বাংলার ছাত্রছাত্রীদের আরেকটা বড় দুর্ভাগ্য আছে, সেটা হল – তারা জন্মেছে বাঙালীর ঘরে।
রবীন্দ্রনাথ এককথায় বলেছিলেন, “শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে / দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে। / সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, / রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।” – এই যে মানসিক শীর্ণতার অভিশাপ, এই অভিশাপের দাগ আজ পর্যন্ত বাঙালীর কপাল থেকে ঘোচেনি।
আমার বন্ধু যে বলেছিল, বাংলা মিডিয়ামের ছেলেদের ঠিক টেস্ট নেই, বাংলা মিডিয়ামগুলো বড্ড বোদা, সেটার মধ্যে একটা খুব সূক্ষ্ম সত্যের ইঙ্গিত লুকোনো ছিল। সেই সত্য যে ছিল তা সেই বন্ধু নিজেও জানত না, আমিও জানতাম না। এখন এতদিন পরে যেন মনে হয়, ছিল। সমস্যাটা ঠিক বাঙালী হওয়ার সমস্যা নয়। সমস্যাটা হল বাঙালী মানসিকতার সমস্যা।
মধ্যবিত্ত মানুষ আর মধ্যবিত্ত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ, এই দুটো এক জিনিস নয়। সেরকমভাবে, আমি বাঙালী আর বাঙালী মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের মধ্যে একটা পার্থক্য টানতে চাইছি।
বাঙালী মানসিকতা বলতে কী? বাঙালী মানসিকতা বলতে আবহমানকাল ধরে গড় বাঙালী যে চরম সঙ্কীর্ণ, প্রাদেশিক, কূপমণ্ডুকধর্মী, অলস, চুকলিপ্রিয়, আড্ডাবাজ মানসিকতাকে সযত্নে লালন ও পালন করে এসেছে, সেই মানসিকতা। বাঙালী মানসিকতা সেই মানসিকতা যার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য হেমেন্দ্রকুমার রায় ‘যখের ধন’-এর মতো গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন, দেশী বিদেশী অভিযাত্রী, খেলোয়াড়, কুস্তিগীরদের নিয়ে নিয়মিত ফিচার লিখতে শুরু করেছিলেন। বাঙালী মানসিকতা সেই মানসিকতা যার সম্পর্কে জানতেন বলে সুকুমার রায়কে আবোল-তাবোলের গোড়ায় লিখে দিতে হয়েছিল, যাঁরা এই বইয়ের রস বুঝবেন না, তাঁরা দয়া করে এই বই পড়তে আসবেন না। বাঙালী মানসিকতা সেই মানসিকতা যার ব্যাপারে নাতিকে সাবধান করে দিয়ে মনোমোহন মিত্র বলেছিলেন, “কূপমণ্ডুক হয়ো না।” এই বাঙালী মানসিকতা আমাদের বাংলায় বরাবর ছিল, বরাবর বাঙালী কুলাঙ্গারদের এই মানসিকতার বিরুদ্ধে যুঝেই যা করবার করতে হয়েছে। এই বাঙালী মানসিকতাই রামমোহনের পেছনে গুণ্ডা লাগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথের নামে পত্রিকায় কেচ্ছা করেছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ-হেটার বলে বাজারে চালিয়েছে।
এই বাঙালীকে ব্যবসা বোঝাতে গিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় হিমসিম খেয়ে গিয়েছিলেন। ব্যবসা তো অনেক দূরের কথা। প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন, “আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল।”
ভালো মনে নেই, বোধহয় রবীন্দ্রনাথই কোথায় যেন বলেছিলেন, বিদ্যাসাগর আসলে এদেশী লোক নন; বাঙালীর ছদ্মবেশে বিদ্যাসাগর আসলে একজন পাক্কা ইংরেজ। উনি যা করেছিলেন, ক্ষীণপ্রাণ বাঙালীর পক্ষে সেসব করে ওঠা বিশ্বাসযোগ্য নয়। – এখানে বাঙালীর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যা কটাক্ষ ছিল, এই লেখায় আমার বক্তব্যও তাই। বাঙালী বড় হতে জানে না।
শুধু “আগন্তুক” নয়, সত্যজিৎ রায় বার বার তাঁর লেখায় এই সমস্যাকে অ্যাড্রেস করেছেন। “বঙ্কুবাবুর বন্ধু” সবার মনে আছে। বঙ্কুবাবু স্কুলমাস্টার, বাংলা আর ভূগোল পড়ান। কিন্তু তিনি আর পাঁচটা স্কুলমাস্টারের মত নন। তিনি ছাত্রদের কখনো কখনো বাড়িতে নিয়ে আসেন, তারপর ‘বাটি করে মুড়ি খেতে দিয়ে গল্পচ্ছলে দেশবিদেশের আশ্চর্য ঘটনা শোনান। আফ্রিকার গল্প, মেরু আবিষ্কারের গল্প, ব্রেজিলের মানুষখেকো মাছের গল্প, সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাওয়া আটলান্টিস মহাদেশের গল্প।’
এখানে কম্বিনেশনটা লক্ষ্য করার মতো। একদিকে বঙ্কুবাবু বাটি করে মুড়ি খেতে দিচ্ছেন, অন্যদিকে গল্প করছেন আটলান্টিসের। এই ছিল আদর্শ। কিন্তু বাঙালীরা সেখানেই গোলমালটা করে ফেলল। লুঙ্গি ছেড়ে রিগের কার্গো পরে বাঙালী এয়ারটেলের স্যাটেলাইটে স্টার জলসা দেখতে বসল।
সেই গল্পে বঙ্কুবাবুর পাশাপাশি যারা ছিল, তারা এই চিরকালীন গড় বাঙালী। মনে আছে? একদিকে ছিলেন চণ্ডীবাবু, তাঁর বক্তব্য ছিল, – ‘রকেট। রকেট ধুয়ে কোন্ জলটা খাবে শুনি? রকেট! তাও বুঝতাম যদি হ্যাঁ, এই আমাদের দেশেই তৈরি হল, গড়ের মাঠ থেকে ছাড়লে সেটা চাঁদে-টাদে তাগ করে, আমরা গিয়ে টিকিট কিনে দেখে এলুম, তাও একটা মানে হয়।’ – আর অন্যদিকে আড্ডার মাথা যিনি, সেই শ্রীপতিবাবু বলেছিলেন, – ‘দেখ, বাইরের গ্রহ থেকে যদি লোক আসেই, তবে এটা জেনে রেখো তারা এই পোড়া দেশে আসবে না।… আমার বিশ্বাস তারা সাহেব, এবং এসে নামবে ওই সাহেবদেরই দেশে, পশ্চিমে। বুঝেছ?’
এই যে একদিকে বাইরের জগৎ সম্পর্কে চরম তাচ্ছিল্য ও ঔদাসীন্য, আর অন্যদিকে পশ্চিমি সভ্যতা সম্পর্কে অন্ধ ভক্তি এবং সমান্তরাল অজ্ঞতা, – এই হল, মোটের ওপর, যুগে যুগে বাঙালীর প্রোফাইল।
বাঙালীর জাতীয় কবি যদিও ঘোষিতভাবে রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাঙালীর আত্মার আত্মীয় যিনি তিনি হলেন ঈশ্বর গুপ্ত। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা পড়লে বোঝা যায়, একদিকে যেমন কবি চরম উইটি, অন্যদিকে তেমনই চরম প্যারোকিয়াল। বাঙালী কিন্তু ঠিক এইই। বাঙালী না রবীন্দ্রনাথের কদর করেছে, না রাখালদাস ব্যানার্জীর। বাঙালী সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে যতটা আদিখ্যেতা করেছে, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে নিয়ে তার একশোভাগের এক ভাগ করেনি একমাত্র এই কারণে যে সত্যেন বোসকে বুঝতে গেলে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতে উঠতে হয়। বাঙালী গোলাপ-মা যোগীন-মায়ের নাম জানলেও জানতে পারে, কিন্তু ছড়াকাটা বাঙালী কোনোদিন বিমল মুখোপাধ্যায় বা রাধানাথ সিকদারের নাম জানবে, এটা আশা করা মারাত্মক অন্যায়।
সত্যজিৎ রায় বাঙালীর এই ফোবিয়া জানতেন, তাই চেষ্টা করেছিলেন ফেলুদার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে টিনটিনকে বাঙালীর কাছে পৌঁছে দেবার। ময়ূখ চৌধুরী তাঁর কমিকসে সুরেশ বিশ্বাসকে ফিচার করেছিলেন। বাঙালী না মনে রেখেছে ময়ূখ চৌধুরীর মতো আর্টিস্টকে, না মনে রেখেছে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসকে। বাঙালী পাঠকের বোকা মন ভেজাবার জন্য বাঙালী প্রকাশক নারায়ণ দেবনাথের অনবদ্য সাদাকালো আর্টে জোর করে রঙ চাপিয়ে উৎকটদর্শন কালারড এডিশন বার করেছে।
এই হল বাঙালীর সমস্যা। বাংলা মিডিয়ামে থাকা বাঙালীর সমস্যা নয়, বাঙালীর সমস্যা মিডিয়াম থাকা। বাঙালী কোনোদিন শুনতে চায় না তার সীমার বাইরে কী আশ্চর্য দিগন্ত পড়ে আছে। বাঙালী জানতে চায় না হ্যারি পটার নিয়ে কেন সারা পৃথিবী পাগল, বাঙালীর বুঝে দরকার নেই ‘স্পেকুলেটিভ ফিকশন’ খায় না মাথায় মাখে। ‘প্যারাসাইট’ সিনেমাটা নেহাত কোরিয়ান ‘সদা সত্য কথা কহিবে’, নাকি আসলে অন্য কিছু, সে নিয়ে না ভাবলে বাঙালীর একেবারেই কিছুই এসে যায় না।
তাই বাঙালী কালও ঘেন্না কুড়োত, আজও ঘেন্না কুড়োবে। কাল যে ব্যবসার নামে ঠোঁট বাঁকিয়েছে, আজ তাকে অসৎ ব্যবসায়ীর মুখ থেকে ‘কাঙালী’ বিশেষণ শুনতে হবে। – হয়তো অন্যায়, হয়তো এতটা কুকথা শোনার মতো অপরাধী আমরা নই। আমাদের দরজায় তালা ছিল না, কিন্তু চুরির দায়টা হয়তো চোরেরই। কিন্তু বোকামির দায়টা এড়াব কী করে?
(শেষ)