প্রথম অংশ
“মার”
“The rebel took the bank job because she sees her rebellion is fruitless. The player stays faithful to his wife because the consequence of infidelity is much greater now. But their instincts – their instincts never change.”
রাতে বেডে শুয়ে শুয়ে শুনছি, ভৈরব মহারাজের রুমের দিক থেকে প্রচণ্ড মার আর চীৎকারের আওয়াজ আসছে। শুধু আমরা না, আমাদের ধাম না, সারা সদন শুনছে। নিয়ম থার্ড বেলের পরে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া, কিন্তু সেদিন কেউই ঘুমোচ্ছিল না। ওই শব্দ শিবানন্দ সদনের এমাথা-ওমাথা শোনা যাওয়ার কথা। তাছাড়া ব্যাপারটা সবাই জানত।
মার খাচ্ছে সঞ্চয়নদা আর আবীরদা। আমাদের সিনিয়র। আমরা ক্লাস ফোর, ওরা ক্লাস সিক্স। শিবানন্দ সদনের সিনিয়রমোস্ট ব্যাচ। মার খাচ্ছে কারণ সমকাম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
বিদ্যাপীঠের সমকাম-সমপ্রেমের গল্প এর আগে করেছি। তখন বলেছিলাম, আমাদের এইসব প্রেমটেম সবই হত চূড়ান্ত গোপনীয়তার আড়ালে; এ ছিল ওপেন সিক্রেট, ওপেন কারণ কাম কাউকে ছাড়ে না, আর সিক্রেট কারণ ধরা পড়লে পিটিয়ে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই লেখায় অনেকগুলো কথা বলিনি। বলার জায়গা ছিল না।
ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমরা থাকতাম শিবানন্দ সদনে। শিবানন্দ সদনের এই যে তিনটে বছর, তার মূল ভূমিকা ছিল নতুন ছেলেদের ব্রেক-ইন করা। চরম ডিসিপ্লিনের মধ্যে আমাদের রাখা হত। ঘন্টা-বাঁধা রুটিন, সবকিছু ঘন্টার আওয়াজ মেনে চলত। এবং এদিক ওদিক হলেই ভাগ্যে ছিল নানারকম শাস্তি, যার মধ্যে অন্যতম ছিল মার। আর শিবানন্দ সদনে মারের মহারাজা ছিলেন ভৈরব মহারাজ।
ভৈরব মহারাজকে সবাই ওই একটা কারণেই মনে রেখেছে। প্রচণ্ড পেটাতেন। ভৈরব মহারাজের লাঠিকে ছেলেরা যতটা ভয় পেত, তার চেয়ে বেশী ভয় পেত ভৈরব মহারাজের হাতকে। ওজনদার চেহারা ছিল, দশ-এগারো-বারো বছরের ছেলেদের অনুপাতে সেটা আরও বেশী। প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পর সেই দিনের ধরা-পড়া নির্বাচিত দোষীরা ভৈরব মহারাজের রুমের সামনে গিয়ে লাইন দিয়ে নীলডাউন হত। মহারাজ খাওয়াদাওয়া সেরে সদনে ফিরতেন একটু দেরীতে। এবং ফিরে, হাতের জিনিসপত্র ঘরে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে এসে হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে ছেলেদের একটা একটা করে তুলে সর্বশক্তি দিয়ে পেটাতেন।
এখন বুঝি সেদিন রাতের সঞ্চয়নদা-দের মার খাওয়াটা কেন ওই নিত্যদিনের মারের মধ্যেও অতটা বেশীরকম ভয়াবহ লেগেছিল। তখন দু’হাজার সাল, আর ভৈরব মহারাজ গ্রাম্য মানসিকতাসম্পন্ন সন্ন্যাসী। শুধু নিয়ম ভাঙার জন্য শাস্তি নয়, – একটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, অস্বাভাবিক, কদর্য রোগের চিকিৎসা চলছিল সেদিন, পচে ওঠা ঠেকাতে হাত-পা চেপে ধরে ক্ষতস্থানে গরম লোহা চেপে ধরার মতন। ওঝা যেভাবে ভূতকে ঝেড়ে তাড়াবে বলে ভূতগ্রস্তের গায়ে ঝাঁটা মারতে থাকে, সেই ঝেড়ে তাড়ানোর আক্রোশ মিশে ছিল সেদিন ভৈরব মহারাজের মারে। — অনেকক্ষণ মেরেছিলেন। যতক্ষণ পেরেছিলেন মেরেছিলেন। আমরা মড়ার মত বিছানায় শুয়ে শুয়ে দু’জনের চীৎকার শুনছিলাম। কোনটা কার গলা, বোঝা যাচ্ছিল না।
তবে মাস্টারমশাইদের মারের গল্প করার জন্য এই লেখা লিখতে বসিনি। এটা দিয়ে শুরু করলাম যাতে একটা স্কেল পাওয়া যায়।
সবাই জানে, স্কুললাইফে ক্লাসে সবচেয়ে ডমিন্যান্ট হয় তারা যাদের গায়ে সবচেয়ে বেশী জোর থাকে। ইংরেজীতে বলে ‘jock’। প্রকারান্তরে বলতে গেলে, যারা খেলাধূলায় ডমিনেট করত, তারা সোশ্যাল লাইফেও ডমিনেট করত। ‘খেলাধূলায় সবচেয়ে ভালো ছিল’ ইচ্ছে করেই বললাম না, কারণ ব্যাপারটা স্কিলের নয়, ব্যাপারটা জোরের এবং মানসিকতার। এ জিনিসগুলো কখনো ওভারল্যাপ করত, কখনো করত না। – আমাদের ক্লাসের প্রথমদিককার নামকরা মস্তান যারা, তাদের মধ্যে ছিল জীবন আর মোহিত। দু’জনেই ইংলিশ মিডিয়াম, অবাঙালী, এবং দু’জনেই ভালো ফুটবলার।
জীবন ছিল ব্রাজিলের সাপোর্টার, কারণ ওর ফেভারিট প্লেয়ার ব্রাজিলের। আর ওদিকে মোহিত ইংল্যান্ড সাপোর্টার, কারণ ওর ফেভারিট প্লেয়ার ইংল্যান্ডের। এই অবধি কোনো গোলমাল নেই। কিন্তু এরা মাঝে মাঝে ঘুরে ঘুরে ছেলেদের জিজ্ঞেস করত, তুই কোন টীমের সাপোর্টার? – আমরা সবাই জানতাম, যে জিজ্ঞেস করবে, তাকে তার টীমের নাম বলতে হবে। না বললে তৎক্ষণাৎ মার। জীবন আর মোহিত নিজেরাও জানত যে কেউ ওদেরকে সত্যিই সত্যিকথা বলছে না। কিন্তু সেটা ফ্যাকটর না। ফ্যাকটর হল ইনটিমিডেশন, ফ্যাকটর হল ডমিনেশন। আমার সামনে আমার মর্জির বাইরে কোনো কথা যেন কেউ মুখ ফুটে না বলে। জীবন আর মোহিতের মধ্যে কিন্তু যথেষ্ট ভাব। সেদিকে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞেস করলে আমাদের ঠিক উত্তর দিতে হবে। আমরা বলতে নিরীহরা, যারা মারপিট করে না, করতে পারেও না। আফ্রিকার উইল্ডবীস্ট।
আমরা যখন ক্লাস সিক্সে, সেটা কোরিয়া-জাপান ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের বছর। খুব ধুম উঠেছিল ফুটবলারদের ছবি কালেকশন করার। প্রায় সবাইই একটা করে খাতা করেছিল, খবরের কাগজ, ‘স্পোর্টস্টার’, ‘খেলা’, – এইসব থেকে প্লেয়ারদের ছবি কেটে কেটে সেই খাতায় সেঁটে (‘চিটিয়ে’) কালেকশন বানাত। – এবার স্বাভাবিকভাবেই, জীবন আর মোহিতের কালেকশন তো সেরা হতেই হবে। তখন তাই নিয়ম চালু হয়েছিল, বেকহ্যামের ছবি যে-ই পাক না কেন, সেটা তাকে মোহিতের কাছে জমা দিতে হবে, আর রবার্টো কার্লোসের ছবি যে-ই পাক, দিতে হবে জীবনকে। যদি কারো কাছে এই প্লেয়ারদের ছবি পাওয়া যায়, তাহলে সে কনসার্নড পার্টির কাছে মার খেতে বাধ্য থাকবে। এসব ব্যাপারে স্যার-ট্যারকে কমপ্লেন করে কোনো লাভ নেই। পৃথিবীর সবাই জানে বুলিদের নামে কমপ্লেন করে কোনো লাভ হয় না, এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
একটা জিনিস বুঝিয়ে বলা দরকার। ব্যাপারটাকে নিছক ‘বাচ্চাদের ছেলেখেলা’ বলে দেখলে মারাত্মক ভুল হবে। একটা ছেলের কাছে অন্য আরেকটা ছেলে কিন্তু বাচ্চা নয়; সে একটা লোক। তিরিশ বছর বয়স্ক আপনাকে যদি অটোওয়ালা কলার ধরে থাপ্পড় মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়, তাহলে আপনার ঠিক যতটা বিশ্রী লাগবে আর খারাপ লাগবে, ক্লাস সিক্সের একটা বাচ্চাকে ক্লাস সিক্সের আরেকটা বাচ্চা কলার ধরে চড় মারলে তার ঠিক ততটাই খারাপ লাগে। সেও একইরকম আড়ালে গিয়ে একইরকম ফোঁসে। কিন্তু আপনি জানেন এবং সে অচিরে জানবে, এটাই নিয়ম। পৃথিবীতে এটাই সর্বত্র হয়, কোনোকালে কোনো দেশে এর কোনো বড়-হলে-সেরে-যাবে মার্কা যাদুমন্তর নেই।
আমাদের বিদ্যাপীঠে মনিটরকে মনিটর বলা হত না, বলা হত ‘সেবক’। সেবক অবশ্য নামেই। এই যাদের কথা বলছিলাম, ডমিন্যান্ট স্বভাবের স্বাভাবিক নিয়মেই তারা ‘লীডার’ হিসেবে নজরে পড়ত। এবং তাদেরকেই সেবক করা হত বেশীরভাগ সময়। হবে না-ই বা কেন, তারাই তো সবাইকে সামলে রাখতে সবচেয়ে ভালো পারে, – কেন, কীভাবে, – স্কুল হস্টেলে বসে বাচ্চাদের মনের সেসব সাইকোলজিক্যাল মেকানিক্স কে মাপছে! – সুতরাং তারা সেবক হত, এবং সেবকগিরিও তারা নিজেদের মত করেই করত। সবাই না, এবং সবসময়ও না। পুলিশ কি আর সবসময় বাড়ি এসে মস্তানি করে? সেসবের সময় আছে, মেজাজ আছে। স্কুল হস্টেলে জিনিসটার স্কেল আলাদা, নেচার একই।
ওয়ার্ডেন হয়তো বলে গেছে, সেবকরা ধামে ডিসিপ্লিন রাখবে, গোলমাল হলে তাদেরকে ধরা হবে। এবার আমাদের কাছে অ্যানাউন্সমেন্ট এল (ওয়ার্ডেনের অবর্তমানে অবশ্যই), যদি কারো জন্য মহারাজের কাছে সেবককে কথা শুনতে হয়, তাহলে তাকে পরে সেবকের কাছে তিন বেল্ট খেতে হবে।
আবারও বলি, সব সেবক নয়, এবং যারা করত তারাও সবসময় করত না। কিন্তু ওই যে বললাম। পরেরদিন অটোওয়ালা আপনাকে থাপ্পড় না-ই বা মারল, তাই না?
সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় সে ভারী মজার জিনিস। আমার ক্লাস সিক্স অবধিও একটা অভ্যাস ছিল, খুব একমনে কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকলে বা কিছু ভাবতে থাকলে, হাঁ মুখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা লোল ঝুলে পড়ত। সবসময় হত না, কালেভদ্রে। মনে আছে একদিন, আমি বেডের কাছে দাঁড়িয়ে আছি, আমার ক্লাসের দু’জন মস্তান আমাকে খুব কড়কাচ্ছে। মারবে-টারবে না, জাস্ট কচলানি। আমি হাঁ করে কড়কানি শুনছি (বাঙালী ভদ্রলোক ট্র্যাডিশনালি অসভ্যতার মুখে পড়লে যা করে), এমন সময় মুখ থেকে সুস্ করে এক ড্রপ লোল ঝুলে পড়ল। ব্যাস, আর যায় কোথায়, আমি যে এতটা ল্যাল, তাই দেখে মনে হয় নিজেরাই ওভারলোডেড হয়ে দু’একবার ‘ছীইহ্’ তুলে, হ্যা-হ্যা করতে করতে চলে গেল। – এসব খুব কমন ব্যাপার, অনেকের সঙ্গে অনেকরকম ভাবে হত।
মজাটা অন্যখানে। যখন টুয়েলভে পড়ি, তখনকার কথা, সেশন শেষ হতে আর দু’একটা দিন বাকি। আমি আর আরেকজন ক্লাসমেট, সে আমার বন্ধু না, কিন্তু কোনোভাবে পথে দেখা হয়ে গেছে, হাঁটতে হাঁটতে বড়মন্দিরের কাছটায় এসেছি। এই ক্যাম্পাসে নয় বছর কাটল দু’জনেরই। মাধ্যমিকের পরে একবার ফেরার সুযোগ হয়েছিল, এবার আর ফেরা নেই। হঠাৎ আমার সঙ্গের জন আমাকে বলে, “ইঁয়াহা সে নিকলনে কা ওয়াক্ত আ গয়া। বাইরে বেরিয়ে কী করব, কোথায় যাব। এতদিন রইলাম এখানে, একসাথে। বাইরে কাদেরকে পাব জানিনা। তুঝ জ্যায়সা পাগল মুঝে চাহিয়ে।” – আমার মনে পড়লে এখনো হেসে ফেলি। সত্যিই মানুষ অল্প-অল্প বদলায়। এই সঙ্গের জনই আমাকে ছয় বছর আগে সেদিন সবান্ধব কড়কেছিল। ছয় বছর পেরিয়ে গেছে, সে পুরোটা পাল্টায়নি, আমরা কেউই পুরোটা পাল্টাই না। কিন্তু এতদিন পরে আয়নায় হয়তো সে এক অন্য নিজেকে দেখতে চায়। অর্ধেক যুগে সেই বা কম কী।
(চলবে)