আমার একটা ক্যামেরার শখ ছিল বহুদিন থেকে। বাড়িতে বাবার একটা ফিল্ম ক্যামেরা ছিল, সেটা দু’একবার হাতিয়ে ছবি তুলেছিলাম। সেসব ক্লাস ফোরের আগেকার কথা। কাঁচের ফুটোটার ভেতর দিয়ে তাকালে সামনে অদ্ভুতরকম ছোটো হয়ে যা দেখা যাচ্ছে, বাটন টিপলেই খচ করে উঠে যাবে সেই ছবি, আর তারপর যতদিন না রিল শেষ হচ্ছে ততদিনের অপেক্ষা, এক রিলে কখনো কখনো এক বছর, অন্তত আধবছর তো বটেই। তারপর যেদিন ছত্রিশ নম্বর ফোটো তোলা হত, আরেকটা বাটন টিপে সেই রিল রিওয়াইন্ড করে তারপর ক্যামেরা খুলে বার করা হত, কৌটোয় ভরে (সেই অসাধারণ ফিল্মের কৌটো!!) স্টুডিওতে দিয়ে আসা হত, তারপর তা ডেভেলপ হবে, তবে দেখা যাবে তিন মাস আগে কী ছবি উঠেছিল।
বিদ্যাপীঠে – যাকে বলে ফোটোজেনিক ফ্রেমের ছড়াছড়ি। আমরা বলতাম, চোখ বুজে যেকোনো এক দিকে ক্যামেরা পয়েন্ট করে বোতাম টিপে দিলেই ছবি হয়ে যাবে। তাই আমার বহুদিনের অভিলাষ বেড়ে সাতগুণ হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে একদিন, জন্মদিনে উপহার বাগানো গেল। তখন সবচেয়ে সস্তা আর জনদরদী ক্যামেরা ছিল কোডাক কে বি টেন। কিন্তু আমি যে ক্যামেরা পেলাম, আমার জীবনের প্রথম (এবং একমাত্র) ক্যামেরা, – তা হল ইয়াশিকা জুনিয়র।
অত কিউট ক্যামেরা আর হয় না। কোডাক কে বি টেনের চেয়ে অনেক বেশী ভালো দেখতে। একটা সুইচ ছিল, সেটা দিয়ে ফ্ল্যাশ হবে, না হবে না, নাকি অটোমেটিক সেটিং থাকবে – সেটা ঠিক করা যেত। সেটা খুব সাবধানে সেট করতাম, রাফ ইউজ করলে ক্যামেরা খারাপ হয়ে যায়!
ক্যামেরা হবার পর আমি শুরু করলাম বিদ্যাপীঠের ছবি তোলা। এখনকার দিনে তো সবাই মোবাইলে ছবি তোলে, ফটফটে ঝকঝকে সে সব ছবি, হাই রিজলিউশন, বড় সাইজ। সেসব তখন ছিল না। এই কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল আমরা তখন টেপ রেকর্ডারে আর ওয়াকম্যানে গান শুনতাম। এমপিথ্রি ছিল না। এত ঝকঝকে স্পষ্ট আওয়াজও ছিল না। গৌতমদার একটা কালো, সামান্য টোল-খাওয়া টেপ ছিল, তাতে দেবব্রত বিশ্বাসের ক্যাসেট পুরে বাজাতাম। সেই ইমপার্ফেক্ট স্পীকার থেকে যে আওয়াজ বেরুত, আর বৃষ্টিতে খেলাবন্ধের বিকেলে পূর্ণিমা রাত্রে স্টাডিটাইমের সময় সদনের ফাঁকা জোছনা করিডোরে রাতে খাবার পর ভরপেট আড্ডার মৌতাতে সেই গান শুনে যা এফেক্ট হত, – তা তো আজকাল হাইকোয়ালিটি ফ্ল্যাক ফরম্যাটের গান শুনেও পাই না।
আমাদের তখনকার তোলা ছবিগুলো সব এইরকম। গ্রাফিক্স কম হলে কী হবে, স্টোরিলাইনের কোনো তুলনা নেই।
আমি তো আবার মানুষের ছবি তুলতাম না। আমি এদিক ওদিক ঘুরে গাছ, আকাশ, মাঠ, মেঘ, সূর্য, আলো, এসবের ছবি খুঁজতাম। পোকামাকড়পাখিজীবজন্তু তোলার চেষ্টা করে লাভ নেই কারণ সাধারণ ক্যামেরা আমার, ওসব করলে ফিল্ম নষ্ট হবে, ভালো উঠবে না। না ভাই। বিদ্যাপীঠে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে তুমি তুলবে ল্যান্ডস্কেপ। চোখের সামনে ঘাসের মাঠ, মাথার ওপরে মেঘের। দিগন্ত, দিগন্ত। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউক্যালিপটাসের অ্যাঙ্গেল, তাতে রোদের ঝিলমিল। এসব তোলো, ক্যামেরা সার্থক হবে। বেছে বেছে তোলো। সুতরাং মানুষের মতো ফেতি সাবজেক্ট বাদ। এমনিও আমি আনসোশাল টাইপ ছিলাম।
একবার একজন বোদ্ধা টাইপ ক্লাসমেট জ্ঞান দিয়েছিল, – ওরে, জানিস না, যত ভালো সিনারিই হোক, তাতে একটা মানুষ না থাকলে সে ছবি সার্থকই হয় না। আমি, কী ভাগ্যি, জ্ঞানটায় পাত্তা দিইনি।
এটা ঠিক প্রকৃতির ছবি নয়। প্রকৃতি ইন দ্য ওয়ার্ডওয়ার্থিয়ান সেন্স, আইনস্টাইনিয়ান সেন্স না। আমাদের বড় মন্দিরের সামনের বাগানের ছবি এটা। শীতের মরশুমে এরকম দেখাত সেই বাগান। বড়দিন, তিথিপুজো, একজিবিশনের মরশুম। ডালিয়া, জিনিয়া, ক্রিসানথিমাম। রঙপাগলা ফুল সব।
সকালবেলার রোদ এসে যখন পড়ত সেইসব ফুলের মাথায়, মনে হত উৎসব।