#ধর্মাধর্ম (৩)

বিদ্যাপীঠের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট তার ক্যাম্পাস, তার প্রকৃতি। দ্বিতীয় অ্যাসেট তার মধ্যেকার মানুষ। – অবশ্যি মহারাজদের জিজ্ঞেস করলে বলবেন সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র অ্যাসেট হলেন ঠাকুর-মা-স্বামীজী; কিন্তু ওই, “যত মত…।”

এই যে মানুষ অ্যাসেট, তার মধ্যে সবাই সমান ছিল না। তবে বেশ কিছুজন ছিলেন যাঁরা নিজেদের মরাল কম্পাস খুব যত্নের সাথে মেনটেন করতেন। এঁদের জন্যে আমাদের বড় হয়ে ওঠাটা একরকম ঠিকঠাকই হচ্ছিল।

মাঝেমাঝে আমাদের মনে নানারকম প্রশ্ন জাগত। যেহেতু আমাদের ক্লাস ফোর থেকে পড়ানো হচ্ছে বিবেকানন্দের জীবন, এবং তাতে থাকত সেই বিখ্যাত হুঁকো টানার গল্প, তাই আমরা খুব স্বাভাবিক কর্তব্যবোধে নিজেদের সন্দেহ, প্রশ্নগুলোকে প্রশ্রয় দিতাম। “বিবেকানন্দ নিজেও তো এরমই করত” – এটা ছিল বন্ধুদের মধ্যে একটা বহুব্যবহৃত লাইন। এসব সামলাতে স্যারদের – এবং বিশেষ করে বিবেকানন্দের সরাসরি অনুগামী যাঁরা, সেই মহারাজদের বেশ ক্রিয়েটিভিটি অবলম্বন করতে হত। তর্কে গুরু-শিষ্য সমান পারঙ্গম, এবং পিটুনি দিয়ে প্রশ্ন চাপা দিতে চাইলে মরাল ভিক্টরি বরাবরের জন্য হাতের বাইরে। সুতরাং ব্যাপারটা বেশ কালারফুল ছিল।

এর মধ্যে কখনো কখনো এটা নিছক কৌতূহলের সীমা ছাড়িয়ে সিরিয়াস আগ্রহ ছুঁয়ে ফেলত। অথবা চোদ্দো বছর বয়েসী অস্তিত্বসংকট। বিশ্বাস করে যে, তার প্রশ্নকে প্রতিহত করা যায় না।

বড়মন্দিরে রামকৃষ্ণের অবয়বের সামনে আরতি হত প্রতি সন্ধ্যায়। আমরা আরাত্রিক গাইতাম, আর আমাদের একজন ক্লাসমেট আরতি করত। সেটা ইন ইটসেল্ফ একটা লেখার মত জিনিস। এই যে সিনিয়রদের আরতি, এটা করার জন্য বাছাই করা হত বিশেষ কিছু কিছু ছাত্রদের। তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে ট্রেনিং দিয়ে প্র্যাকটিস করিয়ে তারপর ভার দেওয়া হত। একেকদিন একেকজনের আরতির ডিউটি পড়ত। বিদ্যাপীঠের সরস্বতীপুজো বরাবরই ছাত্রের হাতে হয়। এই পোস্টে যাদের ট্যাগ করা আছে তাদের একজন ক্লাস নাইনে আমাদের সরস্বতীপুজোয় পূজারী হয়েছিল। সেও ওই সারাবছরের আরতির দলে ছিল।

এই যে কয়েকজনকে বাছাইয়ের ব্যাপারটা, আরতির জন্য, এটা শুরু হত ক্লাস এইটে। আমাদের পালা এল। দেখলাম, বাছার সময় একটা নিয়ম গোড়াতেই খাটছে। যাদের নেওয়া হবে, তাদের সবাইকে ব্রাহ্মণ হতে হবে। মানে, কেউ যদি ব্রাহ্মণসন্তান না হয়, তাহলে তাকে নেওয়া হবে না। তার আরতির অধিকার নেই।

