বিদ্যাপীঠের সীমানার মধ্যে এমন অনেক কিছু ছিল যা যাদুময়। সেসবের টুকরো ব্যাখ্যা সবসময় করা যেত না, অনুভবে যেটুকু বোঝা যেত সেটুকু নিয়ে তৃপ্ত থাকতে হত। এসবের গল্প মাঝেসাঝে মাথাচাড়া দেয়, উঠে আসে। তখন বিদ্যাপীঠের পুরোনোরা কাজের মাঝে কোনোরকমে একটু সময় করে নেয়, পুরোনো গল্প নতুন করে শোনাতে বসে।
এরকম যাদুমাখা জিনিস কিন্তু শুধু বিদ্যাপীঠে পাওয়া যেত এমন নয়। এরকম বহু কথা আছে যার টেস্টটিউব-পাশ ব্যাখ্যা হয় না। সারা পৃথিবীতে সেসবের ঠিকানা ছড়ানো। ভালোবাসা সেরকম একটা জিনিস। তাই সারা পৃথিবী জুড়ে সব যুগে তা নিয়ে মানুষের এত কথা, এত অযৌক্তিক দুঃখ, অহেতুক সুখ।
ক্যালটেকে ফিজিক্স নিয়ে লেকচার দেবার সময় রিচার্ড ফাইনম্যান একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, “We must, incidentally, make it clear from the beginning that if a thing is not a science, it is not necessarily bad. For example, love is not a science. So, if something is said not to be a science, it does not mean that there is something wrong with it; it just means that it is not a science.” – এই যে আমরা মাঝবয়েসের পৈঠায় পা দিয়ে ইস্কুলবেলার প্রেমের গল্প ফিরে দেখতে বসেছি, আমাদের এই অর্ধপক্ক জ্ঞান আর পৌনে-পাকা বোধ নিয়ে, – আমরা যদি এখন ভুলে যাই যে আমরা সরল জীববিদ্যা পড়তে বসিনি, তাহলে কিন্তু চিত্তির।
জীবন চলে জীবনের মতো। মানুষের চোখে তার কোনো মানে দাঁড়াবেই, আমাদের প্রতি বিশ্বজগতের এমন কোনো দায় নেই। যা ঘটে, তাকে যদি আমরা আমাদের সুবিধেমতো কোনো ছকে বাঁধতে পারি, কোনো ছন্দে তার বর্ণনাকে ধরতে পারি, – বহুৎ আচ্ছা। যদি তা না পারি তবে আমাদের সন্ধান চালিয়ে যাবার অনুমতি থাকলেও, সত্যিকে বাঁকিয়েচুরিয়ে আমাদের হাতবাক্সে ঠেসে ঢোকানোর কোনো অধিকার থাকে না।
সেইজন্যেই যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের কাজটা সোজা নয়। They cannot twist the facts to suit theories; they have to adapt their theories to suit facts. সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো কঠিন। সত্যের চোখ থেকে চোখ না সরানো আরও কঠিন।
এই যে ছেলেগুলো রাতের বেলা চুরি করে এ-ওর ঘরে যেত; এ-ওর সাথে শুত; ফিসিফিসিয়ে প্রেম করত; শরীর দিয়ে শরীর চিনত অন্ধকারে। যাদের আমরাই ভালোবেসেছিলাম, ঘৃণা করেছিলাম, চিঠি লিখেছিলাম, স্কুল ছাড়ার বছরখানেক পরেও স্বপ্নে দেখেছিলাম, চেয়েছিলাম অনেক করে, হিংসে করেছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেরাই। যাদের সাথে ডাইনিং হল থেকে সদন অবধি ফেরার পথটুকু পাশাপাশি হাঁটতে চাইতাম, গোলাপবাগান থেকে ফুল চুরি করতাম, যাদের টিটকিরি দিতাম, ছড়া কাটতাম যাদের নামে। এই এরাই কিন্তু। আমরাই এরা। আপনি কি চেনেন কাউকে, যে আমাদের স্কুলে পড়েছিল? আমার সহপাঠীরা, আমার বন্ধুরা, সিনিয়াররা, জুনিয়ররা ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে, দেশের বাইরে। মানুষ তাদের সাথে কাজ করে, কথা বলে, সিনেমা যায়, ডিনার খায়। উপকারী বন্ধু বলে ভালোবাসে, শিক্ষক বলে শ্রদ্ধা করে, তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটায় শনিবার রবিবার। আপনি কি সত্যিই এই লেখা পড়ার পর থেকে হঠাৎ করে ভাবতে আরম্ভ করে দিয়েছেন, যে এই এরা এরা আসলে একেকজন এক্স-রুগী? এদের অসুবিধা আছে? এরা কীসব যেন করেছে?
কেউই ভাবেননি এরকম। কেউই পরের বার পরিচিত মানুষটাকে দেখে ভেতরে ভেতরে কুঁচকে যাবেন না। কারণ তারা আপনার কাছে নতুন নন, তারা আপনার চেনা। আপনিই জানেন যে তারা কী।
এই গল্পের যারা কুশীলব, তারা, স্যার, একজনও তো কাল্পনিক চরিত্র নয়। এরাই আজ আমি-আপনি, এরাই ফেলে আসা দিনের ভবিষ্যৎ। ওই নিয়ম-ভাঙা, লুকিয়ে সম-প্রেম করা, সম-কাম করা ছেলেগুলোই কিন্তু এখনো বেঁচে আছে, ইওর অনার। তাদের জামা বদলে গেছে, হয়তো বদলে গেছে তারা নিজেরাও। কিন্তু তাদের গল্পটা বদলায়নি। অতীত তো বদলায় না।
কী করে বলবেন, তারা যা করেছিল, যা বেঁচেছিল – তা প্রকৃতিবিরুদ্ধ? তা ভুল? তা সংশোধনযোগ্য? অঙ্ক কষতে ভুল হলে উত্তর ঠিক আসত কি?
যাইহোক গল্পে ফিরি।
জুড়িদার বাছা নিয়ে কম্পিটিশান আর গণ্ডগোল সব পশুদের মধ্যেই মোটামুটি কমন থীম। আমাদেরও নানারকম ত্রিভুজ, বর্গক্ষেত্র, রম্বসের ছড়াছড়ি লেগে থাকত।
কিছু পয়েন্ট তো অদৃশ্য, – তাদের চাওয়া চোখেই থমকে থাকত, তার বেশী গড়াতে পেত না। যারা সাহস করে অ্যাপ্রোচ নিত, জ্যামিতি জমত তাদের ঘিরে। প্রথম ধাপ: প্রোপোজ করা। এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, চিরকুট থেকে দূতীয়াল, যতরকম ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি আছে সবরকমই ছিল। তাছাড়া ছিল পারফর্ম্যান্স বেসড কোর্টিং। মানে ধরা যাক বিনয় আর বাদল, দু’জনেই দীনেশের প্রেমিক। এবার সামনে বড় ফুটবল ম্যাচ, বিনয় আর বাদল প্রতিপক্ষ দল, মানসম্মানের প্রশ্ন এমনিতেই তার সাথে খুবই সিরিয়াসভাবে জড়িত। তার সাথে আলাদা মাত্রা যোগ করল মাই ফেয়ার লেডি: দীনেশ। দীনেশ কোন টীমকে সাপোর্ট করবে সেটা ইন ইটসেল্ফ একটা লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ তার কনোটেশনেই বোঝা যাবে পাল্লা কোনদিকে বেশী ভারী। এবার ম্যাচে সারাটা সময় জুড়ে দুই প্রেমিক জান লড়িয়ে দেবে টীমের জন্যে তো বটেই, কিন্তু তার সাথে – ফীল দিস – প্রেমের জন্য। বিকজ দে হ্যাভ বোথ ডেডিকেটেড দ্য গেম টু ‘হিম’। … খেলায় যে জিতল, সে তো জিতলই। কিন্তু যে হেরে গেল সে অনেকসময় আরও বড়ো জিত জিতত কীভাবে, সেসবের স্মৃতি এখনও কীভাবে যেন রয়ে গেছে। টীমের বন্ধুদের সান্ত্বনায় যা মিটত না, তা-ই অনেক আসান হয়ে যেত একজনের সাহচর্যে, সাধারণ একটুক্ষণ – একটুখানি কথায়।
মাঝে মাঝে সত্যিই লড়াই লাগত।
ক্লাস এইটের ঘটনা। আরুণি আর উপমন্যু, দু’জনে দু’জনকে ভালোবাসে। দু’জনেরই ব্যাচে – এবং ব্যাচের বাইরে – নামডাক যথেষ্ট, ইতিউতি অ্যাডমায়ারার প্রচুর। প্রচুর ধুকপুকে র্যাডিক্যালকে হতাশ করে তারা শেষে এর-ওর সাথে জোট বাঁধল। বেশ, কী আর করা, সে লা ভী। সবাই মোটামুটি চাপলেস। কিন্তু মুশকিল হল একজনকে নিয়ে, সে হল আরুণির উগ্র অ্যাডমায়ারার, বেদ।
বেদ রীতিমতো ডাকাবুকো ছেলে। বড় একটা হিরো-মার্কা না হলেও, প্রথম সারির অ্যাথলিট। বিদ্যাপীঠের অলিখিত নিয়ম ছিল যে পপুলার হতে গেলে তার সবচেয়ে বড় রাস্তা হল খেলাধুলায় হিরো হওয়া। বেদের সে হিসাবে যথেষ্ট নামডাক। – না হলেও কিছু এসে যেত না, কারণ সে তখন আরুণির জন্য এমনিতেই যেকোনো কিছু করে ফেলার জন্য তৈরী। যেমন, পথে কেউ বাধা হলে তাকে সরিয়ে দেওয়া।
কিন্তু আরুণি তো অলরেডি টেকেন, উপমন্যুর সাথে তার গভীর কোভ্যালেন্ট বন্ড। এমনিতে দু’জনেই ‘মেয়ে’ হলেও, এই বন্ডটিতে কিঞ্চিৎ পোলারিটি প্রকাশিত, আরুণি ‘ছেলে’, উপমন্যু ‘মেয়ে’। আরুণি চেহারায় নরমসরম মাখনমার্কা হলেও, শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী। ঠিক কতটা, তার মাপ কেউ নেয়নি, কারণ আরুণি মারকুটে ছেলে ছিল না। সেই মাপ পাওয়া গেল বুধবার রাত্রে।
রাত আন্দাজ দশটা কী সাড়ে দশটা। ঘরের আলো নিভে গিয়ে ছেলেরা শুয়ে পড়ে সাড়ে ন’টায়। লতায়পাতায় খবর হয়ে ছিল, সেদিন রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর অমুক ঘরের সামনে উপমন্যু দাঁড়াবে, সেখানে আরুণি এসে তার সাথে দেখা করবে। নজরদারি করার জন্য এক দু’জন থাকত সবসময়েই, – আরুণিদের কোনোদিনই স্যাটেলাইটের অভাব হত না। তা সেদিন সমস্ত কিছু মিটে গেছে, সবাই শুয়ে পড়েছে, ওয়ার্ডেনদের ঘরে আলো বন্ধ হয়ে গেছে, কারও আসার সম্ভাবনা নেই। কোস্ট ক্লিয়ার। এমন সময় দেখা গেল, টিমটিমে করিডোর দিয়ে একটা চেনা ফিগার লম্বা লম্বা পায়ে এদিকে হেঁটে আসছে। বেদ।
ঠিক এই জিনিসটারই ভয় ছিল। বেদ বলেছিল, উপমন্যুকে সুযোগ পেলেই এমন কড়কাবে, যে আরুণির ত্রিসীমানায় সে আর ঘেঁষার কথা ভাববেনা। জিনিসটা হুমকি ছিল এতক্ষণ অবধি, – এইবার রিয়্যালিটি হয়ে গেল। দেয়ার হী ইজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দারুণ রেগে আছে। উপমন্যুর অবস্থা প্রায় নেকড়ের সামনে পড়া খরগোশের মতো হয়ে গেছে। যদি মার…
কিন্তু সিনেমায় একধরনের কায়দা দেখা যায়, তাকে বলে ডিউস এক্স মাকিনা। তখনো বেদ আর উপমন্যুর মধ্যে মিটার দশেক দূরত্ব বাকি, – পাশের ঘরের দরজার কাছ থেকে বেরিয়ে উপমন্যুকে গার্ড করে দাঁড়াল আরুণি।
প্রত্যক্ষদর্শী বিশেষ কেউ ছিল না ঘটনাটার। আরুণির মুখে নাকি কোনো কথা ছিল না। শুধু বেদের চোখে চোখ রেখে সেরেছিল সমস্তটা।
বেদ প্রথমে একটু অবাক হলেও, ভড়কাল না। হাতে একটা টর্চ ছিল। সোজা গিয়ে আরুণির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে টর্চটা জ্বালিয়ে ফেলল মুখের ওপর, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক। কী করবি কর।
আরুণি প্রথমে এক চোটে টর্চটাকে বেদের হাত থেকে করিডোরের ওপাশে পাঠিয়ে দিল। বেদ সঙ্গে সঙ্গে মারার জন্য হাত তুলছিল – কিন্তু আরুণি সেই সুযোগটুকু না দিয়ে বেদের দুই কব্জি নিজের দুই মুঠোয় ধরে ফেলল – বুক অবধি সে হাত ওঠার আগেই। ……. গল্পটা মূলত এখানেই শেষ। এর পরের দু’মিনিট ধরে বেদ প্রাণপণ চেষ্টা করে গেল হাত ছাড়াতে। আরুণি পাথর। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে বুকের ওঠাপড়া, কথা নেই। বেদ টানাটানি করে যাচ্ছে। উপমন্যু দর্শক।
যখন বেদের মুখের ভাবটা অসহায়তা থেকে মিনতিতে নেমে গেল, তখন একটা ঝাড়া দিয়ে আরুণি হাতদুটো মুঠো থেকে ফেলে দিল। আঙুল দিয়ে পয়েন্ট করে বুঝিয়ে দিল, তুমি এবার এসো।
—
খুবই ছোটো ঘটনা। নকল নাম দিয়ে সিনেমার মতো করে শোনালাম বটে, কিন্তু এত বড় নাটকে সব সিনেমাই সীন হয়ে যায়, তার বেশী কিছু না। এর পরে এই তিনজনেই একসাথে থেকেছে, পড়েছে, আনন্দ করেছে, যাবার দিনে হাত ধরেছে, সবাই সবার। তিনজন কেন, আমরা সবাই। ঘটনাগুলো মনে থেকে গেছে, গন্ধটুকু রয়ে গেছে কারো কারো আনাচেকানাচে। ক্ষত থাকেনি কোনো। এরকম ঠোকাঠুকি, কষাকষি করে দিনের পরে দিন গেছে। রাত গেছে একের পর এক, চোখের জল ফেলে ফেলে। কোথায় আফসোস? সব বৃষ্টি মেঘ হয়ে আকাশের রোদে ফিরে গেছে অনাবিল। পাওয়া না-পাওয়ার অফুরান গল্প আলো-হাসি-গানে এই মাটি তীর্থ করে সাজিয়ে দিয়ে গেছে।
(সীজন ওয়ান সমাপ্ত)
****************************