ম্যাপ

টুয়েলভে পড়ি তখন, বছর শেষের দিকে, মনে নেই হয়তো সময়টা পরীক্ষার পরই। বাবার সাথে গেটের কাছে, তখনও দেবযানের সামনের আমগাছটা কেটে দ্যায়নি, বিদ্যাপীঠের সাথে বায়োলজিক্যাল মাদারের তফাৎ হল এমনি মায়ের সাথে বাচ্চার একটা নাড়ীর যোগ থাকে, কিন্তু ক্যাম্পাসের সাথে আমাদের নাড়ীর যোগ অনেকক’টা চ্যানেল বেয়ে, ওই আমগাছটা একটা ছিল। কেটে দিয়েছে, আমরাও বিদ্যাপীঠের পেট থেকে বেরিয়ে পড়েছি অবশ্যি, বয়স বাড়তে বাড়তে সময় বড্ড বেশী তাড়া দেয়। কিন্তু সেই অনেকগুলো বছর আগেকার কথা, আমি আর বাবা সেই আমগাছটার কাছে, অনুপদার সাথে দেখা হয়েছিল।

হায়ারসেকেণ্ডারির পর কী করব কোন কলেজে ভর্তি হব, সেই কথা চলছে, কলকাতা কি না সেই পরামর্শ চাইছি অনুপদার থেকে। তখন অনুপদা আমাকে নিয়ে আক্ষেপ করে একটা কথা বলেছিলেন, মাথায় অ্যাক্সিডেন্ট না হলে সেটা কখনো ভুলব না। বলেছিলেন ‘ওকে দেখে আমার মাইকেলের কথা মনে হয়।’ কথাটা প্রশংসা হিসেবে যতটা, তার চেয়ে বেশী দুঃখ করে বলেছিলেন। কাঁচের চেয়ে কয়লা বেশী সাচ্চা, ওই কথাটাও তাই। …. তবে আরেকটা কথা বলেছিলেন, সেটাও আমি ভুলতে পারিনি, অনেকদিন হয়ে গেছে তাওও। আমার বাবাকে বলেছিলেন কলকাতাটা পারলে অ্যাভয়েড করতে। আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘কলকাতার স্নবারি ওর সহ্য হবে না।’

কলকাতাতেই পড়েছি তারপর। না পড়লে অনেককিছু হয়ে উঠত না, অন্য কী হয়ে উঠত, জানি না। কিন্তু মনে না সইলেও চামড়ায় কলকাতার স্নবারি সয়ে গেছিল। তিন বছর নরেন্দ্রপুরে কাটিয়ে তারপর আবার দু’বছর আশুতোষ বিল্ডিং-এ মাস্টার্স করেছিলাম। অনুপদার কথাটা অনেকবার করে মনে পড়ত ওই পরের দু’বছরে। পৃথিবীতে কেউ জানত না যে কলকাতার স্নবারি আমার সহ্য হয় না। অনুপদা তখন আর পৃথিবীতে নেই। ওই একজনই জানতেন।

আরেকজন হয়তো জানতেন, আমি জানি না, কোনোদিন জিগ্যেস করিনি। টুয়েলভেই একবার শক্তিদা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হ্যাঁরে মানস, তোকে যদি বলা হয় অর্ডার অফ প্রেফারেন্স – শিলিগুড়ি, কলকাতা, আর পুরুলিয়া, কী বলবি?” – আমি বলেছিলাম প্রথমে পুরুলিয়া, তারপর শিলিগুড়ি। লাস্টে কলকাতা। কলকাতা আমার সবচেয়ে কম-পছন্দ শহর ছিল। — তার জন্য অনেকটা অংশে বিভূতিভূষণ দায়ী, আর আমার এককালের ক্লাসমেট সৈকত জানা। আমরা দু’জন বিভূতিভূষণের ভক্ত ছিলাম। একবার কোন্ ছুটিতে যেন, ও আমাকে পোস্টকার্ড লিখেছিল, ‘কিছুদিনের জন্যে কলকাতা এসেছি, হাঁপিয়ে উঠেছি, জানি না কতখানি কালো বিষধোঁয়া ফুসফুসে জমা নিয়ে ফিরব।’ সৈকত মেদিনীপুরের ছেলে ছিল, এখন কোথাকার জানি না।

এখন পুণায় থাকি, ছেলেমেয়েদের কলকাতার গল্প করি। কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের গল্প করি, ছবি দেখাই। কলকাতার তো ম্যাপ আছে। পুরুলিয়ার গল্প করতে গেলে আর ম্যাপ দেখাতে পাই না। তখন শুধু গল্প। আর একটা লাইন বলি। “It is not down in any map; true places never are.”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *