আজ কাল পরশু (১)

 
টার্টলস ক্যান ফ্লাই
ক্লাউড অ্যাটলাস
অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক
গোরা
কালচারাল হেজিমনি
হাউলস লিভিং ক্যাসল
প্রমিথিউস আনবাউন্ড
দান্তে আলিঘিয়েরি
নাজিম হিকমত
ইয়াসমিন হামদান

একটা সুরেলা কন্ঠস্বর পর পর নামগুলো বলছিল, আর আমি ঝড়ের গতিতে লিখছিলাম। সামনে ড্যাশবোর্ডের উপরে একটা ক্যাসেট পড়ে আছে, একটা গোলাপফুল,তার পাশে একটা নিকোটিন চুইংগাম,আর একটা রিভলবার। পাশে গুল কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে গাড়ি চালাচ্ছে।



কোনোরকম ভণিতা না করে প্রথমেই একটা কথা সোজাসুজি বলে দেওয়া ভাল,আমরা পালাচ্ছি। সারা কলকাতাজুড়ে এখন যাকে বলে দাঙ্গা চলছে। স্যাফ্রনিস্টরা হাতে চাপাতি- ত্রিশূল- পেট্রোলের ক্যান নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, লুঠপাট চালাচ্ছে, আগুন লাগাচ্ছে। কাল রাতে শোভাবাজারের বেশ খানিকটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, গিরিশ পার্ক অবধি, আর এদিকে রাজাবাজার। অন্যজাতের লোক দেখলেই হয় চাপাতির কোপ, নয় জ্বালিয়ে দেওয়া। আর যদি মেয়ে হয়,একইসঙ্গে কমবয়সী, তাহলে আগে ছিঁড়ে খাও,তারপর হয় মেরে ফেল, নয় তুলে নিয়ে যাও।পুলিশ শুধু যে চুপ তা-ই নয়, উল্টে ওরাও হাত মিলিয়েছে
স্যাফ্রনিস্টদের সঙ্গে, মহল্লাগুলো চিনিয়ে দিচ্ছে, স্পার্টাকানদের ডেরাগুলোর সুলুকসন্ধান বলে দিচ্ছে। কলেজ স্ট্রীট আর তার আশপাশ কাল রাত অবধি আমরা আটকে রেখেছিলাম গোটা পঞ্চাশেক মাস্কেট, খানকুড়ি রিভলবার, মলোটভ ককটেল আর দুটো এলএমজি-র উপর ভরসা করে, একটু আগে রেডিওতে শুনলাম স্যাফ্রনিস্টদের সঙ্গে নাকি আর্মিও হাত মিলিয়েছে, শিয়ালদা ব্রিজের ব্যারিকেড ভেঙে সূর্য সেন স্ট্রীটের অর্ধেকটা অবধি চলে এসেছে। আজ রাতের মধ্যে যদি মেশিনগান আনতে না পারে জো-রা, গ্রামশিস্তাদের গল্প এখানেই শেষ, কলকাতারও। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে একটা সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বসানো নিয়ে যে আন্দোলনের শুরু, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল রুটিরুজি আর বেঁচে থাকার দাবি সেটাকে চুপ করাতে যে এরকম একটা অবস্থা তৈরি করবে সরকার, সেটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি।

আমরা এখন ওড়িশা ঢুকব ঢুকব করছি। ধূ ধূ মাঠের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, ইতিউতি ছোট্ট ছোট্ট চালাঘর, ন্যাড়া মাঠের মধ্যে দাঁড়ানো খেজুরগাছ দেখা যাচ্ছে। পরের পর ফুটিফাটা ক্ষেত,ফসলের নামগন্ধ নেই। বছরের পর বছর অনাবৃষ্টিতে, খরায় চাষ মার খেয়েছে, চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে মরেছে চাষীরা। এই অঞ্চল এখন তেপান্তরের মাঠ মানুষ নেই, জন নেই, এমনকি রাক্ষস-খোক্কস-দত্যি-দানো কিচ্ছু নেই। আছে শুধু মাঠভর্তি হাহাকার আর পরের পর চাষীর ভিটেমাটি ছাড়ার গল্প, গলায় দড়ি দিয়ে মরার গল্প, পেটের জ্বালায় সন্তানকে বেচে দেওয়ার গল্প, কেটে খাওয়ার গল্প।

গুল জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চুইংগামটা ফেলল, তারপর আমাকে ইশারা করল, ‘আর একটা দে।’ আমি প্যাকেট ছিঁড়ে আর একটা চুইংগাম বের করে ওর হাতে দিলাম। গুল চুইংগামটা মুখে পুরে জিগ্যেস করল, ‘শুনে কিছু বের করতে পারলি?’
আমি ঘাড় নাড়লাম। ‘নাহ্‌’।
‘কিচ্ছু না?’
‘নাথিং’, আমি বললাম, ‘জাস্ট কয়েকটা নাম সিনেমা, কবি, কবিতার বই, সিঙ্গার, তত্ত্ব এর বেশি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’
গুল কিছু না বলে আলতো হাসল। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে আমি ওর ঝকঝকে রুপোলি গজদাঁতটা দেখতে পেলাম। বাঁহাতজোড়া ট্যাটু, বাঁচোখের কোলে একটা গভীর কাটা দাগ, ডানহাতটা নেই, তার বদলে একটা সাইবারনেটিক আর্ম লাগানো, সেটাকে আবার কন্ট্রোল করে মাথার বাঁদিকে বসানো একটা মাইক্রোচিপ। বছরদুই আগে শিলচরে একটা মলোটভ ককটেল ফেটে ওর ডানহাতটা উড়ে গেছিল, তারপর আমাদের হিলাররা ওকে এটা বানিয়ে দিয়েছে। গুল এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক, এমনকি আমার থেকেও। এই হাত নিয়েই ও এলএমজি চালায়, বেস বাজায়, লেখে, সব করে।

‘সাহানা—’ গুল রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা একটা বড় পাথরের টুকরোকে কাটিয়ে বলল, ‘ম্যাপটা বের করে দ্যাখ তো খুরদা কত কিলোমিটার।’
‘কেন, জিপিআরএস কাজ করছে না?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘নাহ্‌’, গুল ঘাড় নাড়ল, ‘গাড়িরটা অনেকদিন ধরেই খারাপ, তার উপর কাল ফোনটাও গুলি লেগে গেছে। তোরটা আস্ত আছে?’
‘মনে তো হয়।’ আমি বললাম।

গুল হঠাৎই দেখি গাড়ি থামাল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
‘গাড়ি থামালি কেন?’
গুল ওর সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বলল, ‘যদ্দূর মনে পড়ছে ঈশান বলেছিল গাড়ির ডিকিতে একটা এমার্জেন্সি বক্স আছে। সেটা একবার দেখব। তাছাড়া সেই ভোরবেলা গাড়িতে উঠেছি, এখনও ড্যাশবোর্ড আর সামনের পেছনের সিট ছাড়া কিছুই দেখিনি। একবার গাড়িটাও তো দেখা দরকার।’
‘তো সেই ছানমিনটা সন্ধ্যেবেলা কোনো একটা মোটেলে আস্তানা গেড়ে করলে হত না?’
গুল দেখি ছোট্ট হেসে হাত বাড়িয়ে আমার থুতনিটা ধরে নেড়ে দিল। ‘মোটেই না শানু ডার্লিং, এখনই। দরকার আছে।’

আমরা ডিকি খুললাম। পাশাপাশি দুটো বড়সড় ট্রাঙ্ক রাখা, দুটোতেই সাত লিভারের তালা ঝোলানো। গুল দেখি চাবি-টাবি খোঁজার ধার দিয়েও গেল না। একটা হ্যাঁচকা টান দিল প্রথম ট্রাঙ্কটার তালা ধরে, ট্রাঙ্কটা হাঁ করে খুলে গেল। একটা একে ৪৭ রাখা, একটা সাবমেশিনগান, ব্রুগার অ্যান্ড থমেট এমপি ৯, একটা এলএমজি, স্টোনার ৯৬, দুটো নাইন এম এম পিস্তল, গ্লক ৪৩, আর থরে থরে সাজানো ম্যাগাজিন। গুল আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
‘মোটেলের সামনে এগুলো খুলতে পারতি তো?’
‘সে আমি কি করে জানব, ঈশান এত অ্যামুনিশন ভরে দেবে?’ আমি বললাম।
গুল কোনো উত্তর না দিয়ে পরের ট্রাঙ্কটা খুলল। এই ট্রাঙ্কটা ভর্তি বই, তার সঙ্গে একটা স্যাটেলাইট ফোন। গুল স্যাটেলাইট ফোনটা তুলে নিল, আমি বইগুলো দেখতে লাগলাম। একটা ক্যাপিটাল, একটা হিস্ট্রি অফ প্যারিস কমিউন, ইনফার্নো, বনলতা সেন, গল্পগুচ্ছ, দ্য টেমপেস্ট- আমাদের লাইব্রেরিতে যা যা দুষ্প্রাপ্য বই ছিল, সব ওরা ঢুকিয়ে দিয়েছে এখানে। আমি ডিকি বন্ধ করে উঠে পড়লাম। গুল দেখি চিন্তিতমুখে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘ফোন ধরল না?’
গুল ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল, ‘নাহ্‌, নো ওয়ান। না ঈশান, না জো, না আজিদ বা।’
‘চিন্তা করিস না,’ আমি বললাম, ‘অত গণ্ডগোলের মধ্যে নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি। চিল্‌, সময় হলে ওরাই ঠিক ফোন করে নেবে।’
‘হোপ সো।’ গুল চুইংগামটা ফেলে দিয়ে গাড়িতে উঠল।


বললাম বটে চিন্তা করিস না, কিন্তু আমিই কি কম চিন্তা করছি! ভাগ্যিস ঈশান আর নীলু দীর্ঘদিন ধরে তলে তলে অ্যামুনিশন জড়ো করছিল, নইলে গতকাল যে আমাদের কি হত, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। গণ্ডগোলটা যখন শুরু হয়, আমি তখন কলেজ স্ট্রীটের ফুটপাতে, বই কিনছি। এরকম যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, তার কোন আঁচই পাইনি। হঠাৎ দেখি গুল ফোন করেছে। ফোনটা জাস্ট কানে ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে গুলের চিৎকার, ‘কোথায় তুই?’
আমি শান্তভাবেই উত্তর দিলাম, ‘কলেজ স্ট্রীটে। কেন,কি হয়েছে?’
‘দাঙ্গা।’
‘হোয়াট!’ আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, ‘কি ভুলভাল কথা বলছিস তুই? এখানে…’
গুল আমার কথাটা শেষ হতে দিল না। ‘ওসব পরে হবে। তুই এক্ষুণি ক্যাম্পাসে ঢোক। আমি দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছচ্ছি।’
আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। চারপাশে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে,বেশ কয়েকবার ‘স্পার্টাকান, স্যাফ্রনিস্ট, হালাল’ জাতীয় শব্দগুলোও কানে এল, ক্যাম্পাসের দিকে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় কোথা থেকে দেখি ঈশান এসে আমার হাত চেপে ধরেছে।
‘সাহানা’, ঈশান রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘উই আর ডুমড। দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে।’

এরপর ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঢুকতে ঈশান আমাকে একটা ব্রিফ দিল। যাদবপুর ক্যাম্পাসে ট্যাঙ্ক বসানো নিয়ে দিনকয়েক আগে ঝামেলা, মিছিল ইত্যাদি হয়েছিল, আজ সকালে স্যাফ্রনিস্টরা তার পালটা একটা মিছিল করে, তারপর যাদবপুর ক্যাম্পাসে ইঁটপাথর ছোঁড়ে। পুলিশ কোনোরকম ব্যবস্থা নেয়নি, বরং চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা বাইরে বেরিয়ে আসে, একটা হাতাহাতি হয়, তারপর স্যাফ্রনিস্টরা আশেপাশের দোকানপাট ভাঙচুর করতে শুরু করে, আগুন লাগায়। সেই শুরু। স্যাফ্রনিস্টরা ঠিক করেই রেখেছিল আজ শহরজুড়ে কিছু একটা করবেই, অতএব প্রায় একইসঙ্গে রাজাবাজার, পাতিপুকুর আর শোভাবাজারেও গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। একটা ছোট্ট ‘ফাক’ দিয়ে ঈশান ব্রিফটা শেষ করল।
‘গুল কোথায়?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘অলমোস্ট ঠনঠনিয়া; চলে এল বলে।’
ঈশানের কথা শেষ হতে না হতেই দেখলাম বিশাল দুটো ক্যানভাসের ব্যাগ নিয়ে রফি আর তনুময় ঢুকছে,ওদের পেছনে গুল। সারা ইউনিভার্সিটিতেই দাঙ্গার খবর ছড়িয়ে গেছে, ছেলেমেয়েরা সবাই পোর্চে নেমে এসেছে, এমনকি প্রফেসররাও, ক্যাম্পাসের বাইরে রাস্তাজুড়ে সবাই পাগলের মত ছোটাছুটি করছে, এমন সময় গুলকে দেখে সবাই চুপ করে গেল। গুল একবার সবাইকে দেখল, আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট হাসল, তারপর গলাটা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকপর্দা তুলে বলল, ‘কমরেডস্‌,দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে।’

এই একটা কথাতেই ক্যাম্পাসের ভেতরের তো বটেই, ক্যাম্পাসের বাইরের সব মানুষজনও থেমে গেল। গুল বলতে লাগল, ‘এখন প্রোপাগান্ডা বা ফালতু বকার সময় নয়। স্যাফ্রনিস্টরা খোলাখুলি মানুষ মারছে। এরমধ্যেই প্রায় ষাটজন খুন হয়েছে, শেইলাকে তুলে নিয়ে গেছে, যাদবপুরে ক্যাম্পাসের মধ্যেই কুমার আর আজাদকে থেঁতলে মেরেছে ওরা। সবচেয়ে ভয়ের যেটা, সেন্ট্রাল-স্টেট- দু’জনেই খোলাখুলি ওদের সঙ্গে। বাট উই হ্যাভ টু পুট অ্যান এন্ড টু দিস। আমরা ওদের সঙ্গে লড়তে পারব না,কিন্তু আটকে রাখতে পারব,যাতে সেই সময়ে সাধারণ মানুষজন অন্তত নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে পারেন। উই সিক রিভেঞ্জ, বাট ফার্স্ট অফ অল,উই নিড টু মেক আ সেফ প্যাসেজ ফর কমনার্স। উই সিক রিভেঞ্জ, কজ উই আর দ্য ভ্যানগার্ড অফ হিউম্যানিটি, অ্যান্ড উই শুড অবলিটারেট দিস গ্রিমফেসড হোর‍্যাড। সো, হু উইল ভলান্টিয়ার?’

আমি ভেবেছিলাম অনেকেই হয়তো গুলের বিরোধিতা করবে, বিশেষ করে প্রফেসররা তো বটেই। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আজিদ বা এগিয়ে এলেন, গুলের পিএইচডি-র গাইড। রোগাটে চেহারার মাঝবয়েসি লোকটা মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন, তারপর শান্ত সমাহিত সুরে বললেন, ‘আমরা কিছু অ্যামুনিশন জোগাড় করেছি। যারা ভলান্টিয়ার হতে চাও, তারা প্লিজ এক এক করে নিয়ে যাও।’

এরপর মাঝশহরে একটা যুদ্ধ শুরু হল।


ছ’খানা ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে কলেজ স্ট্রীট ঘিরে। ঠনঠনিয়াতে একখানা, একখানা বৌবাজার মোড়ে- এইদুটোই সবচেয়ে বড়। বাকি চারটের একটা মেডিকেল কলেজের পাশে, একটা সূর্য সেন স্ট্রীটের শেষ মাথায়, একটা মহম্মদ আলি পার্কের পাশে, আর একটা আদি মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, তার শেষ মাথায়। কফিহাউস আর ইউনিভার্সিটি আমাদের ওয়ার বেস।
‘শিলচরেও এত ভাল বেস সাজাতে পারিনি, ‘আমাকে একটা অ্যাসল্ট রাইফেল ধরিয়ে দিয়ে বলল গুল, ‘জীবনের সেরা পজিশনাল ওয়ার হবে এটা। তবে সাহানা, তুই সবসময় আমার পাশে থাকবি, কক্ষনো কাছছাড়া হবি না। গট ইট?’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘আয় কমরেড।’
গুল আলতো হেসে আমার মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিল।


স্যাফ্রনিস্টদের সঙ্গে আমাদের প্রথম লড়াইটা হল মেডিকেল কলেজের পাশে। ওরা আগুন লাগাতে লাগাতে ঢুকে আসছিল রাস্তাটা ধরে, পথচলতি কাউকে যদি হালাল বা স্পার্টাকান মনে হয়, সোজা ত্রিশূল দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছিল, যথেচ্ছ হাতবোমা ছুঁড়ছিল এদিকে ওদিকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা হকারের গাড়ি,গোটা পঞ্চাশেক বালির বস্তা আর বেশ কয়েকখানা গাড়ি দিয়ে এদিকের ব্যারিকেডটা করা হয়েছে। ঈশান ওর মাস্কেটে টোটা ভরল, তারপর হলুদ ট্যাক্সির বনেটের গা ঘেঁষে খুব সন্তর্পণে বন্দুকের নলটা বের করল। মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা একটা লোক হাতে একটা চাপাতি নিয়ে আমাদের ব্যারিকেডের দিকে ছুটে আসছিল। ঈশানের ডানহাতের তর্জনী ট্রিগারে আলতো চাপ দিল, আমি কানে তালা ধরানো একটা শব্দ শুনতে পেলাম, আর তার ঠিক পরেই দেখলাম, লোকটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর চারপাশ।

তারপর ওরা আর বেশি এগোতে পারেনি। জনাদশেক ছিলাম আমরা এপাশে গুল, ঈশান, আমি, আরো কয়েকটা গ্র্যাজুয়েশনের ছেলেমেয়ে, খুব বেশি হলে পঞ্চাশ-ষাট রাউন্ড গুলি চালিয়েছি, আর একটা মলোটভ ককটেল ছুঁড়তে হয়েছে, তাতেই সব ভোঁ ভাঁ। বৌবাজারের দিক দিয়ে মোটামুটি সবাইকে বের করে দেওয়া হল, মানে যারা বেরোতে চায়, থেকে গেল মেরেকেটে দেড়শো-দুশোজন। তাদের মধ্যে জনাবিশেক মেডিকেল কলেজের ছেলেমেয়ে, তাদের বেশিরভাগই আমাদের, মানে গ্রামশিস্তাদের অ্যাপ্রেন্টিস হিলার, ইউনিভার্সিটির আশি-নব্বইজন, জনাদশ-বারো প্রফেসর, আর বাকিসব রাস্তার মানুষজন, বইয়ের দোকানের মালিক, চাওয়ালা, আমাদের ক্যান্টিন যিনি চালান সেই পেরুমল আন্না আর তার মেয়ে এরকমই। দুপুরের পর থেকে স্যাফ্রনিস্টদের সঙ্গে পুলিশও হাত মেলাল, তাতেও খুব একটা এঁটে ওঠা গেল না। বিকেলে আমাদের মধ্যে প্রথম কেউ মারা গেল- বাংলা ডিপার্টমেন্টের শ্রীতমা। বেশি উৎসাহে ব্যারিকেডের উপরে উঠে গেছিল ও, ঠিক তখনই একটা ছিটকে আসা গুলি ওর কপাল ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। ধরাধরি করে শ্রীতমার দেহটা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হল, সাদা কাফনে ঢেকে দেওয়া হল মেয়েটাকে, আজিদ বা বিড়বিড় করে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, তারপর আমরা যখন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি শ্রীতমাকে ঘিরে, হঠাৎই পাশের যে রেডিওটা এতক্ষণ ঘরঘর করে বিশ্রী একটা শব্দ করে যাচ্ছিল, সেখান থেকেই পরিষ্কার একটা সুরেলা ঘোষণা শোনা গেল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, কলকাতায় স্যাফ্রনিস্টদের উপর লাগামছাড়া হামলার ঘটনায় তিনি খুবই চিন্তিত এবং ক্ষুব্ধ। আধাসামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্যাফ্রনিস্টদের সাহায্য করার জন্য। মেজর জেনারেল জানিয়েছেন আজ রাতের মধ্যেই দশ ব্যাটেলিয়ন সেনা পাঠানো হচ্ছে কলকাতায়, সঙ্গে চার ব্যাটেলিয়ন রিজার্ভ ফোর্স।’
রফি হাত বাড়িয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিল।

ঠিক এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে আর্মির সঙ্গে আমাদের প্রথম সংঘর্ষ হল। শুধু সংঘর্ষই না, আমরা একধাক্কায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেলাম। মহম্মদ আলি পার্কটা ওরা নিয়ে নিল, ওদের আটকাতে গিয়ে হাতেই মলোটভ ককটেল ফেটে নীলু মারা গেল, আশমিরা বিবিকে বাঁচাতে গিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেল পেরুমল আন্না। গুল আর আমি এখন সূর্য সেন স্ট্রীটে, ঝড়ের বেগে গুলি চালাচ্ছি, নতুন ম্যাগাজিন লাগাচ্ছি, আবার গুলি চালাচ্ছি। আমাদের সামনেই নীলাঞ্জনা ম্যাডাম মারা গেছেন, তনুময়ের বাঁহাতের দুটো আঙুল উড়ে গেছে, তবুও সেই হাত নিয়েই ও এখন কেরোসিনভর্তি বোতলে ন্যাকড়া গুঁজছে, মলোটভ ককটেল বানানোর জন্য। আমাদের পায়ের নিচে এখন কার্তুজের খোলের সমুদ্র।

দুটো নাগাদ দুপক্ষই মিনিটখানেকের জন্য থামলাম। আমি একটা আধভাঙা দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসলাম। গুল আমার ঠিক পাশেই বসল। আমি আলতো করে গুলের সাইবারনেটিক হাতটা ছুঁলাম।গুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল,হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। দেখি হন্তদন্ত হয়ে ঈশান আর জনি আসছে, ওদের সঙ্গে —
‘আজিদ বা, আপনি?’
আজিদ বা গুলের জিজ্ঞাসাটা জাস্ট এড়িয়ে গেলেন। ‘গুল, আই হ্যাভ অ্যান ইম্পর্ট্যান্ট টাস্ক ফর ইউ।’ জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দুটো ক্যাসেট বের করলেন আজিদ বা, তারপর সেগুলো গুলের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এই দুটো আমাদের প্রাণভোমরা। এর মধ্যে কোড ল্যাঙ্গোয়েজে কিছু জিনিস রেকর্ড করা আছে। আমি চাই এটা তুমি সামহাউ ঋষিকোণ্ডায় পৌঁছে দাও, কাল বিকেলের মধ্যে।’
‘কিন্তু বা আমি এখানেই লড়তে চাই।’ গুল বলল, ‘আই উড লাভ টু ডাই হিয়ার, বা। তাছাড়া আমি গেলে…’
‘এক, সাহানার কি হবে, আর দুই, ওরা সহজেই এই ব্যারিকেড ভেঙে ফেলবে, তাই তো?’ গুলের কথাটা বা-ই শেষ করে দিলেন। গুল মাথা নাড়ল।
‘দ্যাখো গুল,’ বা তাঁর ট্রেডমার্ক শান্তস্বরে বললেন, ‘আমরা যে হারবই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদি এখানেই, লড়তে লড়তেই মরে যাই তো ভাল, আর যদি ধরা পড়ি তখন কি হবে তুমি সেটা কল্পনাও করতে পারছ না। তুমি বড়জোর দু’ঘন্টা, খুব বেশি তিনঘন্টা আটকাতে পারবে। কিন্তু সকাল হলে ওরা যখন অল আউট ঝাঁপাবে, তখন? তোমাকে যে কাজটা দিচ্ছি, সেটা এইমুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ আমাদের গল্পটা বাকিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া,সবাইকে জানানো, কিভাবে হাতেগোনা কয়েকটা ছেলেমেয়ে, কয়েকটা মানুষ একটা দাঁতনখ বের করা নোংরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিল, মরতে ভয় পায়নি; তোমার কাজ আমাদের লিগ্যাসিকে বাঁচিয়ে রাখা। আর সাহানাকে নিয়ে ভেবো না, ও তোমার সঙ্গেই যাবে। জনি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছে, এখন আপাতত গণ্ডগোলের ভয় নেই, অন্তত ঘন্টাতিনেক, আমি চাই তোমরা এর মধ্যেই বেরিয়ে পড়ো, স্যাফ্রনিস্টরা কিছু বোঝার আগেই।’

গুল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জনি কাকে যেন একটা ফোন করল, মিনিটতিনের মধ্যেই দেখলাম একটা কালো হন্ডা সিটি চলে এল। আমি পায়ে পায়ে গুলের পাশে এসে দাঁড়ালাম, তারপর গুলের বাঁহাতটা চেপে ধরলাম। গুল একবার নীলাঞ্জনা ম্যাডামের প্রাণহীন দেহটার দিকে তাকাল, তারপর ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘আজিদ বা, শেলি না পড়িয়ে আপনি বরং গুছিয়ে প্রোপাগান্ডা করতে পারতেন; কিছু না হোক, নাম হত কিন্তু আপনার।’

আমরা দু’জনে গাড়িতে উঠে পড়লাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *