নীল-কালো (২)

দ্বিতীয় অংশ

“চোর-পুলিশ”

“কে একজন বলিল – পাকা চোর –

টেঁপি বলিল – বাগানের আমগুলো তলায় পড়বার জো নেই কাকীমা –

শেষোক্ত কথাতেই বোধ হয় সেজ ঠাক্‌রুণের কোন ব্যথায় ঘা লাগিল। তিনি হঠাৎ বাজখাঁই রকমের আওয়াজ ছাড়িয়ে বলিয়া উঠিলেন – তবে রে পাজি, নচ্ছার চোরের ঝাড়, তুমি জিনিস দেবে না? দেখি তুমি দেও কি না দেও! কথা শেষ না করিয়াই তিনি দুর্গার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া তাহার মাথাটা লইয়া সজোরে দেওয়ালে ঠুকিতে লাগিলেন।”

ইস্কুলে চুরি, – পাশ-ফেল, র‍্যাগিং বা লাভলেটারের মতই প্যানডেমিক ঘটনা। চুরি অনেকরকম হত। ছেলেরা স্কুলের জিনিস চুরি করত, – যেমন গাছ থেকে আম বা পেয়ারা বা বাতাবিলেবু চুরি, এমনকী লিচু চুরি। পরে কলেজে থাকতে আমরা সফলভাবে একাধিকবার কাঁঠাল চুরি করেছি। এইসব চুরির গল্প এখানে করব না। এখানে অন্য চুরির গল্প হবে, যাকে রোমান্টিসাইজ করা একটু কঠিন।

শিবানন্দ সদনের আমলে, মানে ক্লাস ফোর-থেকে-সিক্সে পড়াকালীন, একবার আমাদের ক্লাসে একটা সেনসেশন্যাল চুরি হয়েছিল। একজন ছেলে ছিল যে র‍্যাঙ্ক করত, পরীক্ষার ঠিক আগে তার নোটস চুরি গেছিল। সে কান্নাকাটি করে একাকার, – কে না জানে পরীক্ষার আগে ফেলটু ছাত্রদের ভয় যত থাকে, টপার ছাত্রদের ভয় থাকে তার চেয়ে বেশী। যাইহোক শেষপর্যন্ত একজন ছেলে স্বীকার করেছিল, যে সে চুরি করেছে। যতদূর মনে পড়ে, চুরি করে সেই নোট সে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছিল, – সঠিক মনে নেই। কিন্তু সে তবু কমবয়সের চুরি, তখনো আমাদের মধ্যে নিজস্ব বিচারব্যবস্থা ডেভেলপ করেনি। শিবানন্দ সদনে নিজস্ব সিস্টেম তৈরী হওয়াটা কঠিন ছিল।

চুরি বাড়ল ব্রহ্মানন্দ সদনে এসে। সে বছর আমাদের ক্লাসে নতুন একজন ভর্তি হল, নাম শিবাশিস পাল। কিছুদিনের মধ্যে জানা গেল, শিবাশিস পাল চুরি করে। রুমে কেউ না থাকলে অন্যের স্টকবক্স থেকে স্টক চুরি করে, পারলে অন্য জিনিসও। প্রথম দু’একবার ধরা পড়ে ওয়ার্ডেন মহারাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেসবে কিছু শোধরায়নি। যতদিন স্কুলে ছিল, চোর পরিচিতিটা ওর থেকেই গিয়েছিল।

‘স্টক’ বলতে আমাদের কাছে থাকা টুকিটাকি শুকনো খাবার, বিস্কুট নিমকি মুড়ি কেক ভুজিয়া চানাচুর এইসব; গার্জেনরা মাসে-দু’মাসে একবার এসে নিজের-নিজের ছেলেকে বেশ কিছুদিনের মতো খাবার দিয়ে যেত। এই খাবার যদিও যার জন্যে কেনা, তার পেটে সবটা যেত না। বন্ধুরা মিলে ভাগ করে খাওয়ার ব্যাপারটা তো আছেই, সেসব সুখস্মৃতি, কিন্তু এছাড়াও ছিনতাইয়ের ব্যাপার ছিল। ক্লাসের মস্তানরা চোখ রাখত কার ভালো খাবারদাবার এসেছে। গার্জেনরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে তোলা আদায় করা হত। অনেক সময়েই প্রায় পুরোটাই চলে যেত ছিনতাইবাজদের হাতে। হয়তো এক টিন বিস্কুট এসেছে, সেটা পুরোটা শেষ করে দিয়ে তলানি দু’টো বিস্কুট ফেরত দিয়ে বলল, ‘ইয়ে লে।’ ভাবটা এমন যে সবাইই তো ভাগ করে খাওয়া হল, এই নে এটা তোর ভাগ। মস্তানদের স্টকগুলো কেন এই একই মার্কসবাদী আদর্শ মেনে ভাগ করে দেওয়া হবে না সেসব প্রশ্ন বারণ, বোকার মত জিজ্ঞেস করলে মার খেতে হবে।

এসব ছোটো ছোটো টীকা দিতে হচ্ছে কারণ গল্পগুলো একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। বাইরের লোকেদের জন্য; বিদ্যাপীঠের ছেলেরা জানে। আসলে লেখার উদ্দেশ্য হল স্কুললাইফের এই সত্যিগুলোকে কালি-কলমে স্বীকৃতি দেওয়া। যত ঘটনা লিখছি, সবই স্মৃতিনির্ভর। তাই ছোটোখাটো ভুলের একটা সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু তাতে বিশেষ ক্ষতি হবে না। ঘটনাগুলোর চরিত্র তাতে বদলায় না। চরিত্রদের নামগুলো যদিও বদলাতেই হচ্ছে।

ক্লাস নাইন না টেন মনে নেই। ক্লাসে খুব চুরি হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। একজনের জরুরী চশমা চুরি গেছিল, আরেকজনের দামী ওষুধ ফেলে দেওয়া হয়েছিল জানলা দিয়ে। এছাড়া সাধারণ এটা ওটা তো আছেই। চশমা আর ওষুধের ব্যাপারটা ভাবলে বোঝা যায়, চুরির মোটিভ ঠিক পরের-দ্রব্য-হরণ-করা ছিল না। অন্য আক্রোশ ছিল এসবের পেছনে। কিন্তু তখন সেই বয়সে কেউ তলিয়ে ভাবেনি, না ছিল বুঝবার ক্ষমতা, না ছিল ইচ্ছে।

চোর ধরা পড়ল একদিন। একজন না, তিনজন চোর। শিবাশিস পাল; প্রতিম চৌধুরী; অমর চ্যাটার্জী।

প্রতিম আর অমরের ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু পরিষ্কার করে বললে বাকিটা বুঝতে সুবিধা হবে। প্রতিম আমাদের ব্যাচের ছেলে নয়, আমাদের একব্যাচ সিনিয়র। গতবছর ফেল করে আমাদের ব্যাচে এসেছিল। গোলমেলে ছেলে, নানারকম কেচ্ছায় জড়িত। অমর আমাদেরই ব্যাচ, পরীক্ষায় ভালো না, নানারকম গণ্ডগোলে থাকে, বিশেষ করে ব্যাচের যারা ‘দেখতে-ভালো’ এবং ‘মাল’ বলে পরিগণিত (“মিশন ইন্দ্রধনু” সিরিজ দ্রষ্টব্য), তাদের মধ্যে অমর একজন। প্রতিম যদিও আমাদের খুব পরিচিত ছিল না, কিন্তু ব্যাচে আসার পর দেখা গেল এই শেষ বৈশিষ্ট্যটা তারও আছে।

ক্রিমিনোলজি যারা পড়েছে তারা জানে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন শাখার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন যোগসূত্র থাকে। চোরের পেটে গুঁতো মারলে বেশ্যাপাড়ার খবর বেরোয়, বেশ্যাপাড়ায় ঠিকমতো খোঁজখবর করলে চুরি, ডাকাতি বা ড্রাগের খবর পাওয়া যায়। এটা হয় তার কারণ এরা সবাই মূল সমাজে মার্জিনালাইজড; নিজেদের সমাজ এদেরকে নিজেরা মিলেই তৈরী করে নিতে হয়। এটা মানুষের সামাজিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। – আমাদের ব্যাচে, এরকম কোনো সোশ্যাল মেকানিক্সের ফলেই হয়ত, প্রতিম অমর আর শিবাশিস পালের বন্ধুত্ব হয়েছিল। এরা কেউই ক্ষমতাধর ছিল না, ক্লাসমেটদের কাছে সম্মান পেত না কেউই, টীচারদের কাছেও এদের কারো সুনাম ছিল না। এরা ছিল দাগী। শিবাশিস পালের হয়তো অমরের ওপর দুর্বলতা ছিল, সেই দুর্বলতা হয়ত বন্ধুত্বকে আরো জমাট করেছিল। কিন্তু ওদের মধ্যে কোনো ফর্ম্যাল সম্পর্ক ছিল না। ‘মাল’ হিসেবে অমরের যা স্ট্যান্ডার্ড, সেটা কো-এড স্কুলে “কুইন বী”-দের থাকে। শিবাশিস পালের ক্ষমতা ছিল না অমরের প্রেমিকদের চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু আগেই বলেছিলাম, আমাদের স্কুলে প্রেম ব্যাপারটাই ছিল লালবাতি-মার্কা জিনিস। অমর “কুইন-বী” হয়েও দিনের শেষে ব্যবহার্যই থেকে যেত; আর সেই জন্যেই শিবাশিস পালের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হতে কোনো বাধা ছিল না।

তিন চোর যখন শেষপর্যন্ত ধরা পড়ল, সারা ক্লাসে একটা চাপা উল্লাস ছড়াতে শুরু করেছিল। অ-নে-কদিনের অ-নে-ক রকম রাগ জমে আছে সবার। এবার সুযোগ এসেছে।

ক্লাসের লীডাররা, মানে যাদের কথা আগে বলেছি, তারা প্রথমেই কয়েকটা কথা ঠিক করে দিল। কোনো স্যারকে বা মহারাজকে একচুলও কোনো কিছু বলা হবে না। কোনো কমপ্লেন যেন না যায়। যা হবে, নিজেদের মধ্যে হবে। — রবিবার (ভালো মনে নেই কী বার ছিল) দুপুরবেলা টাইম ফিক্স করা হল। ওইদিন দুপুরে, একটা উইন্ডো পাওয়া যাবে যখন সদনে কোনো ওয়ার্ডেন থাকবে না। তখন যা করার করা হবে। কী করা হবে? সেটা খুব ইন্টারেস্টিং।

ক্লাস নাইন, মানে বিবেকানন্দ সদনে আমাদের রুমগুলো ছিল আট-বিছানার ঘর। একেকটা রুমে সাত থেকে আটজন থাকত। সাইজটা পাঠককে অনুমান করে নিতে হবে, আমি মেনসুরেশনে কাঁচা। সেদিন দুপুরবেলা অমর আর প্রতিমকে বলা হল একটা নির্দিষ্ট রুমে থাকতে। বলা হল মানে, ওরা তখন মাংসের দোকানে বাঁধা পাঁঠা; ওদের যা বলা হবে ওরা তা-ই করবে, অমান্য করার কোনো সীন নেই, ওরা জানে কী হতে চলেছে। শিবাশিস পালের জন্য অন্য সাইট, যদ্দূর মনে হয় ওর এনকাউন্টারটা করা হয়েছিল হসপিটালে (আমাদের ক্যাম্পাসে নিজেদের ইনডোর হসপিটাল ছিল)। – এই দু’জনকে বলা হল একটা রুমে থাকতে, টাইম বলে দেওয়া হল। তারপর সেদিন দুপুরবেলা বিচারসভা।

বিচার খুব সরল। ব্যাচে ঠিক একশোএকজন ছেলে ছিল। মাইনাস তিন করলে হয় আটানব্বই। এক-আধজন তখন ছুটি নিয়ে বাড়ি ছিল কিনা মনে নেই, ধরলাম পঁচানব্বই। – এই পঁচানব্বইজন ঢুকে পড়ল রুমে। দরজা-জানলা সব বন্ধ করে দেওয়া হল। তারপর শুরু হল মার। সবাই চান্স পাবে। কয়েক ঘা দিয়ে সরে আসবে, তারপর পরের জন। পালা করে চলবে। ওই আঠেরোফুট-বাই-আঠেরোফুট ঘরের ভেতর পঁচানব্বইটা ছেলে, দু’জন চোরকে পেটাচ্ছে। দরজা-জানলা সব বন্ধ।

পুরো ব্যাচে মাত্র দু’জন ছিল সেদিন যারা সেই গণপ্রহারে সামিল হয় নি। একজন আমি, আরেকজন অমিত পাটিল। আমরা সামিল হইনি তার অন্য কারণ ছিল। মানবিকতার জন্যে সরে থেকেছিলাম, এমনটা নয়। হয়তো কিছুটা তাই। কিন্তু সেটা ছাড়াও অন্য কারণ ছিল, সে অন্য গল্প।

কিছুক্ষণ চলল মার। আমরা দু’জন বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, চুপচাপ রেলিং-এ ভর দিয়ে দুপুরের মাঠ দেখছি। পেছনে বন্ধ রুমের ভেতর থেকে চাপা শোরগোল কানে আসছে। কতক্ষণ কাটল বোঝা যায় না। এখন তো মনেও নেই।

দরজা খুলে দু’তিনজন বেরিয়ে এল, একটু দম নিতে। ঘরের ভেতর তো বাতাস যাচ্ছে না, গুমোট হয়ে উঠেছে। তাই একটু ব্রেক, মুখে খুশীর হাসি, জব ডান ওয়েল হলে যেমন হয়। একটু বাইরের ফ্রেশ হাওয়া টেনে নিয়ে আবার ভেতরে ঢুকল।

যাদের সাইকোলজিতে আগ্রহ আছে তারা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছে, কাউকে মার দিয়ে যতটা আরাম পাওয়া যায়, মার-কাম-ধর্ষণে তার চেয়ে আরাম পাওয়া যায় বেশী। মানে, যদি আপনি স্যাডিস্ট হন আর কী। হোমো সেপিয়েন্স কিন্তু প্রজাতিগতভাবে স্যাডিজম বয়। যাক্‌গে সেসব।

একটু পরে আরো দু’জন বেরোল। এরা ক্লাসের জনপ্রিয় লীডার, এবং ইন্টিগ্রিটির জন্য সুপরিচিত। এরা বেরিয়ে খানিকক্ষণ ঘাম জুড়িয়ে নিয়ে একজন আরেকজনকে বলল, “ইয়ে তো মর যায়গা, অ্যায়সে মার রাহা হ্যায়।” আরেকজন বলল, “হুঁ। – বচায়গা?” প্রথমজন ভেবে দেখল এই অবস্থায় বাঁচানোটা বেশী হিরোয়িক হবে। বলল, “চল বচাতে হ্যাঁয়।”

তারপর তারা আবার ঘরে ঢুকল। বলা বাহুল্য, এদের গায়ে ভালোই জোর-টোর ছিল। খানিকক্ষণ পরে দেখলাম আস্তে আস্তে দরজা খোলা হল, আস্তে আস্তে সবাই পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উজ্জ্বলভাবে নিজের নিজের ঘরে চলে গেল। কেউ কেউ বাথরুম গেছিল, চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে। এসব কাজ, কম ঝক্কি নয়। কয়েকজন, যারা স্মার্ট এবং সেন্সিবল, খানিকটা শুশ্রূষা করে দুই চোরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মানে, হাসপাতাল তো যেতে দেওয়া যায় না, পাগল নাকি? এসব নিজেদের ব্যাপার, নিজেদের মধ্যে থাকতে হবে। লিক করলে মুশকিল আছে।

এর পর কয়েকদিন এই চোরদের সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলেনি। অ্যাপ্রোচও করেনি। যাকে দু’দিন আগে ঘরে বন্ধ করে পেটে-পিঠে নাগাড়ে লাথ-ঘুঁষি চালিয়েছে, তাকে ওভাবে আবার অ্যাপ্রোচ করা যায়? আর করলে বাকিরাই বা কী ভাববে? – পাশ কাটাও।

গিয়ে প্রথম কথা বলেছিল অমিত পাটিল, তার পর আমি। আমরা যেহেতু মারের দলে ছিলাম না, তাই কাজটা করা আমাদের পক্ষে একটু সহজ ছিল। তার পর কয়েক দিন যেতে যেতে বাকিরাও আবার আগের মতো হয়ে গেল। পিঠ চাপড়ে “চল, ঠিক আছে।” সত্যি মাইরি, বন্ধুত্ব আর ক্ষমার মতো জিনিস হয় না।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *