পরাবিজ্ঞানী হেক্টর ড্যাগওয়র্থ-গ্র্যাঞ্জার বলেছেন, কৌশলী রসায়নবিদ চেষ্টা করলে হয়ত সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে এমন ওষুধ বানিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু ট্রু লাভ জিনিসটা কোনোরকম কৃত্রিম উপায়ে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। সেটা নিজেকেই বুঝে নিতে হয়।
বিদ্যাপীঠে তো আর এই নিয়মের বাইরে ছিল না। তাই পড়াশোনাগোত্রীয় প্রোজাইক জীবনযুদ্ধের পাশাপাশি আরও নানারকম জটিল চ্যালেঞ্জ আমাদের মুখোমুখি হত।
প্রথম চ্যালেঞ্জ, – আসলে প্রথমেরও আগে – বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘জিরোয়েথ’, তা ছিল জিনিসটাকে সুরক্ষিতভাবে বাঁচানো এবং নিরাপদ রাখা। কারণ অ্যাট দি এন্ড অফ দ্য ডে, – অকুস্থল রামকৃষ্ণ মিশনের হস্টেল। সেখানে মানুষের পুরো রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেমটাই ভেস্টিজিয়াল, হরমোন-ফরমোন সব শুদ্ধু। ওয়ার্ডেন এবং মাস্টারমশাই দাদারা এই নিয়ম মেনটেন করার ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই ভয়ঙ্কর সাবধানী ছিলেন। বিদ্যাপীঠে আমরা বয়সে বড়ো সবাইকেই দাদা বলতাম, মহারাজদের ছাড়া (আগে নাকি মহারাজদেরও দাদা ডাকা হত), – তা এই দাদাদের হাতেই যেহেতু আমরা মানুষ হচ্ছি, তাই আমাদের নৈতিক চরিত্র যাতে নষ্ট না হয় সেই দায়ও তাঁদেরকেই বইতে হত।
নৈতিক চরিত্র বলতে কী? – এইখানে আমি নিজে বেশী কথা না বলে একটা বিশেষ লোকের কয়েকটা লাইন সোজা তুলে দিচ্ছি।
” সনাতন হিন্দুধর্মের গগনস্পর্শী মন্দির–সে মন্দিরে নিয়ে যাবার রাস্তাই বা কত । আর সেথা নাই বা কি ? বেদান্তীর নির্গুণ ব্রহ্ম হ’তে ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূয্যিমামা, ইঁদুরচড়া গণেশ, আর কুচোদেবতা ষষ্ঠী, মাকাল প্রভৃতি,– নাই কি ? আর বেদ-বেদান্ত দর্শন পুরাণ তন্ত্রে তো ঢের মাল আছে, যার এক-একটা কথায় ভববন্ধন টুটে যায়। আর লোকেরই বা ভিড় কি, তেত্রিশ কোটি লোক সে দিকে দৌড়েছে। আমারও কৌতূহল হ’ল, আমিও ছুটলুম। কিন্তু গিয়ে দেখি, এ কি কাণ্ড ! মন্দিরের মধ্যে কেউ যাচ্ছে না, দোরের পাশে একটা পঞ্চাশ মুণ্ডু, একশত হাত, দু-শ পেট, পাঁচ-শ ঠ্যাঙওয়ালা মূর্তি খাড়া! সেইটার পায়ের তলায় সকলেই গড়াগড়ি দিচ্ছে। একজনকে কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলুম যে, ওই ভেতরে যে-সকল ঠাকুরদেবতা, ওদের দূর থেকে একটা গড় বা দুটি ফুল ছুড়ে ফেললেই যথেষ্ট পূজা হয়। আসল পূজা কিন্তু এর করা চাই—যিনি দ্বারদেশে; আর ঐ যে বেদ-বেদান্ত, দর্শন, পুরাণ–শাস্ত্ৰসকল দেখছ, ও মধ্যে মধ্যে শুনলে হানি নাই, কিন্তু পালতে হবে এর হুকুম। তখন আবার জিজ্ঞাসা করলুম—তবে এ দেবদেবের নাম কি ? উত্তর এল – এর নাম “লোকাচার”। “
তা লোকাচার যখন, তখন তা না মেনে মাস্টারমশাইরা যান কোথা? সমাজ বলে যৌনতা নোংরা, নৈতিকতা আর যৌনতা পরস্পর বিপরীত। আর ধর্মপ্রতিষ্ঠানে তো সেই ছুঁৎমার্গ আরও দুশোগুণ টনটনে। বিদ্যাপীঠে থেকে যতরকম বদমাইশি, বেয়াদবি আর অসভ্যতার জন্যে আমাদের শাস্তি পাওয়া সম্ভব ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে নীচু আর লজ্জার ছিল এই ‘নোংরা’ অসভ্যতা। তাই একদিকে যেমন শরীরে সাড়া জাগত, অন্যদিকে তেমন মনে বাসা বাঁধত অপরাধবোধ। অপরাধবোধ এই কারণে যে আমার মন নোংরা হয়ে যাচ্ছে। আমার শরীরের ওপর আমার কন্ট্রোল নেই। মানুষের চেয়ে নীচুস্তরের যারা, সেই পশুদের সাথে আমার দূরত্ব কমে আসছে, আমার নিজের চোখে চোখ রেখে আয়নায় দাঁড়ানোর আর যোগ্যতা নেই।
এসব সবারই চেনা ফেজ, এই মধ্যবিত্ত সংসারে সবারই এসব ক্রাইসিস হয়। সমস্যাটা হল একটা হস্টেল, যেখানে প্রতি তলায় দু’জন তিনজন করে দুঁদে ওয়ার্ডেন, এবং তার চেয়ে বড়ো কথা ঘরে ঘরে চারদিকে জোড়া-জোড়া চোখওয়ালা ব্যাচমেট (মানে ‘পাড়ার লোকজন’), সেখানে প্রেমের কালমিনেশন আনা যায় কী করে। চিঠিফিঠি চালানো কঠিন না, প্রেয়ারে বা স্টাডিটাইমে পাশাপাশি বসে নীচুগলায় বাকবাকুমও ম্যানেজেব্ল, কিন্তু প্লেটোনিকের পরে কিছু অ্যারিস্টটেলিয়ানও তো থাকে! তার চাহিদা পূরবে কী করে?
এইখানে এসে বোঝা গেল আমাদের ভেতরকার সুপ্ত প্রতিভা, যা সময়ের পথ চেয়ে জাগবার জন্যে বসে ছিল। পঞ্চশরের ভূত এসে কানে কানে বলে গেল, – দেবতা ঘুমালে তোমাদের দিন, দেবতা জাগিলে তোদের রাতি।
সীমাফোরের কায়দায় টর্চ জ্বেলে সিগন্যালিং চলত, এক রুম থেকে আরেক রুমের দিকে। রাত দশটা, সাড়ে দশটা, এগারোটা…। সময় বাঁধা থাকত আগে থেকে। যাদের অভিসার তারা তো জাগতই, আর তাদের ব্যাক আপ দিতে অন ডিউটি থাকত কিছু মারাত্মক বিশ্বস্ত এবং গুণধর শাগরেদ। যাদের কাজ ছিল পাহারায় থাকা। কারণ সবাই জানত বিদ্যাপীঠে রাতের বেলা তিনটে জিনিস অন্ধকারে জ্বলে; করিডোরের বাল্ব, গাছের জোনাকি, আর ব্রহ্মানন্দ সদনের ওয়ার্ডেনের চোখ।
রুমের ভেতরেরই কেউ ঘুম ভেঙে বাথরুম যাওয়ার জন্য উঠেছে, – এই সিচুয়েশন কোনো সমস্যা নয়। স্রেফ ফ্রিজ করে যাও, সাড়াশব্দ কিছু থাকে না। বাথরুম থেকে ফিরুক, শুক, ঘুমিয়ে পড়তে খানিকটা সময় দাও, রিজিউম করো। … এবং যেহেতু পরদিন রাইজিং বেল একই সময়ে পড়বে, তাই মাথাটা ঠাণ্ডা রেখে সময়মতো কাজ গুটিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যাও এবং ঘুমাও। না, বিপদ ছিল অন্যদিকে। স্যাররা পাক্কা জানতেন, কারা এইসব কাজ করে, করবে বা করতে পারে। বুঝতেই পারছেন, ধীমান পাঠক, কার কার ব্যালকনির তলা দিয়ে ছোকরারা যাতায়াত করার চেষ্টা করবে সেটা জানতে নিজে রোমিও হবার দরকার পড়ে না। তাই কখনো কখনো, বিনা ওয়ার্নিংএ, তাঁরা করিডোর ধরে নিঃশব্দে টহল দিতে বেরুতেন।
কোন ঘরে কে থাকে, তা তাঁদের জানা। কার সাথে কাকে একটু বেশীরকম ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকতে ইদানীং দেখা যায়, তাও তাঁদের নজর এড়ায়নি। বাকিটা অঙ্ক।
একটা গুজব আমরা খুব শুনতাম সেভেনে ওঠার পর থেকে, – ক্লাসে নাকি স্যারের স্পাই আছে। গুজব বলাটা ভুল হল। কথাটা সত্যি। স্পাই থাকত, সব ব্যাচেই। কোনো একজন ভালনারেবল, সরলমতি গোছের – কিংবা, নিয়মমানা অথচ গভীরজলেরমাছ ধরনের কোনো ছেলেকে আলাদা করে ডেকে এই গুরুভার চোরাপকেটে গুঁজে দেওয়া হত। কেন করবে সে এই কাজ? – ওয়েল, ভদ্রলোকে গুপ্তচরবৃত্তি কেন করে? ইজি, ফর দ্য গ্রেটার গুড। – সুতরাং ব্যাচের ভালোর জন্য – সবই তো বোঝে সে – স্যারকে এটুকু সাহায্য সে করবে না??
তাই, কখনো কখনো সত্যিই স্যাররা জানতে পারতেন, কোন সময় টহল দিতে বেরোতে হবে, আর কার ঘরে ঢুকে চেক করতে হবে বিছানা ফাঁকা পড়ে আছে কি না। আর যেদিন সেই খবর মিলে যেত, সেদিন – না, রাতে কেউ কিছু জানতে পারত না। – পরদিন সকাল পেরোতে পেরোতে চুপচাপ সারা ব্যাচে জানাজানি হয়ে যেত, “কাল রাতে — ধরা পড়েছে।।” পিএনপিসি নয়, খবরটার তাৎপর্য ওয়ার্নিং হিসেবে। কিছুদিন কার্ফিউ রাখো, – প্লে লং, প্লে সেফ।
কারো কারো খুব দুর্নাম হত এই সব ঘটনায়। সোৎসাহী স্কুলছেলেদের মতো নির্দয় জিনিস খুব কম হয়, রাসকিন বন্ড লিখেছেন। যারা বার বার এইধরনের ঘটনায় ফাঁসত, তাদের আমরা বলতাম দাগী। আর ব্যাচের যাদের পেছনে আমাদের ছোঁকছোঁকানিটা ভেতরে ভেতরে সবচেয়ে বেশী থাকত, তাদের আমরা দিনের আলোয় বলতাম ‘মাল’।
(চলবে)