ইংরেজী/বাংলা (১)

বাংলা মিডিয়াম আর ইংলিশ মিডিয়ামের দ্বন্দ্বটা পুরোনো। এই নাটক এখন চলছে, আমি যখন স্কুলে ছিলাম তখন চলত, আমার স্কুলে ঢোকার বহু আগেও নিশ্চয়ই চলেছিল, দাদারা চাইলে ঢের গল্প শোনাতে পারবেন।

দ্বন্দ্ব কথাটা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম। স্কুলে বাংলা ক্লাসেই শেখা, দ্বন্দ্ব শব্দের মানে যেমন বিরোধ হয়, তেমন মিলমিশও হয়। সেই ঈশ্বরী পাটনির গল্পে লাইন ছিল, “কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।” – আমাদের দেশে বাংলা আর ইংরেজীর সম্পর্কটা দুই অর্থেই দ্বন্দ্বের।

ইউট্যুবে খুঁজলে চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের খান দুই তিন বক্তৃতা পাওয়া যায়, যাতে চন্দ্রিল বাঙালীর ইংরেজীপ্রিয় (এবং হিন্দীপ্রিয়) স্বভাব নিয়ে বলেছেন। ইংরেজী বলা-কওয়ার মধ্যে একটা সাহেবিয়ানার গন্ধ আছে, বাঙালী তার মধ্যে একটা উচ্চবর্ণের ছাপ দেখতে পায়, সেই সাহেবিয়ানা যে মেকি সাহেবিয়ানা সেসব দিকে কারো নজর যায় না। – এটা কোনো রহস্য নয়, আমাদের ওপর ইংরেজরা – বলা ভালো ইউরোপীয়রা – কয়েক শতক রাজত্ব করে গেছে। ওদের জিনিসকে উন্নত বলে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত, সেটা বাস্তবে উন্নত হোক আর না হোক। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে টাকাপয়সা, জড়িয়ে আছে শিক্ষাদীক্ষা, জড়িয়ে আছে আরো প্রচুর ছোটোখাটো ব্যাপার। কলেজে প্রফেসাররা বলেন, পোস্টকলোনিয়াল হ্যাঙওভার।

আমাদের দেশে রীতি, পয়সা থাকলে বাপ-মা সাধারণত বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে দেয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এই হয় যে ইংলিশ মিডিয়াম বাচ্চারা গড়ের ওপর বাংলা মিডিয়ামওয়ালাদের চেয়ে বেশী বড়লোক হয়। তাদের জামাপ্যান্ট, টিফিন, ব্যাগ, স্কুলে আসার বন্দোবস্ত – সবেতেই সেই তফাৎটা ফুটে বেরোতে চায়। আর সেসব যদিও বা মাইক্রোডিফারেন্স, একেবারে ম্যাক্রো হয়ে দেখা দেয় যেটা – তা হল মুখের ভাষা আর বিভিন্ন ব্যাপারে স্বাভাবিক রুচির তফাৎ। এটা মাস্টারমশাইরা যতটা লক্ষ্য করেন, বাচ্চারা নিজেরা লক্ষ্য করে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশী। সেই দিয়ে তারা নিজেরা সবাই সবাইকে মাপতে থাকে।

মানে, টিফিনে স্যান্ডউইচ না মুড়ি, সেটা একটা প্যারামিটার হয়ে দাঁড়ায়। পায়ে কিটো না হাওয়াই, সেটা একটা প্যারামিটার হয়ে দাঁড়ায়। মেটালিকার নাম শুনেছে না শোনেনি, সেটা প্যারামিটার হয়ে দাঁড়ায়।

স্বাভাবিক রুচির তফাৎটা হয়ে যায় গুণগত মান নির্ধারণ করার মাপকাঠি। – এটার কোনো মানে যে হয় না তা বলাই বাহুল্য। আমারই একদল ছেলেমেয়ের সাথে গল্প হচ্ছিল। একজন বলল, আচ্ছা বব রস-এর নাম তো শুনেছিস? সেই শুনে আরেকজন হেসে উঠে বলল, ভাই বব রস-এর নাম কে শোনেনি! আমি বললাম, যে আমেরিকান টেলিভিশন দেখে বড় হয়নি সে-ই শোনেনি! – তখন ওরা বলল হ্যাঁ, তা ঠিক কথা। – এই ব্যাপারটা। আমাদের স্কুলে থাকাকালীন এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয় ছিল হ্যারি পটার। একদল বলত, – আজকালকার বাচ্চারা আর ঠাকুরমার ঝুলি পড়ে না, খালি হ্যারি পটার, বাঙালী কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। আরেকদল বলত, রাখ ঠাকুরমার ঝুলি, গেঁয়ো মাল, কে পড়ে ওসব, মডার্ন হ। – প্রবলেমটা হল, দুই পক্ষই ভুল। ওভাবে হয় না। যে যেরকম পরিমণ্ডলে বড় হয়ে উঠেছে সে সেরকম বই হাতের কাছে পেয়েছে। তফাৎটা হরাইজন্টাল, ভার্টিকাল নয়।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলি। আমি বাংলা আর ইংরেজী, দুই মিডিয়ামেই পড়েছি। বাড়ি থেকে ছোটোবেলায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দেওয়া হয়েছিল। তারপর যখন পুরুলিয়া বিদ্যাপীঠে ভর্তির চেষ্টা হল, তখন ইংলিশ মিডিয়ামেরই ফর্ম তোলা হয়েছিল। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামে সীট কম, আমি শেষমেষ ঠাঁই পেলাম বাংলা মিডিয়ামে।

বলা হল, ক্লাস ফোরটা বাংলা মিডিয়ামে পড়ো, যদি রেজাল্ট ভালো হয়, তাহলে একবছর পরে ইংলিশ মিডিয়ামে ট্র্যান্সফার করা হবে। রেজাল্ট ভালো মানে, অঙ্কে আর ইংরেজীতে ভালো নম্বর, ৮০% না কত যেন।

সবাই মজাটা বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই। বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে যেতে গেলে ইংরেজীর নম্বর মাপা হবে এটায় খুব আশ্চর্যের কিছু নেই, কিন্তু অঙ্কের প্রসঙ্গ এল কোথা দিয়ে? – চিন্তাটা খুব পরিষ্কার, ইংলিশ মিডিয়ামটা আসলে উন্নততর মিডিয়াম। ওখানে যেতে গেলে শুধু ইংরেজীতে বেটার হওয়াটা যথেষ্ট নয়, ছাত্র হিসেবেই বেটার হওয়া দরকার। – আমার স্কুল দেশের সেরা স্কুলগুলোর মধ্যে একটা ছিল। সেখানেও এই সার্কাস। যাইহোক, সেসব কাটিয়ে আমি কোনোমতে ক্লাস ফাইভে না – আরেকবছর কালা নেটিভ বাংলা সেকশনে কাটিয়ে তারপর ক্লাস সিক্সে ইংলিশ মিডিয়ামে শিফ্‌ট করলাম।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *