#ধর্মাধর্ম (২)

আমাদের স্কুল ঠিক গতানুগতিক অর্থে জাতীয়তাবাদী ছিল না। আমাদের যেখানে স্কুল অ্যাসেম্বলি হত, সেখানে একটা ভারতের ম্যাপ ছিল। পিতলের ফলকে তোলা ম্যাপ, পাথরের ওপর বসানো। এই ম্যাপ কিন্তু আদৌ ন্যাশনালিস্টিক ছিল না, বরং বেআইনিই বলা যেতে পারে, কারণ ভারত হিসেবে ম্যাপে যা ধরা ছিল তা ১৯৪৭-এর আগেকার অবিভক্ত ভারতবর্ষ। পাকিস্তান-বাংলাদেশ তার মধ্যে। আমরা যে প্রতিদিন অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে শপথ নিতাম, “আমি ভারতবাসী, ভারত আমার দেশ, প্রত্যেক ভারতবাসী আমার ভাই, আমি সর্বদা চিন্তা কর্ম ও মননে ভারতীয় থাকিব”, – তা কিন্তু এই ভারতের ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে। পাকিস্তান যার বাইরে নয়, বাংলাদেশ যার বাইরে নয়। এখনকার ইতিহাস বইয়ের ভারত, যাতে মুঘলদের বহিরাগত বলে বিশেষিত করা হয়, বাবরকে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, পাকিস্তানকে জাতিশত্রু বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়, — সেই ভারতের সাথে আমাদের ভারতের অনেক তফাৎ ছিল।

রাজীব গান্ধী আমাদের স্কুলে এসেছিলেন, আমার অনেক অনেক আগে, তখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে তাঁর মা। এসে অ্যাসেম্বলি অ্যাটেন্ড করেছিলেন রাজীব। সেই অবিভক্ত ভারতের সামনে দাঁড়িয়ে। কোনো প্রশ্ন তোলেননি। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এর অবব্যহিত পরেই। কিন্তু ম্যাপ সংশোধন করার নির্দেশ নিয়ে কোনো সরকারী অফিস থেকে কোনো নোটিশ আসেনি আমাদের স্কুলে।

আমরা যদিও হিন্দু সন্ন্যাসীদের তত্ত্বাবধানে বড় হচ্ছিলাম। হিন্দু রীতিনীতি মেনে, হিন্দুধর্মগ্রন্থের শ্লোক পাঠ করে, হিন্দু দেবদেবীর স্তোত্র আবৃত্তি করে দিন যেত। কিন্তু এইসব খড়মাটির তলায় যে কাঠামোটাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করত না, সেটা ছিল ‘যত মত তত পথ’-এর কাঠামো, স্বামী বিবেকানন্দের বেতালা লাগামছাড়া লিবারাল দৃষ্টিভঙ্গীর কাঠামো। এটা একটা ডিসেন্সির মতো ছিল, একটা মার্জিত ভদ্রতা, যাকে লঙ্ঘন করত না কেউই।

ভদ্রতা মানেই সবসময় স্বচ্ছতা নয়। আমাদের বিদ্যাপীঠ যেহেতু সাংস্কৃতিক দিক থেকে সেকুলার, তাই ঘটা করে আমাদের স্কুলে ক্রিসমাস পালন হত। আমরা তবলা-হারমোনিয়াম বাজিয়ে মেলডির বাপের শ্রাদ্ধ করে মহানন্দে ক্যারল গাইতাম। যীশুকে কেক দেওয়া হত, বিস্কিট, পেস্ট্রি। অভিজাত ব্র্যান্ডের সিগারেট দেওয়া হত থালায় সাজিয়ে, তা দেখে আমরা অর্থপূর্ণ হাসতাম। জন্মাষ্টমীর সময় যে জুনিয়রদের নাটক হত তাতে “সাধক নানক” করেছিলাম আমরা, গুরু নানক সেজেছিল আমারই ব্যাচমেট, নানকের নিজের লেখা “সুমীরণ কর লে” গেয়ে অডিটোরিয়ামের বাতাস স্তব্ধ করে দিয়েছিল আমারই সিনিয়র দাদা। – বড়মন্দিরের সামনে থেকে ঝাউগাছের টব চুরি করে ধার নিয়ে রুমে ক্রিসমাস করেছিলাম, আমরাই।

কিন্তু এই আমাদেরই বিদ্যাপীঠে কোনোরকম মুসলিম উৎসব হত না। মুসলিম বন্ধুরা স্কুল থেকে ছুটি পেত, বাড়িতে গিয়ে কাটিয়ে আসত কয়েকটা দিন। আমরা হস্টেলে অবশ্যই খেজুর, সেমাই ইত্যাদি জরুরী জিনিসের ভাগ ভালোরকমই পেতাম, – ‘চেয়ে নিতাম’ না, ‘নিয়ে নিতাম’। কিন্তু তাও, মুসলিম ধর্ম ব্রাত্যই ছিল বিদ্যাপীঠে। আমাদের একটা বই হত, “জগতের ধর্মগুরু”, – তাতে কয়েকজন বাছা বাছা ধর্মের প্রবর্তকের জীবনী লেখা থাকত – রাম, কৃষ্ণ প্রমুখ পৌরাণিক চরিত্র ইনক্লুডেড। মহম্মদও ছিল তার মধ্যে, কিন্তু কোনোদিনই ওই চ্যাপ্টারটা ইম্পর্ট্যান্ট হতে দেখিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *