ফরিদ আয়াজ হেঁকেছেন, “ইশ্ক যব হদ্ সে গুজর যাওয়ে তো বীমারি হ্যায়…।
…..অওর আগর হদ্ সে না গুজরে তো আদাকারি হ্যায়!”
কিন্তু এসব অনেক উঁচুস্তরের কথা। নাদান সবাইই একসময় না একসময় থাকে। আমি যখন ফোরে পড়ি, তখন রগে রগে ছেলেমি, প্রেম-ফেম গোলাপীটিস্যু মার্কা জিনিসে মুখ সিঁটকাই, নাক বেঁকাই। কে করে ওইসব ট্রিভিয়াল সময়নষ্ট! হ্যাঁ, করেছিল অ্যাথস একদিন, কিন্তু ফল? সেই তো দারুণ শিক্ষা হয়েছিল? ছোঃ ছোঃ, সব ট্রাইফ্লস!
এইসব ভাবনাচিন্তা যতদিনে খড়কুটো হয়ে উড়ে যাবে, ততদিনে কিন্তু অলরেডি অন্যদিক থেকে অন্য বোধন শুরু হয়ে গেছে। পুণ্যবানে কী জেনেছে তা পুণ্যবানে জানে, কিন্তু প্রেমের আগে আমাদের জীবনে এসেছিল কাম। আর কখন একদিন, পোয়েটস অফ দ্য ফল-এর গানের মতো, টের পেয়েছিলাম যে তৃষ্ণাটা আসলে প্রেমের, ডান্সিং আন্ডারনীদ ডিজগাইজ অফ লাস্ট। পৃথিবীতে থিসিসের আগে এসেছিল গান, তাই কাম আর প্রেমের ননডুয়ালিটি নিয়ে কোনোরকম জ্ঞান পাওয়ার আগেই অনেক বিকেল অনেক সন্ধ্যাবেলা একা একা জিম রিভস আর দেবব্রত বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে নিজের সাথে আস্তে আস্তে বোঝাপড়া করে নিতে হয়েছিল, আলাদা করা যাচ্ছে না… কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে না।
**********
সলতে পাকানোর পালা যদি ফোরফাইভসিক্সেই শুরু হয়ে থাকে, প্রদীপ জ্বলল সেভেনে উঠে। শিবানন্দ সদনে অনেক ঘেরাটোপ, নিয়মকানুন অনেক। ব্রহ্মানন্দ সদনে যখন এলাম, তখন আমাদের বয়স বারো। ডর্মিটরি আর রইল না, একেকটা ঘরে আটজন করে বিছানা পেলাম, রুমমেট বাছাবাছি ওয়ার্ডেনের হাতে। কিন্তু পা লম্বা হয়েছে, তাই সেটা ন্যাভিগেট করে নিতে খুব বেশীদিন লাগল না।
প্রতি পাড়াতেই কিছু চুম্বক থাকে। আমাদেরও ছিল।
ট্র্যাজেডিটা হল এই যে এই সজীব চুম্বকরা সবাইকে সমানভাবে টানলেও, সবাই তাদের সমানভাবে টানে না। যার ফলে যুগে যুগে কিছু প্রেম শুধু জেগেই থাকে, যাব যাব বলেও যাওয়া তাদের বিশেষ হয় না। যারা এই লটারীতে জেতে তারা মোটামুটি হয় একটু ডাকাবুকো, নায়কোচিত ধরনের লোকজন। সেই প্রাক-নারীবাদ বয়সে অবধারিতভাবেই তাই যেকোনো জুটির দুটি অংশীদার হত, – একজন ‘ছেলে’ আর একজন ‘মেয়ে’। যে উইনার, সেই ভাগ্যবান ‘ছেলে’, আর যে প্রাইজ, সেই দেবকান্তি বান্দাই সুললিত ‘মেয়ে’।
ফিজিক্সে থাকে না, যে খানিকদূর অবধি আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু অ্যাবসোলিউট মনে হলেও, পরে বোঝা যায় যে আদতে সব ছায়াময় তথা আপেক্ষিক? এই তত্ত্ব অবগত হলাম আমরা, আস্তে আস্তে দিন যেতে যেতে। দেখা গেল, গত মাসেই অমুক জুটিতে যে কিনা ‘মেয়ে’ ছিল, সে হঠাৎ ‘ছেলে’ হয়ে নতুন জোড় বেঁধেছে! কেউ বা এইজনের সাথে ‘ছেলে’ হয়ে মেশামিশি করছিল, কিন্তু ওইজনের সঙ্গে ‘মেয়ে’ হয়ে জুটে গেছে। ব্যাপার কী রে ভাই! স্টাডিহলে করিডোরে আনাচেকানাচে গভীর সন্দেহাকুল আলোচনা – “সবই বুঝলাম কিন্তু ওদের মধ্যে ছেলেটা কে আর মেয়েটা কে???” – ভাবতে গিয়ে মিচকে মাচোদের মুখে ফিচকি হাসি, কারণ ভেবে দ্যাখা গ্যাছে যে দুটোই তো বেসিকালি মেয়ে, হিহিহি!!!
কী গভীর সমস্ত অ্যালিউশন, ডিলিউশন, কনোটেশন, ডিনোটেশন! কে যে ছেলে আর কে যে মেয়ে, এই বিচারে অবশ্যই কিছু কিছু ক্রাইটেরিয়া ছিল। যেমন, যার গায়ে জোর বেশী, সে ন্যাচারালি ছেলে; অন্যজন মেয়ে। যে বেশী সুন্দর দেখতে, সে ন্যাচারালি মেয়ে, অন্যজন ছেলে। যে প্রেমে পড়েছে, তাড়া করেছে, সে ন্যাচারালি ছেলে; অন্যজন মেয়ে। যে সায় দিয়েছে, চিঠি নিয়েছে, সে ন্যাচারালি মেয়ে; অন্যজন ছেলে। – সমস্যা দেখা দিত সেইসব বিরল স্যাম্পলে, যারা দেখতেও মারকাটারি সুন্দর আর গায়ের জোরেও ইস্পাত। এদের জন্য ব্যাপারটা ওই ভার্বাল নাউন বা শ্রডিঞ্জারস ক্যাট টাইপের হয়ে যেত, – আইদার দুটোই, নয়তো ঘটনার সময় প্রত্যক্ষ করা না অবধি বলা যাচ্ছে না কোন্টা ট্রু। বোথ অ্যাট দ্য সেম টাইম।
এছাড়া ছিল ননলিনিয়ার প্রেম। মানে, একই ব্যাচে নয়, সিনিয়ারে-জুনিয়ারে, জুনিয়ারে-সিনিয়ারে। বলা বাহুল্য এইধরনের ননলিনিয়ার প্রেমে যে কচিতর সে মেয়ে। সেইসময় তো সোশ্যাল পাওয়ার ডাইনামিক্স বুঝি না, কোথা দিয়ে বয়সে ছোটো মানেই নীচু মানেই মেয়ে মানেই বয়সে ছোটো হয় সেসব জানি না, – তাই তেইশের ছেলের সাথে পাঁচের মেয়ের বিয়ে হওয়ার সাথে নীচুক্লাসের জনকে ‘মেয়ে’ বলে দাগানোর যোগসূত্রও ঠাহর করতে পারিনি। তবে এটুকু দেখতাম, দাদারা ফুটফুটে ভাইদের ওপর ক্রাশ খেয়ে পটাপট প্রেমে পড়ছে, আর ভাইরা প্রিয় দাদাদের থেকে স্নেহভালোবাসা ইত্যাদি ফ্রিবীজ ছাড়াও কার্ড-চকোলেট এইসব পাচ্ছে। দাদারাও পেত না তা নয়, কিন্তু রসভঙ্গ করবেন না, স্নেহ স্বভাবত নিম্নগামী, ব্যাস্।
কাহিনীতে মাঝে মাঝে নাটকীয় মোড় আসত নতুন বছরের শুরুতে, অথবা ছুটির শেষে বিদ্যাপীঠে ফেরত আসার দিনে। যদি নতুন সেশনে ক্লাসে নতুন কোনো বেকি থ্যাচার ভর্তি হয়, তাহলে তো হয়ে গেল। সকালে বিকেলে নিঃশব্দে পাড়া মাত। বেচারির ব্যাপারস্যাপার বুঝে রিদ্মে আসতেই মাসখানেক লেগে যেত। আর ছুটির পরে প্রথম যেদিন ফেরা, সেদিন যেটা হত তাকে বলা যায় জানার মাঝে অজানার আবিষ্কার। ফাইনালের পর যেদিন বাড়ি গেলাম সেদিনও যাকে সাধারণ মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল, ছুটির পর ফার্স্ট দিন তাকে দেখে দড়াম করে মেটাফিজিক্যাল ধাক্কা: শব্দে নিঃসৃত হত না কিছু, শুধু একটা অনুভূতি – “উফ্ফ।” এবং টেরিয়ে টেরিয়ে তাকানো, অছিলা হাজারটা বের করা যাবে।
এই যে ঋতুচক্রের মতো অমোঘ এসব ঘটনা, সেসব ক্লাসের গুণীদের বিলক্ষণ জানা ছিল। তাই ছুটির পরে বাড়ি (পড়ুন ‘সভ্যতা’) থেকে বিদ্যাপীঠ (পড়ুন ‘মরুভূমি’) ফেরার সময় তারা যতটা পারা যায় প্রস্তুত হয়ে ফিরত। উন্নত কায়দাকানুন দেওয়া চুলের কাটিং। ব্রিল ক্রীমের শিশি, স্টাইলিং জেল-এর টিউব, ডিও-র বোতল। কুচো আংটি, গলার চেন, ইম্প্রেসিভ কেতা-দেওয়া জুতো। এবং ভুলে যাবেন না, জনাব, যে কাহিনীর চরিত্ররা সকলেই বাড়ন্ত বাচ্চা। মাসের পর মাস হস্টেলের প্রবল এফিশিয়েন্ট রুটিন এবং আহারের পর বাড়ি থেকে মাসখানেক কাটিয়ে যখন তারা ফিরত, তখন তাদের বাসাংসি আর ততটা জীর্ণানি নয়। পাপী বয়স বেড়ে চলত, আর তাদের গায়ের হাড়ে-মাসে রেখে যেত সেই বাড়ের দাগ। গোলাপবাগানে ফুল ফুটত মালীর আড়ালে।
(চলবে)