#মিশনইন্দ্রধনু (১)

পশ্চিমের ইউক্যালিপটাস সারি থেকে শুরু করে পুবদিকের রেললাইন অবধি বিদ্যাপীঠের যে পুরো ল্যান্ডস্কেপ, সেই সবটুকুর হার্ট বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা হল বিদ্যাপীঠের গোলাপবাগান। বিদ্যাপীঠের বয়স যখন আমার থেকেও কম – সেই পঁচিশ বছরের জন্মবার্ষিকীতে সিলভার জুবিলি সেলিব্রেশনের সময় এই গোলাপবাগান তৈরী হয়েছিল। সারদামন্দিরের সোজাসুজি, স্বদেশবেদীর চতুষ্কোণের পশ্চিমপ্রান্তকে ধরে একটা তেকোণা মাটির টুকরো, একটা দ্বিসমবাহু ত্রিভুজ। চারপাশে নীচু ঝোপের বেড়া, আর ভেতরে ছড়ানো একের পর এক গোলাপগাছ। কোথা কোথা থেকে খুঁজে খুঁজে দেশী বিদেশী পাহাড়ী আফ্রিকান কতরকম জানি গোলাপের চারা এনে লাগানো হয়েছিল সেই বাগানে। পুরুলিয়ার মাটিতে শিকড় জমিয়ে নিয়েছিল তারা। বড় হয়েছিল, যেমন বড় হচ্ছিল আরো কয়েকশো দেশ-অদেশ থেকে জুটিয়ে আনা দু’পেয়ে চারার দল।

গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে দেবতার পায়ে দেয় আহাম্মকে। আমাদের গোলাপবাগানের চূড়ার কাছে দাঁড়ালে একটা স্ট্রেট লাইনে সোজা সরস্বতীকে দেখা যেত। গোলাপ, তার ওপারে স্বদেশবেদী, এক সরলরেখা বরাবর সারদামন্দির আর তার গায়ে সাদা ধবধবে সরস্বতী। আমরা জানতাম ওই সরস্বতীর পিঠোপিঠি স্কুলের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে দেড়মানুষ সমান লম্বা মা সারদার প্রতিকৃতি, যার পায়ের কাছে আঁকা সাদা ফুল, আর তারও ওপারে স্কুলের অন্দরমহলে যেখানে অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা অ্যাসেম্বলি করি, সেখানে ওই একই লাইনে কোলিনিয়ার হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা।

গোলাপবাগানের ম্যাজিক অনেকরকম, এই জিওমেট্রিটাও ছিল তার মধ্যে একটা। একটা ফুলও না ছিঁড়ে কীভাবে আস্ত একটা বাগান অঞ্জলি দেওয়া যায়, সরস্বতী সাক্ষী রেখে তা শিখিয়েছিল ওই বিদ্যাপীঠ।

সিলভার জুবিলি অনেকদিনকার কথা, আমরা তো সেদিনের ছাত্র। আগেকার দিনে কেমন ছিল জানি না, কিন্তু আমরা যখন, ততদিনে খুব স্বাভাবিকভাবেই গোলাপবাগান আমাদের প্রেম করার সাথে … মিশে গিয়েছিল।

এইবার মানুষ জিজ্ঞেস করবে, সেকী, তোমাদের তো কোএড ছিল না! অল বয়েজ স্কুল না মিশনের?

আর আমাদের তখন বোঝাতে বসতে হবে যে না, তা কোএড ছিল না বটে, কিন্তু তাতে প্রেম-টেম আমাদের আটকাত না। কতবার কতভাবে এই কথাটা বোঝাব স্যার, যে লাইফ ফাইন্ডস আ ওয়ে। যৌন প্রেরণা জিনিসটা এত আসল, এতটাই জীবন্ত আর বিকল্পহীন, যে ওকে ধাপাচাপা দেওয়ার শতচেষ্টা করলেও সে চুঁইয়ে বেরোয়। আর কতবার এই জিনিসটা কবিতা লিখে গান গেয়ে নাটক করে বোঝাতে হবে, যে প্রেম ভালোবাসা জীবনের সাথে এতটাই ওতপ্রোত, যে তাকে দমিয়ে রাখা যায় না, অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সে পথ ঠিকই করে নেয়।

ছেলে আলাদা মেয়ে আলাদা করে স্কুল করার মোদ্দা কথাটা ছিল ব্রহ্মচর্য, এই তো? তা তার গোড়াতেই যেহেতু ভুল, বাইনারির ধারণাটাই যখন ভুয়ো, তখন এই পুরো সিস্টেমটা যে বিফলে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী? আমিই নাহয় পরে জেনেছি যে হোমো আর হেটেরো বলে আলাদা আলাদা বাক্স হয় না, যদি কিছু হয় তো সেটা স্পেকট্রাম, আর একজন মানুষই জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানসিক অবস্থায় বিভিন্নভাবে সেই স্পেকট্রামের বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু আমি পরে জানব বলে তো প্রাকৃতিক সত্য সাসপেন্ড হয়ে বসে ছিল না! মাধ্যাকর্ষণও নিউটন কবে তাকে আবিষ্কার করবে সেইজন্যে বসে থাকেনি, অনাদিকাল থেকে নিজের মতো কাজ করে গেছে। তাই বিদ্যাপীঠে কোএড না থেকেও আমরা নিজেদের মতো করে সারা বছর ধরে দুমদাম ছেলেরা ছেলেদের প্রেমে পড়তাম।

এই এখানে আগেই ম্যাডাম আপনাকে থামিয়ে দিই, কারণ আপনি এখন বেণী ঘোষালের মতো হাত নেড়ে থুতু ফেলে গলা খেঁকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বিগলিত স্বরে বলবেন, আহাআ, ওটা তো তোমাদের একটা, মানে, সাবস্টিটিউশন। অ্যান অ্যাপ্রক্সিমেশন অফ আসল প্রেম। ছেলে-ছেলের মধ্যে প্রেম, সেসব ইনফ্যাচুয়েশন তো হস্টেলে-টস্টেলে হয়েই থাকে, সে আর নতুন কথা কী। কিন্তু সেইসব হল একটা ফেজ। পরে দ্যাখো না সবাই বেরিয়ে নর্মাল পরিবেশে এসে যেই পড়ে, অমনি কিন্তু ঠিক স্বাভাবিক হয়ে যায়। বিয়ে করে না, দ্যাখোনা?

তাহলে এইখানে আবার আপনার জন্য আমাকে গল্প থামিয়ে (এইভাবে গল্প বলা হয়? দুরদুর।) পরিষ্কার করতে হয় যে না, অ্যাপ্রক্সিমেশন নয়। আর ওই যে লাভ-ইনফ্যাচুয়েশন-ক্রাশ ইত্যাদিপ্রভৃতি জারগন ছড়ালেন, ওসব ম্যাডাম বইয়ের পাতায় শোনায় ভালো, কিন্তু আসল ওয়েটল্যাবে ততটা ফারাক করা যায় না। কেন চেষ্টা করছেন, সেই তো বাচ্চাদের কাছে হাসির খোরাক হবেন? তার চেয়ে বরং বুঝে নিন জিনিসটা, যে হ্যাঁ, অবশ্যই সেইসব ইস্কুলবেলার প্রেম বড়বেলায় আর টেঁকে না, ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, ছেলেরা অন্য কোথাও চলে যায়, অন্য কাউকে খুঁজে পায়, তাকে নিয়ে ভাঙে-গড়ে, হাসেকাঁদে। কিন্তু সে তো সর্বত্র হয়। ইস্কুলবেলার প্রেম ঝরে তা থেকে কোনো ফল হয় না বীজ হয় না বলে তা ফুলই নয়, এই ধারণা আপনাকে কে দিল? জানেন না, বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে কাদা হয় না?

যাক গে সেসব লেকচার। আমরা যা করার ঠিকই করতাম।

তার ওপর আমাদের ছিল রেসিডেন্শিয়াল স্কুল। মানে, সাধারণ স্কুলে বেচারী প্রেমিক সারাদিন ধরে তিন বেঞ্চ ওপারে প্রেমাস্পদের সাইড প্রোফাইল দেখতে দেখতে তড়পে ভাজা হয়ে কোনোমতে বাড়ি ফেরে, ফিরে বুক ভরে স্বপ্ন দেখতে দেখতে হাঁপায়। আমরা আরকী সেটুকুও পেতাম না। স্কুল করে ফিরছি, সামনে স্বয়ং। রুমে এলাম, সামনে স্বয়ং। হাত-পা ধুয়ে টিফিন খেতে যাচ্ছি, পাঁচফুট দূর দিয়ে তিনি আরেকজন -নট মী, বাট আরেকজন – বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতে টিফিন খেতে যাচ্ছেন। সারাটা দিন, সমস্তদিন এই টর্চার সহ্য করতে হত। ওয়েক, বার্ন, স্লীপ, রিপিট।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *