ফাইনালের বিকেল – (১)

এই রকম বিকেল আসত তখন।

আমরা স্কুল ড্রেস ছেড়ে ধাম থেকে বেরিয়ে দেখতাম, একটানা দুপুর মিলিয়ে গেছে। গাছের ডালে পাতায় ঝরঝর শব্দ, বাতাস অন্য রকম। আকাশ কোথা দিয়ে যেন বড্ড বেশী চোখ-টানা নীল। মেঘ ফুটফুটে সাদা। সবদিকে কেমন একটা খুশীর মেজাজ, ছুটির হাওয়া।

ফেব্রুয়ারির সাথে সাথে শীত ফুরিয়ে বসন্ত আসত ক্যাম্পাসে।

আর খুব, খুব বেমানানভাবে বসন্তের সাথে আসত যে জিনিসটা, সেটা ছিল ফাইনাল পরীক্ষা।

এদিকে ক্লাস এইট মানে স্যাররা তো ছেড়ে দিচ্ছি, – বাবা-মা, যে শহরে বাড়ি সেখানকার বাদবাকি ছেলেদের বাবা-মা – যারা রোববারদিন দেখা করতে আসার সময় একসাথে ট্রেনের টিকিট কেটে, গ্রুপ করে আসত – , উঁচু ক্লাসের স্টার ছাত্র দাদা, – সব্বাই বলে দিয়েছে যে এখন থেকে কিন্তু সিরিয়াস হতে হবে। এর পরেই কিন্তু ক্লাস নাইন, আর তার পরেই কিন্তু মাধ্যমিক। যদি এখন থেকে সিনসিয়ার না হও, তাহলে কিন্তু একদম পিছিয়ে যাবে। তাই বইয়ের পাতায় বেশী করে আন্ডারলাইন, স্টাডি হলের ডেস্কে নিউ এডিশন প্রান্তিক আর ছায়া প্রকাশনী। রাতে পাঠের সময় মহারাজ ডেলি মনে করিয়ে দেন, কীভাবে মনকে ডিসিপ্লিন করে পড়তে হবে। আমরা হপ্তা ধরে প্ল্যান বানাই, পরের উইকে এই এই দিনে, এই এই স্টাডিতে এই এই চ্যাপ্টার কাভার করতে হবে। ওকে ধরে এই জায়গাটা ডিসকাস করে নিতে হবে।

নাইন-টেনে তো আলাদা গাম্ভীর্য। ক্রাইম রেটও তুঙ্গে যদিও, কিন্তু সেসবকে হজম করে যায় পড়াশোনার হেভিওয়েট দিস্তা-ঘেরাও বাতাবরণ। আমাদের চেয়ে টেনশনে আমাদের ওয়ার্ডেনরা, আর – ভাবলে বিশ্বাস হতে চায় না – কারো কারো জন্য টেনশনে তার থেকেও বেশী তার ক্লাসমেট। বিদ্যাপীঠের ধুলো-ফুলো যেসব কারণে পবিত্র, তার মধ্যে একটা ছিল এই অদ্ভুত বেনামা ভালোবাসা। যাকে তখন ভালোবাসা বলে চেনেওনি সেইসব ইমপার্ফেক্ট ছেলেরা, যাদের ভজনহলের চটি আর স্টাডিহলের নোটস সমান হারে এর ওর কাছে যাওয়া-আসা করত।

ভার্গব মহারাজ গত দু’বছর ওয়ার্ডেন ছিলেন। গর্ব করার মতো একশোটা বিষয় ছিল, সেসব বাদ দিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, আর আমাদের ব্যাচের ভার হাতে পড়েছিল। পুরো ক্লাস সেভেন আর এইটটা আমাদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে গেলেন, এটা-ওটা শিখিয়ে গেলেন, ঝাঁট জ্বালিয়ে গেলেন, ঝাড় দিয়ে গেলেন, লাইব্রেরী করালেন, গীতা পড়ালেন, একশোদশজনকে পোস্টকার্ড লিখলেন, বাগান কোপালেন, ‘ইউ আর স্পিরিট!’ হাঁকড়ে গেলেন, প্রশংসা পাইয়ে গেলেন, গান-চ্যান্টিং-নাটক-শ্রুতিনাট্য-কবিতালেখা-ডিবেট-হাস্যকৌতুক-গীতিআলেখ্য-আলোচনাসভা-বক্তৃতা-একজিবিশন খাইয়ে গেলেন। রসকষ বলে কিছু নেই, বোন-টিবির রুগী, সবেতে খ্যাঁচখ্যাঁচ (হাসিটাও শুনতে কেমন অদ্ভুত, ফেক-ফেক), নিজে ব্রহ্মচারী আমাদেরকেও ব্রহ্মচারী বানানোর মতলব। একবার শুধু আমরা ডাইনিং হলে নিজেদের থালা না ধুয়ে বেসিনে ফেলে চলে এসেছিলাম, ডাইনিংহলের দাদাদের কাজ বেড়ে গেছিল, তখন ভার্গব মহারাজ আমাদেরকে একটা বর্ণও না বকে, আসলে কিছু জানতেই না দিয়ে, নিজে সেই নাহোক ষাট-সত্তরটা থালা মেজে দিয়ে এসছিলেন, আমাদের ওয়ার্ডেন বলে। আর তার দু’দিন বাদে এক্সকারশন ছিল, আমাদের বলেছিলেন তোমাদের সাথে যাবো না। ওসব টুকটাক একটু কেমন যেন লেগেছিল, কিন্তু বেসিকালি বিন্দুমাত্র কোনো মানে হয় না। আমাদের ব্যাচটা এইট পার করেই আবার বেলুড় চলে যাওয়া কথা, ফর্ম্যাল ব্রহ্মচারী হওয়ার প্রবেশনারি ট্রেনিং সেন্টারে। তো ফাইনালের পরে, ছুটির আগে শেষদিন রাতের খাওয়ার পরে পাঠ হয়ে গেল, মহারাজ বলতে উঠলেন। উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে কীসব যেন বললেন, তার পর রোগা রোগা হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে বললেন, তোমাদের সেবায় যদি কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে ক্ষমা কোরো।

চলে যাওয়ার পর শুনতাম একটা জিনিস নিয়েই নাকি গর্ব করতেন, ওনার ‘গোল্ডেন ব্যাচ’। ওরকম ডাকনাম এমনিতে পাসিং-আউট ব্যাচ ছাড়া কেউ নেয় না বা দ্যায় না, কিন্তু ওনার তো আর নাইন-টেন ছিল না। – নাইনের নিউ ইয়ারে আমাদের সদনের ঠিকানায় একটা মস্ত বড়ো কার্ড এলো, খুব সুন্দর। ভার্গব মহারাজ পাঠিয়েছেন আমাদের ব্যাচকে, – ‘To the inmates of Vivekananda Sadan’। গৌতমদা নীচের নোটিস বোর্ডে আটকে দিলেন সেই কার্ড।

আমরা গোল্ডেন ব্যাচ তো বটিই। ডে ওয়ান থেকে সোনামুখ করে ওয়ার্ডেনদের জান কয়লা করতে স্টার্ট করে দিলাম।

নতুন স্টাডি হল আমাদের। বিরাট বড় হলঘর, তাতে একশোটা ডেস্ক একশোটা চেয়ার। এত বড় স্টাডিহলে বসে জিন্দেগীতে পড়িনি। বসে বসে পড়তে অস্বস্তি হচ্ছে, – মনে হচ্ছে সবাই দেখছে। সবাইকে দেখা যাচ্ছে, ফার্স্ট বয় কী মন দিয়ে পড়ে সেই থেকে আরম্ভ করে যার ওপর খতরনাক ক্রাশ তার শার্টমোড়া পিঠ অবধি। দুটো রো ওপার থেকে আবার খচ্চর স্যাঙাত মিটমিট করে তাকায়, শালা কমিক রিলিফ দিচ্ছে। পড়বে কী? ডেস্কের তলায় হাঁটু মুড়ে ভূমা সামলা! কয়েকদিন পরে সয়ে গেল।

স্টাডিহলে ঢোকার মুখে দু’পাশে দুটো আলাদা ছোটো ঘর। একটাকে বানানো হল র‍্যাঙ্কারদের জন্য স্পেশাল স্টাডিরুম, যাতে বাকি বিরানব্বইটা ভেড়ার উৎপাতে তাদের মাধ্যমিক হড়কে না যায়। আর আরেকটাকে বানানো হল ‘ডিসকাশন রুম’। স্টাডিহলে কোনো ফিসফাস চলবে না, কারো সাথে কিছু পড়া আলোচনা করার থাকলে স্যারকে বলে ওই ঘরে যাও। ডিসকাশন রুম আমরা প্রবল ব্যবহার করতাম। তবে পূর্ণ ইন্টেলেকচুয়াল লিবার্টির সহিত। ব্যাপারটাকে রিডিফাইন করে নিচ্ছিলাম আর কী। সেসব ঘটনা বিস্তর – মিষ্টি, নোনতা, কতরকম।

ফাইনাল আসত আর পড়াশোনা মাথায় উঠত। একে তো পুরো শীতকালটা ধরে একের পর এক অনুষ্ঠান। ক্রিসমাস আর সরস্বতীপূজা তো রইলই, তার ওপর তিন-তিনটে তিথিপুজো, নরনারায়ণসেবা, এদিকে যুব দিবস, নেতাজী জয়ন্তী, প্রজাতন্ত্র দিবস, পাশাপাশি প্যারালাল প্যারেড ও ড্রিল অনুষ্ঠান, স্পোর্টস, স্কুল একজিবিশন। আর অফিশিয়াল এসব বাদ দিয়ে ভুললে চলবে না সীজন অনুযায়ী গোলাপবাগানে বিশেষ হাতসাফাই এবং সেই লুঠের সদ্ব্যবহার। এমনকী কুঁড়ি রিজার্ভ করা থাকত। অল্‌স ফেয়ার ইন… জানা কথা।

এসব একে একে ফুরিয়ে আসতে না আসতে আকাশের গায়ে রঙ বদলে যেত, নাগলিঙ্গমের ডালে দেখা দিত সবুজ পাতা, পলাশের সাথ ধরে শিমুল আর রুদ্রপলাশরা এসে জুটত আর কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় ভেসে যেত বিদ্যাপীঠ গ্রাউন্ডের ধারের গাছগুলো। বুঝতাম, শীত আর নেই – বসন্ত এসে গেছে। দূরে কী সুন্দর মাঠ আর গাছ আর ঝলমলে সাদামেঘ আকাশ, সারাদিন যত বই মুখে করে বসে থাকো, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে আর একটুও পড়ায় মন বসবে না।

মাঝে মাঝে বাইরে যাব বলে একটু স্টাডিহল টু সদন ঘুরে আসা। একটা ফুটবল মাঠের মধ্যে দিয়ে কাঁকর হাঁটাপথ। পাইনগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে কী হাওয়া, কী হাওয়া! আকাশ এত নীল, যে গায়ের ধামশার্টের সাথে পার্ফেক্ট ম্যাচ করে যায়। ফিরে এসে ডিসকাশন রুম। হিস্ট্রি।

আর সন্ধেবেলা! ক্লাস টেন। সামনে মাধ্যমিক। সাত বছর ধরে বিদ্যাপীঠিয়ানার এই নাকি চরম ক্লাইম্যাক্স। যুদ্ধকালীন নিরাপত্তা, নিশ্ছিদ্র প্রস্তুতি চলছে যত দিক থেকে পারা যায়। স্যাররা খাটছেন, ওয়ার্ডেনরা বসার সময়টুকু নিচ্ছেন না, বাবা-মা নিজেদের জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া আয়ুধ যোগাচ্ছেন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাযুদ্ধের। র‍্যাঙ্কার রুমমেট দায়িত্ব নিয়ে ফেলটু বন্ধুর অসুবিধা ক্লিয়ার করে দিচ্ছে। কিন্তু ‘জীবন তো থেমে থাকতে পারে না!’ …

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *