আমাদের দেশে ইংরেজী শেখানো হয় গ্রামার বই পড়িয়ে। যে ভাষা গ্রামার বই পড়িয়ে শেখানো হয়, মানুষ সেই ভাষায় কোনোদিন সাবলীল হতে পারে না।
একদিন একজন স্টাডিহলে হ্যারি পটার পড়ছিল, দেবাশিসদা ধরেছিলেন। ধরে যখন দেখেন যে ছেলে পড়ছে হ্যারি পটার, তখন হেবি খুশী হয়ে স্টাডিহলে প্রায় ঘোষণার সুরে বললেন, হ্যারি পটার? যাও পড়ো গিয়ে! অ্যায় শোনো, হ্যারি পটার খুব ভালো বই, সবাই পড়বে। পড়লে ভালো ইংরেজী শিখতে পারবে।
দুঃখের কথা, এই ভাবনা সবার থাকে না। দৈবাৎ যদি বা মাস্টারমশাইয়ের থাকে, বাপ-মায়ের থাকে না। তারা শুধু বাচ্চাকে রেনঅ্যান্ডমার্টিন বা পিসিদাস কিনে দেয়, আর নাইনে উঠলে কোচিং-এ ভর্তি করায়। ‘ডাক্তারবাবু আমার বাচ্চাকে ভালো করে দিন।” এটা বাংলার দোষ নয়। এটা একটা অনেক পুরোনো, অনেক গভীর ব্যাধি।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এক বেচারি ছাত্রের কথা, সে নদীর সংজ্ঞা মুখস্থ বলতে পারত, কিন্তু নদী কী বস্তু তা জানত না, যদিও তার বাড়ি গঙ্গার কাছে। এই যে পৃথিবীর আর বইয়ের মধ্যেকার দূরত্ব, আমাদের জীবন আর আমাদের দর্শনের মধ্যে এই যে আশ্চর্য ফারাক, এরই এক রূপ আমাদের গ্রামার বই আঁকড়ে ইংরেজী শেখা।
যেকোনো ভাষা শেখা যায় তা শুনে, তা বলে এবং তা লিখে। কারণ শোনা, বলা এবং লেখার বাইরে একটা ভাষার কোনো অস্তিত্ব নেই, কোনো দায়িত্বও নেই। ইংরেজী যদি কাউকে শিখতে হয়, তাহলে তাকে বাচ্চাবয়সে ইংরেজী বই আর ইংরেজী ক্যাসেট – এখনকার দিনে ইংরেজী অডিওবুক বা মুভি – ধরিয়ে দিতে হবে। অনেকে এটা শুনে আঁতকে ওঠে কারণ ইংরেজী মুভি শুনলে তাদের মনে ন্যুড সীন ভেসে ওঠে। সেসব হোপলেস কেস, সেকথা বাদ থাক। আসল কথা হল, ছোটো থেকে যদি ভাষাটাকে বাচ্চার কাছে স্বাভাবিক করে তোলা না হয়, তাহলে সে কোনোদিনই সে ভাষাটাকে আপন করে নিতে পারবে না। যদি আমি চাই যে ছেলেটা ইংরেজীতে ভালো হোক, তাহলে তাকে ছোটো থেকে হান্স অ্যান্ডারসন পড়াতে হবে, স্কুবি ডু দেখতে দিতে হবে, হ্যারি পটার কিনে দিতে হবে।
যেসব ছেলেমেয়েরা বাংলা মিডিয়ামে পড়ে তারা কি সবাই বাংলায় ভালো হয়?
না, হয় না। তাদের অনেকেই ‘শুখ শ্বপনে সান্তি শ্বষানে’ পর্যায়েই থেকে যায়। কারণ তাদের বাড়ির লোকও তাদের ছোটো থেকে কোনোদিন উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, বা লীলা মজুমদার কিনে দেয়নি। তাদের বাংলার ইনপুট বাড়ির আটপৌরে কথোপকথন আর বাংলা সিরিয়ালের রিপিটেড মূঢ়ভাষণেেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।
সেরকম বাংলা মিডিয়াম হোক বা ইংলিশ মিডিয়াম, ছোটো থেকে ঠিকমতো এক্সপোজার না পেলে কোনোদলই ইংরেজী শিখে ওঠে না। ইংরেজীর দল যেটা শেখে সেটা হল পশ্চিমিপনা, আর সেটা আসে হলিউডি সংস্কৃতির হাত ধরে। তাতে ঘাড় ঝাঁকিয়ে ‘ফাক’ বলা হয়, কিন্তু শেক্সপীয়ারও হয় না, ট্যারান্টিনোও হয় না।
আর যারা আধুনিক বাংলায় জন্মে ভাগ্যক্রমে হয় শুধু উপেন্দ্রকিশোর হাতে পায় কিন্তু গ্রিম ব্রাদার্স পায় না, অথবা হ্যারি পটার হাতে পায় কিন্তু চাঁদের পাহাড় পায় না, – তারা অর্ধেক রাজ্যের পাসপোর্ট বুকে নিয়ে একতরফাভাবে বড় হতে থাকে। এটা কেটে যেতে পারে কোনো সহৃদয় শিক্ষকের সাহচর্যে, বা বন্ধুদের সাহায্যে, বা স্রেফ বাবা-মায়েরই উৎসাহে, যেখানে বাবা-মা নিজেরা ইংরেজীতে দুরস্ত না হলেও সংস্কৃতি ভালোবাসেন বলে সন্তানের কাছে সাধ্যমতো উপকরণ এগিয়ে দেন। উল্টোটা সম্ভবত কম হয়, যে বাঙালী বাবা-মা নিজেরা বাংলা ব্যবহার করেন না, তাঁরা বাচ্চাকে বাংলা শেখানোর জন্য বড় একটা আগ্রহ দেখান না। তাঁদের পথ প্রবাসী বাঙালীর পথ।