্যে একটা জিনিস আমাদের মাঝেমাঝে বানিয়ে এনে দেখাতেন, সেটা হল এলইডি দিয়ে বানানো ডান্সিং লাইটস। পিসিবি বোর্ডের ওপর লাল-সবুজ এলইডি বসিয়ে, সার্কিট জুড়ে জুড়ে এমনভাবে বানাতেন, ব্যাটারীতে জুড়ে দিলে বাল্বগুলো ঝিকমিক করে কখনো গোল, কখনো চৌকো, কখনো তারার মতো শেপ নিয়ে জ্বলত নিভত। বোর্ডে কীরকমভাবে এলইডি সাজিয়ে কীরকমভাবে সার্কিট করলে কীরকম আলোর নকশা ফোটানো যাবে, এইতেই ছিল দীনবন্ধুদার কারিগরি।
আমরা অনেকেই এই এলইডি ম্যাজিকের ভক্ত ছিলাম। স্কুলের পরে মাঝেমধ্যে চলে যেতাম দীনবন্ধুদার ঘরে। সেখানে ছড়ানো এলইডি ছাড়াও আরও কত কী। মডেল এরোপ্লেন, জাহাজ। পোস্টকার্ড আর পুটি দিয়ে বানানো ছোট্ট গ্লাইডার। পোস্টকার্ড দিয়ে গ্লাইডার বানানোটা আমরা অনেকেই শিখেছিলাম। আর কয়েকজন ছিল, যারা শিখতে চেয়েছিল কী করে ওই বোর্ডে সার্কিট করে করে এলইডি ডান্সিং লাইটস বানাতে হয়।
প্রায়ই তারা দীনবন্ধুদার ঘরে চলে যেত। আমাদের বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলার নিয়ম ছিল, কেউ তা থেকে বাদ পড়ার জো ছিল না। কিন্তু কেউ কেউ থাকত খেলাছুট পার্টি। তাদের মধ্যেই এই এরা। তিনজন ছিল এদের দলে, – চন্দ্রদীপ ঘোষ, মম্মথ ধর, আর নিরুপম বাগ। দলের পাণ্ডা চন্দ্রদীপ।
এই গল্পটা মস্তান মার্কা বুলিইং-এর গল্প নয়। চন্দ্রদীপ জক ছিল না, তার মস্তানি করে বেড়ানোর মত স্বভাব বা ক্ষমতা, কোনোটাই ছিল না। তার দাদাগিরির চরিত্র ছিল আলাদা। খানিকটা বোলচাল মেরে, খানিকটা ব্ল্যাকমেলিং করে, আর খানিকটা মহারাজের লালুগিরি করে সে তার অনুচরদের লাইনে রাখত। ফর্সা ছিপছিপে চেহারা ছিল, ক্যাথলিক চার্চে যেসব চেহারার ছেলেরা বেশীবয়সী পাদ্রীদের বিশেষ অনুগ্রহের শিকার হয়, সেরকম। এইভাবেই চলত।
চন্দ্রদীপের সায়েন্টিস্ট হবার ফ্যান্টাসি ছিল। কথাটা একটু ভুল বলা হল, সায়েন্টিস্ট হবার ফ্যান্টাসি নয়, ওর ফ্যান্টাসিটা ছিল যে ও অলরেডি একজন সায়েন্টিফিক জিনিয়াস। একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে বলি, ক্লাস এইটে থাকতে ও ঘোষণা করেছিল (সর্বসমক্ষে নয়, পার্সোনাল চেলাদের কাছে) যে ও “মাধ্যমিকের আগে একটা নোবেল পাবে, আর পরে একটা।” ক্লাসের স্বাভাবিক ভালো ছাত্ররা যখন মন দিয়ে পাঠ্যবই আর গতানুগতিক রেফারেন্স বই ধরে পড়া তৈরী করত, চন্দ্রদীপ তখন তার বাবাকে দিয়ে এক পিস রেসনিক-হ্যালিডে-ওয়াকারের ফিজিক্স আনাল। আপনি ভাবছেন কী ভালো ব্যাপার, নিজের তাগিদে ছেলেটা বিজ্ঞানচর্চা করত। আজ্ঞে না। বইটা রাখা থাকত চন্দ্রদীপের বিছানায়, বালিশের সঙ্গে অ্যালাইন করে। সেটা কেউ কখনো পড়ত না। পড়া সম্ভব নয়, কারণ সময়টা ক্লাস এইট। ওই ক্লাসে অ্যাটমিক স্ট্রাকচার পড়ানো শুরু হয়, কেসি নাগের বইয়ের ট্রেন বারবার ধরে খালি হাওড়া-মধুপুর আপ-ডাউন করে। ওই স্টেজে কারো পক্ষে রেসনিকে দাঁত ফোটানো সম্ভব নয়। তা একদিন শুনলাম চন্দ্রদীপ নিরুপমকে উত্তেজিতভাবে শোনাচ্ছে, “আরে এরা মাত্র ইলেকট্রন প্রোটন পড়ছে! আমি কোথায় আছি জানিস? সাইক্লোট্রন!!” – ক্লাসের ছেলেরা বলাবলি করত, চন্দ্রদীপ আসলে রেসনিক-হ্যালিডেটা মাথায় দিয়ে ঘুমোয়।
এসব তো অনেক পরে। আমরা বলছিলাম ক্লাস সিক্সের কথা।
চন্দ্রদীপের দলটা বেশ কিছুদিন দীনবন্ধুদার কাছে যাতায়াত করেছিল। এক রোববার কলকাতা থেকে বাবা এসে সার্কিটরির জিনিসপত্র দিয়ে গেল। সেসব ওরা কাউকে দেখাত না, বাক্সে ভরে শেলফে তালা দিয়ে রাখত। ক্লাসে মস্তানরাও ঘাঁটাত না তেমন, মহারাজের লালুকে ফালতু ঘাঁটানো ব্যাড ফর বিজনেস। তারপর একদিন আমরা দেখলাম চন্দ্রদীপ এলইডি বোর্ড বানাতে শিখেছে। দীনবন্ধুদাও খুব খুশী। এখন আমি নিজে মাস্টারি করি বলে আরো বেশী করে বুঝি। গর্ব হত ওনার। আমরা দেখতাম প্রতি বিকেলে চন্দ্রদীপের দল দীনবন্ধুদার ঘরে যায়, খেলার টাইম শেষ হলে এক্সাইটেড মুখেচোখে কথাবার্তা বলতে বলতে ফিরে আসে।
তারপর একদিন শুনলাম, দীনবন্ধুদার সঙ্গে চন্দ্রদীপের ঝগড়া হয়েছে। এলইডি লাইট নিয়েই। চন্দ্রদীপের নাকি আর দীনবন্ধুদার মতো ফালতু গাইড আর দরকার নেই। ও নিজেই এখন ঢের ভালো এলইডি বোর্ড বানাতে পারে, দীনবন্ধুদা আর কী বানায়!
গল্প এখানেই শেষ। আর কী বলব। যারা দীনবন্ধুদাকে ভালোবাসত, ডান্সিং লাইট শিখবার লোভে নয়, এমনিই, বাচ্চারা যেরকম বোকার মতো অনেকসময় এমনিই ভালোবাসে, সেরকম, তারা আমাদের বলেছিল পরে। তারা অনেকবার করে গিয়ে গিয়ে দেখা করেছিল মানুষটার সঙ্গে, সান্ত্বনা দিতে আর সঙ্গ দিতে। দীনবন্ধুদা নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন। যাকে ভালোবেসে এতদিন ধরে শেখালেন, সে এইরকম কথা বলল। এইরকম ব্যবহার করে চলে গেল। আমরা জানতাম চন্দ্রদীপের মুখের কথা পুরোটাই হাওয়া, বানাতে ও কিছুই পারে না। কিন্তু দীনবন্ধুদা তাও মেনে নিয়েছিলেন। শুধু বুঝে উঠতে পারেননি, ভালো না লাগলে আর না আসুক, কিন্তু এতদিনের এতকিছুর পর ও এরকম বিশ্রীভাবে আঘাত দিয়ে গেল কেন।
দীনবন্ধুদা আর কী করে বুঝবেন, তিনি তাঁর স্নেহ অপাত্রে দান করেছিলেন। গাছ যখন ছায়া দেয়, তখন পথিক আর কাঠুরের মধ্যে তফাৎ করে না। দীনবন্ধুদারা বরাবর গাছের মতই বোকা হন। আর চন্দ্রদীপরা তাঁদের ফলপাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়।
এ জন্য শাস্তি হয়নি কোনো চন্দ্রদীপের। হবে কী করে, কেউ তো আর কোনো স্যারকে গিয়ে বলবে না, যে স্যার, ও ওই আরেকজন স্যারের সঙ্গে এরকম করেছে? যেখানে পাহাড় নিজেই চুপ করে সয়ে গেছে, সেখানে মানুষ আর কোন পাথরের আড়াল তুলবে?
এই সিরিজের উদ্দেশ্য, স্কুলে থাকতে দিনের পর দিন যেসব অন্যায় আর হিংসার ছবি দেখেছি, তাকে স্বীকার করা। বিদ্যাপীঠে জীবনের সবচেয়ে ঘৃণ্য স্মৃতিগুলোর মধ্যে থাকা এই ঘটনাটার সাক্ষ্য তাই এখানে লিখে রাখলাম।
(চলবে)