ক্লাস ফোর থেকে সোজা রামকৃষ্ণ পড়ে আসছি, এটা খট করে মাথায় লাগল। এই যে সব গল্প, সর্বধর্মসমন্বয়, পৈতে খুলে রেখে পঞ্চবটীতে ধ্যান, সারদা-নিবেদিতা বাইনারি, – এইসব তাহলে যাচ্ছে কোথায়? রামকৃষ্ণ নিজেই তো এইসবের বিরুদ্ধে এত ইয়ে করে গেলেন। তাহলে আবার সেই নিয়ম খাটছে কেন? — সবচেয়ে বড় কথা – বিদ্যাপীঠের ডিবেটবাজরা প্রশ্ন তুলল – সবচেয়ে বড় কথা, স্বামীজী নিজেই তো “দত্ত”। কায়স্থ তো, ব্রাহ্মণ তো নয়? তাহলে কী বেলুড়ে স্বামীজী নিজে এলেও তাকে আরতি করতে দেওয়া হবে না?? – অ্যান্সার চাই।

আমাদের ক্লাসের একজন এটা জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের তখনকার ওয়ার্ডেন ভার্গব মহারাজকে। – ভার্গব মহারাজ অতি নবীন সন্ন্যাসী, এমনকী ‘ব্রহ্মচারী’-ও হননি তখনো বেলুড় থেকে, প্রি-প্রবেশনারি স্টেজ চলছে। ভেতরে-বাইরে তীব্র বৈরাগ্য। আমাদের সাথে বয়সের পার্থক্য কম, আমরা সেটা বুঝতে পারতাম না। ফুটবল কোচের প্যাশন নিয়ে আমাদের বিবেকানন্দের পথে হাঁটা শেখাতে চাইতেন। আমাদের বিকশিত করার মধ্যে খুঁজে নিতেন নিজের আত্মশুদ্ধি, আমাদের এগিয়ে দিতে দিতে নিজে চালিয়ে যেতেন আত্মানুসন্ধান। তাই তাঁর কাছে জিওমেট্রি, অজানা গানের স্বরলিপি বা রামকৃষ্ণ মিশনের নিয়ম, – যে কোনো ব্যাপার নিয়েই ফ্রি-লি প্রশ্ন করা যেত। ‘ফ্রি-লি’ আর ‘ডিজরেসপেক্টফুলি’-র তফাৎ আমরা এরকম গুলিয়ে ফেলিনি তখনো।

মহারাজকে জিজ্ঞেস করা হল, – শুধু ব্রাহ্মণ কেন। মহারাজ উত্তর দিতে গিয়ে খানিকক্ষণ গম্ভীরভাবে ভাবলেন। তারপর বললেন, – দাঁড়াও, আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তরটা জানি না। আমি বড় মহারাজদের জিজ্ঞেস করে জেনে তোমায় বলব।

পরে ভার্গব মহারাজ আমার সেই ক্লাসমেটকে প্রতিশ্রুতিমতো উত্তর দিয়েওছিলেন। কোনো একজন বড় মহারাজের যোগানো উত্তর তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে। কিন্তু আমার মনে নেই উত্তরটা কী ছিল। – এটা মনে করতে পারি যে এতটাই আলগা আর দুর্বল ছিল সেই জবাব, যে মনে কোনো দাগই কাটতে পারেনি।

কিন্তু এই নিরুত্তর বিদ্যাপীঠও কোনোদিন আমাদের প্রশ্ন করার জায়গাটা কেড়ে নিতে চায়নি। টুয়েলভে পড়ার সময় হস্টেলের করিডোরে দাঁড়িয়ে আমাদের ব্যাচমেট প্রায় এক ঘন্টা ধরে ক্রমাগত তর্ক করে গেছে শক্তিদার সঙ্গে – এখন ভাবলে বুঝি তর্কটা আসলে না-বুঝে-তর্ক ছিল – শক্তিদা এক হাতে খাবারের বাটি নিয়ে ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে সেই তর্কে সাড়া দিয়ে গেছেন। তারপর আমরাই আমাদের বন্ধুকে একরকম বস্তাচাপা দিয়ে শক্তিদাকে পরিত্রাণ দিয়েছি – আমাদের খাওয়া এক ঘন্টা আগে হয়ে গেছিল, শক্তিদার হয়নি। — এইসব জিনিসগুলো ছিল, আমাদের।

এই জিনিসগুলো থাকা খুব দরকার।

—————————————————

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *