বাংলা মিডিয়ামে শিফ্ট করার পরে একটা মজা হল, সেটা ঠিক প্রাসঙ্গিক না হলেও গল্প হিসেবে কৌতুককর। আমি নার্সারী থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে আসছি, হঠাৎ ক্লাস ফোরে বিদ্যাপীঠে ঢুকে বাংলা মিডিয়ামে এসে পড়েছিলাম। ফলে, গণ্ডগোল হত। আমি ফোরের ফাস্ট পিরিওডিক্যাল পরীক্ষায় অঙ্কে পঞ্চাশে পঞ্চাশ পাইনি একমাত্র একটা ভুলের জন্য — ইংরেজীর আট আর বাংলার চার গুলিয়ে ফেলেছিলাম। সেসব ট্র্যাজেডির কথা থাক। অন্য যে গোলমালটা হয়েছিল, আমি ডন বস্কো থেকে সদ্য আসার দরুণ ইংলিশে বাকি সেকশনমেটদের তুলনায় খানিকটা বেশী স্বচ্ছন্দ ছিলাম। বাকিরা সবাই তুখোড় তুখোড় ছাত্র, ভালো স্টুডেন্ট না হলে পুরুলিয়া বিদ্যাপীঠে ঢোকা যেত না (মানে, *হ্যাঁচ্চো* ডোনেশন ছাড়া *হ্যাঁচ্চো*) কিন্তু ইংরেজীর ব্যাপারে প্রায় সবাইই একটু নার্ভাস। আমি নই। ফলে পরীক্ষায় আমি হায়েস্ট পেলাম, আর রটে গেল যে আমি ইংরেজীতে হেবি ভালো।
এই নামডাক আমার পুরো ফোর, ফাইভ ধরে টানা থেকে গেল। তারপর মিডিয়াম চেঞ্জ করে গেলাম ইংলিশ মিডিয়ামে। আর এইবার কয়েকমাসের মধ্যে রটে গেল, আমি নাকি বাংলায় হেবি ভালো।
আসলে দুটোতেই মিডিওকার, খুব বড়জোর বলা যায় বেটার দ্যান অ্যাভারেজ। আসল কথা হল পেঙ্গুইন। পাখিরা যদি ভাবে ব্যাটা হেবি সাঁতারু, মাছেরা ভাবে ব্যাটা কেমন হাঁটতে পারে। আমি বাংলা আর ইংরেজীর পেঙ্গুইন হয়ে থেকে গেলাম। – এবং এই বিচিত্র মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে কয়েকটা জিনিস দেখেছিলাম, যা সত্যিই খুব অদ্ভুত।
ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেরা বাংলা মিডিয়ামকে খানিকটা ‘ছোটলোক’ ভাবত। – দুম করে লিখলাম ঠিকই কিন্তু সোজা কথাটা এটাই দাঁড়ায়। এই শ্রেণীবিন্যাস সব দেশে সব কালে ছোটোদের মধ্যে আছে। গায়ে জোর থাকলে তার সম্মান বেশী; বড় গাড়িতে স্কুলে এলে তার সম্মান বেশী; দামী স্পাইক (ফুটবল বুটকে আমরা ‘স্পাইক’ বলতাম) থাকলে তার সম্মান বেশী। আজকাল ‘চাইল্ড ওয়ার্শিপ’-এর ঠেলায় আমরা বাচ্চাদের স্বচ্ছ চোখে দেখতে ভুলেছি। জে কে রোলিং-এর লেখায় এই শ্রেণীবিন্যাস হগওয়ার্টসে বার বার চোখে পড়ে। ড্র্যাকো ম্যালফয় আর রন উইজলির দ্বন্দ্ব আসলে এই ইংরেজী-বাংলা দ্বন্দ্বেরই রূপান্তর।
একদিন একজন খুব কাছের বন্ধু গল্প করতে করতে খানিকটা আনমনা গলায় বলেছিল, “And that’s why there’s always going to be a thin red line… between English medium and Bengali medium.” আমার কথাটা ভালো লাগেনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন বললি। বোঝা যাচ্ছিল কথাটা ও উত্তেজনাবশত বলেনি, বরং বেশ গভীর কোনো প্রত্যয় থেকে বলেছে। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে ও যা বলেছিল তাতে কোনো বিশেষ যুক্তি ছিল না। সেই একই কথা। বাংলা মিডিয়ামওয়ালারা বড্ড ওঁচা, বড্ড বোদা। ওদের মধ্যে সেই শার্পনেসটা নেই। সেই টেস্ট-টা নেই।
ওঁচা, বোদা, শার্প, টেস্টফুল। – আমাদের ক্লাসের কথা যদি ধরা হয়, সবচেয়ে প্রতিভাবান যারা ছিল তারা বেশীরভাগ সবাই বাংলা মিডিয়ামেই ছিল। ক্লাসে যে (এমনকী, যারা) ফার্স্ট হত সে বাংলা মিডিয়াম, যে সবচেয়ে ভালো ফুটবল খেলত সে বাংলা মিডিয়াম, যে স্পোর্টসে সবচেয়ে বেশী ট্রফি আনত সে বাংলা মিডিয়াম, যে সবচেয়ে ভালো ক্যুইজ করত সে বাংলা মিডিয়াম, যে সবচেয়ে ভালো গাইত সে বাংলা মিডিয়াম, যে সবচেয়ে ভালো তবলা বাজাত সে বাংলা মিডিয়াম, যে সবচেয়ে ভালো আঁকত সে বাংলা মিডিয়াম। যে সবচেয়ে ভালো লিখত-টা বললাম না, কারণ বাংলা আর ইংরেজী দুই ভাষায় তার লিস্ট আলাদা হবে। কিন্তু বাংলা মিডিয়ামে এমন অনেক ছেলে ছিল যাদের ইংরেজী ইংলিশ মিডিয়ামের অনেক ছাত্রদের চেয়ে ভালো। এই ইংলিশ মিডিয়ামওয়ালারা ইংলিশ সিনেমা দেখায় বাংলাওয়ালাদের থেকে বেশী অভ্যস্ত হলেও, এক পাতা ইংরেজী লিখতে দিলে ভালো ম্যানেজ করতে পারত না।
শেষ যে লাইনটা লিখলাম সেটার মধ্যে একটা দু’মুখো সমস্যা লুকিয়ে আছে। সেটা ঠিক করতে পারলে আমাদের ইঙ্গ-বঙ্গ সমস্যার অনেকটা সুরাহা হয়ে যেত।