বিবেকানন্দের ব্যাপারে আমার বক্তব্য কী তা বোঝা খুব সহজ। যদিও সবার মতো নয়। চারপাশে একদল আছে বিবেকানন্দ-ভক্ত, তারা বিবেকানন্দকে নিয়ম করে ‘স্বামীজী’ না বললে মাইন্ড করে; তাদেরকে যদি বলা হয় ‘শঙ্করীপ্রসাদ বসু তো যেখানে যেটা খুশী সেটাই বলেছেন’ তাহলে তারা ফোঁস করে উঠে বলে ‘তুমি কি শঙ্করীপ্রসাদ বসু?’ আবার অন্যদল স্বামী বিবেকানন্দ বললে এমন একটা মুখ করে যেন লোকটা আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কন্সপিরেসি, দেড়শো বছর ধরে এখনো অবধি কোটি কোটি মানুষকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে।
আমার বন্ধু ঋভুর সাথে অনেকদিন আগে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। ঋভু জানে আমি বিবেকানন্দ ভালোবাসি, তাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমার অবস্থানটা ঠিক কী। এই যে আমি রামকৃষ্ণ মিশনের এতদিনের ছাত্র, এই হিসেবে আমার নিজের ব্যাপারে এবং মিশনের ব্যাপারে অভিমত কী। সেই কথাবার্তার অনেকটাই অমতে-দ্বিমতে ভরা ছিল, কিন্তু খুব ঠিকঠাক ছিল সেই আলোচনা। তার একটা কারণ অবশ্য একশোভাগ অকপট সততা। নিজের গভীরতম বিষয়ে সৎভাবে কথা সবাইকে বলা যায় না। সেদিনের সান্নিধ্যে সেই বিশ্বাস ছিল বলেই সেসব কথা হতে পেরেছিল।
আমার কাছে বিবেকানন্দ প্রিয় তার কারণ লোকটাকে আমার দারুণ লাগে। আমি তার সাথে নিজের মিল খুঁজে পাই, তার ভুলভালের সাথে নিজের ভুলভাল ম্যাচ করাতে পারি।
বিবেকানন্দ কোথা দিয়ে প্রেরণা হয় তা বোঝানো খুব শক্ত কারণ তা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেসব ভাষায় বললে নাটক হয়ে যায়। আমাদের একজন শিক্ষক বলতেন যদি জীবনে শান্তি চাও তাহলে কোনোদিন বিবেকানন্দ পোড়ো না। কারণটা নিজে থেকে ব্যক্ত করতেন না, জিজ্ঞেস করলে বলতেন। বিবেকানন্দ পোড়ো না কারণ বিবেকানন্দ পড়লে খুব বিপজ্জনকভাবে নড়ে যেতে হয়। সেটা হলে আর তোমার কেরিয়ারের গ্রাফ বাঁধা হবে না। নিজের ক্ষমতায় আরাম কিনে সেই পেয়ালায় আর শান্তিতে চুমুক দেওয়া হবে না।
বিবেকানন্দের ইচ্ছে ছিল, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ফ্যানটাসি ছিল – আই শ্যাল বিকাম আ ভয়েস উইদাউট আ ফর্ম। তার ছবি থাকবে না, নাম মুছে যাবে – কিন্তু যে কথাগুলো বলে গেছে সেগুলো টিকে যাবে, হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে থাকবে আরো আরো বহু বছর। কাজ করে যাবে ক্যাটালিস্টের মতো। এই স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। কিন্তু মানুষের জীবনে কোথা দিয়ে যেন ঝরা ফুলও নতুন করে ফুটে যায়। এখনও বিবেকানন্দের কথা ভেবে কীরকমভাবে মানুষ একেকটা কাজ করে বসে, তা খুব অদ্ভুত।
জীবনকে টানার জন্যে যে দম লাগে তা আমি বিবেকানন্দের থেকে পাই। বিবেকানন্দ জীবনে প্রচুর লড়াই করেছে। শারীরিকভাবে মানসিকভাবে প্রচুর কষ্ট সয়েছে। ‘অমৃতবাণী’-তে কী ছাপা আছে তা নিয়ে আমার বিশেষ কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু যখন আমি দশটাকা বাঁচানোর জন্য টোটো নিতাম না, অনেকদূর হেঁটে পা ব্যথা হয়ে যেত, তখন আমার বিবেকানন্দের কথা মনে পড়ত। যখন আমার খাওয়াদাওয়া নিয়মমতো হত না, তখন আমার মনে পড়ত হেঁটে ভারতবর্ষ ঘোরার সময় বিবেকানন্দ নাকি বেশী করে লঙ্কা খেত কারণ তাতে তার দূষিত জল-খাবার থেকে পেট খারাপের ভয় কমত। মনে পড়ত যে এরা নাকি বরানগরে ভূতুড়ে বাড়িতে মঠ করে থাকার সময় তেলাকুচো পাতার ঝোল দিয়ে ভিক্ষে করা চালের ভাত খেত, আর কোনোদিন একটু দুধ পেলে সবার পাতে একফোঁটা করে সেই দুধ ‘পরিবেশন’ করে মহানন্দে ভোজ লাগাত। আমার এইসব কথা মনে পড়ে।
বিবেকানন্দ আমার কাছে শার্লক হোমসের মতো একজন ইনভেস্টিগেটর যে ‘জানা কথা’-য় আস্থা না রেখে, প্রিজুডিসে ভরসা না করে নিজেই চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের জন্য এক্সপেরিমেন্ট করতে ভারতভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিল। এই জার্নির জন্য আমার বিবেকানন্দের কথা মনে পড়ে। আমার নিজের জীবন নিয়ে আমি যখন ভাবি তখন প্ল্যান করি যে আমার যখন চল্লিশ বছর বয়স হবে তখন আমি পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে পড়ব, আর ফিরব না। কী নিয়ে বেরোব কতদূর যাব জানি না, হয়তো স্টেট বর্ডার না পেরোতে বডি পড়ে যাবে তাও হতে পারে, কিন্তু বেরোব। এই যে একটা অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট করার স্বপ্ন দেখি, এই স্বপ্নের জন্য আমার বিবেকানন্দকে মনে পড়ে। এই যে মাঝেমাঝে ‘অফ মনস্টারস অ্যান্ড মেন’-এর ‘ক্রিস্ট্যালস’ শুনতে শুনতে একটা চরম এসকেপ ভেলোসিটি আসে, ব্রুস স্প্রিংস্টিন চালিয়ে স্পষ্ট রক্তের মধ্যে ‘বর্ন টু রান’-এর ঝাপটা শুনতে পাই, এর প্রথম স্বাদ আমাকে বিবেকানন্দই দিয়েছে।
বিবেকানন্দ বলেছিল First, believe in this world–that there is meaning behind everything. Everything in the world is good, is holy and beautiful. If you see something evil, interpret it to mean that you do not yet understand it in the right light. এই কথাটা আমার এত ভালো লেগেছিল এবং এমনভাবে আমার মনে গেঁথে গেছিল যে আজ অবধি তার স্পষ্ট জের থেকে গেছে, যে কারণে আমার চট্ করে কোনো একটা জিনিস খারাপ লাগে না, বা আমি খারাপ বলি না। আমার ‘পথের পাঁচালী’-ও ভালো লাগে আবার ‘দ্য এক্সপেন্ডেবলস’ দেখতেও কোনো অসুবিধা হয় না, কারণ আমি নিজের অবস্থান বদলে নিই, এবং দুটো সিনেমাই যে আমাকে শুধু আচ্ছন্ন করে তাই নয়, অনুপ্রাণিতও করে। এটা যে হয় তার কারণ ওই লাইনটা। আমি বিশ্বাস করি যে হীরের ঝলক দেখতে গেলে সেটা ঠিক আলোয় ধরতে জানা দরকার, এবং হীরের দাম বুঝতে গেলে সেই হীরের জহুরী হওয়াও দরকার। আমি যখন ‘গানভঙ্গ’ পড়ি তখন এই কথাটার সাথে কোথা দিয়ে যেন একটা চোরা মিল পাই। আমার চেতনার রঙ যে কতটা জরুরী সেটা আমাকে এইসব কথাগুলো মনে পড়িয়ে দেয়।
বিবেকানন্দ অন্যায় করেছেন বলে অনেক দাবী আছে। বিবেকানন্দ ভুল বলেছেন বলে দাবী আছে। আমি কোনোরকম ডিফেন্সের দিকে যাচ্ছি না। আমি এটা বলতে চাই যে আপনি একটা মানুষ হয়ে আরেকটা মানুষকে জাজ করছেন এটা মনে রাখবেন। আপনি লাথি চালাচ্ছেন চালান, কিন্তু ওই একই লাথি আপনার গায়ে পড়লে আপনি কোথায় যাবেন সেটাও হিসেব করবেন। কারণ বিবেকানন্দ দেবতা নন, কিন্তু আপনিও মানুষ।
আমার বিবেকানন্দকে নিয়ে আবেগ এবং ভালোবাসা নিতান্তই পার্সোনাল জায়গায়। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বিবেকানন্দ অনেককিছু জোগায়। একই কথা রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও। এরা দু’জনে আমার হোয়াইট ক্যান্ডল ওয়ান অ্যান্ড হোয়াইট ক্যান্ডল টু। আমি যখন প্রেমে পড়েছি তখন গীতবিতান না থাকলে কী করতাম কেউ জানে না, এবং এই একই কথা হাজার বাঙালীর ক্ষেত্রে সত্যি। একইভাবে আমি যখন দিশা খুঁজি বা পায়ের তলায় পাথর পাই না, তখন বিবেকানন্দ অনেকভাবে আমাকে বাঁচায়। এটা তো কখনোই নয় যে একমাত্র বিবেকানন্দের কাছেই আমি ঋণী। এমন নয় যে শুধু বিবেকানন্দই আমার কোডেক্স। কিন্তু হ্যাঁ, আমার কোডেক্সে বিবেকানন্দ থাকবেই, আছেই।
এই যে শারদ্বতের লেখা পড়ে আমি এখন লিখছি। একটা বিদ্যাপীঠের ছেলে আরেকটা বিদ্যাপীঠের ছেলের লেখা পড়ে ফিরতি চিঠি দিচ্ছে। শারদ্বতও তো মিশনের ছেলে। ও গরু খায় আমিও গরু খাই, ও মিশনকে গাল দেয় আমিও মিশনকে গাল দিই, ও শপথ করে বিদ্যাপীঠে পা রাখবে না – আমি স্যারদের চিঠি লিখি যে জ্যাকিকে যারা খাঁচায় আটকে রাখে তারা অভিশপ্ত। কিন্তু এই আমরা দু’জনেই কিন্তু বিদ্যাপীঠেরই ছেলে। বিদ্যাপীঠের এবং বাদবাকি অজস্র মিশনের যত লজ্জা সেসব আমরাই সবচেয়ে ভালো জানি। কিন্তু তাই বলে আমরা জামাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিই না – যেটুকু থাকার সেটুকু থেকে যায়। এটা একটা আইডেন্টিটি, আমরা কোন ঘরের ছেলে সেই পরিচয় এর মধ্যে রয়ে গেছে। কিন্তু আমি ঘরের বলে বাইরের নই, এমনটা নয়।
এবং ঘরেরও সবকিছুই আমি নিজের মধ্যে মেখে নিচ্ছি তাও নয়। এই মিশনেরই গডফাদারের ডায়লগ: ‘গোলমালের ভিতর থেকে গোলটি ছেড়ে মালটি নিতে হবে।’ আমাদের স্ট্র্যাটেজি এটাই, এবং এটাই কমনসেন্সিকাল। আমি ফেলুদার ভক্ত বরাবর, কিন্তু তাই বলে আমি তো আর সিগারেট খাই না।
বিবেকানন্দ আমার কাছে অতিমানব নয়। একজন মানুষ যে আমাকে প্রভূত পরিমাণে উৎসাহ দেয়।
শক্তিদার রুমে আমি আর যশ, জিজ্ঞেস করেছি স্বামীজীর স্যালিয়েন্ট ফিচারস কী কী। শক্তিদা প্রথম পয়েন্টে কী একটা বলে তারপর খুব জোর দিয়ে বলে উঠলেন – ‘…রেকলেস চ্যারিটি… রেকলেস চ্যারিটি।’ ওই ‘রেকলেস’ কথাটা কানে লেগে গেছিল। লাগাম কষে ইনকাম ট্যাক্স বাঁচানেওয়ালা চ্যারিটি সবাই করতে পারে। কিন্তু ‘রেকলেস’ চ্যারিটি! করা সোজা নয়, হয়তো করা উচিতও নয়, কিন্তু পার্ফেক্ট কে? থাকলই বা কারুর রেকলেস চ্যারিটি করার দোষ! থাক না! আমার নিজের বেঠিক এবং বেহিসেবী কাজ – যেগুলো হয়তো মাথাওয়ালা লোক হলে করত না, এবং না করলে কেউ দোষও দিত না – সেগুলো যখন আমি করি, তখন তোল্লাইটা ওই বিবেকানন্দই জোগায়। এবং কখনো যখন একটু বেশীই হিসেব করে ফেলি তখন নিজের ভেতর থেকেই পাছায় যে অদৃশ্য লাথি পড়ে, সেটার ওই থেকেই আসে। ‘ছোটলোকের মতো ভাবতে লজ্জা করে না?’ – এই কথাটা যে নিজেকে বলি এবং বলে সত্যিই লজ্জা পাই, তার জন্যে আমার বিবেকানন্দকে মনে থেকে যায়।
আমার অনেকদিনের বদনাম যে আমি খুব এক্সট্রীম। অস্বীকার করার ব্যাপার নেই, সেটা ফ্যাকটরও না। কিন্তু এই একই জিনিস বিবেকানন্দের মধ্যেও আমি কোথাও একটা পাই। বিবেকানন্দের একটা কথা আমার মনে পড়ে, তুরীয়ানন্দকে বলা – ‘হরিভাই, আমি এখনও তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না। কিন্তু, আমার হৃদয় খুব বেড়ে গেছে এবং আমি অপরের ব্যথায় ব্যথা বোধ করতে শিখেছি। বিশ্বাস করো, আমার তীব্র দুঃখবোধ জেগেছে।’ এটা একটা কথার কথা নয়। একজন লোক যে বলছে – ‘Do you feel? Do you feel that millions and millions of the descendants of gods and of sages have become next-door neighbours to brutes? Do you feel that millions are starving today, and millions have been starving for ages? Do you feel that ignorance has come over the land as a dark cloud? Does it make you restless? Does it make you sleepless? Has it gone into your blood, coursing through your veins, becoming consonant with your heartbeats? Has it made you almost mad? Are you seized with that one idea of the misery of ruin, and have you forgotten all about your name, your fame, your wives, your children, your property, even your own bodies? Have you done that? That is the first step to become a patriot, the very first step’, যে এই ভাবের তাড়ায় পাগল হয়ে দেশে বিদেশে ফিরে বেড়াচ্ছে, কিছু একটা করার তাড়নায়, কিছু একটা বদল আনার চেষ্টায়, – তার মধ্যেকার ঝড়টা বোঝা খুব কঠিন। শুধু বিবেকানন্দ নয়, সেইযুগের কত কত মানুষ এরকম পাগল হয়েছিল, দিগ্বিদিক ভুলে একটা আইডিয়াকে আঁকড়ে ধরে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের পথে তারা স্বেচ্ছায় ভেসে পড়েছিল। কেউ ম্যাৎসিনি-মার্ক্স-লেনিন কিচ্ছু না পড়ে কিচ্ছু না জেনেবুঝে শুধু ডানপিটেমির বশে পিস্তল ধরতে চাইছে, কেউ ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে জেলের ভেতর তেষট্টিদিন না খেয়ে পড়ে থেকে মরছে, কেউ জ্বলজ্বলে চোখে ক্লাসরুমের ভেতর তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেদের নিষিদ্ধ আগুন শেখাচ্ছে – একদিন বিপ্লব আনতে হবে বলে। আমিও তো মাস্টারী করি, চেপেচুপে সময় বার করি সিলেবাসের বাইরের কথা শোনাব বলে, বাউল গান শোনানোর মতলব আঁটি, মিডল আর্থের ম্যাপ দেখাই, নিঃস্বার্থপর হতে বলি, সুপারফিশিয়ালিটিকে ঘৃণা করতে শেখাই, প্যাশনকে ধাওয়া করে যেতে বলি যতদিন পারে ততদিন। কেন বলি এসব? যখন নিজে পায়ে পায়ে বুঝি সব ঝুট হ্যায়? কেন এদেরকেও আমি জেনেশুনে ডোবাই? কেন বলি না যে মিথ্যে বলো, ক্ষমতাশালী হতে চেষ্টা করো, মন থেকে এথিকস উপড়ে ফেলে দাও বয়স কাঁচা থাকতে থাকতে? কেন স্বপ্নের কথা বলি, আর নিজেরা যে সব বাঁশ খেয়েছি জীবনে সেই কথা সযত্নে গোপন করে যাই? কারণ আমিও সৈনিক, যে যুদ্ধ কখনো থামে না সেই যুদ্ধে আমিও সামিল। এদেরকে দলে টানি আমি, যাতে ওদিকে না গিয়ে ওরা এদিকে আসে, এদিকের হয়ে লড়ে, প্রাণ দেয়। চতুরালি বলবেন, ব্রেনওয়াশিং? হ্যাঁ একদিক থেকে তো তাই। এথিকস জিনিসটা চিরকালই ব্রেনওয়াশিং। ভ্যালু জিনিসটা কখনো তর্ক করে শেখানো যায় না, সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে চারিয়ে দিতে হয়। এই বিবেকানন্দ লড়াই লড়েছিল, এখন আমিও লড়ছি, আমার প্রিয় অনেককে জানি, তারাও লড়ছে। এর মধ্যে পার্ফেক্ট ব্যালেন্সড মহামানব খুঁজবেন না। ইমোশনাল, টেম্পারামেন্টাল, আনপ্র্যাক্টিকাল পাগল খুঁজুন। তার মধ্যে উল্টোপাল্টা মানে-হয়-না এমন অনেক ঝঞ্ঝাট পাবেন। অভিমান আপাতভাবে পাবেন না, তবে রাগ পাবেন। যোদ্ধার প্রতিস্পর্ধা পাবেন। এখানে বব ডিলান বা ডেভিড বোয়ি খুঁজবেন তো পাবেন, কোল পোর্টার বা কেনি রজার্স বড় একটা পাবেন না।
এক মাস্টারমশাই ক্লাসে বলেছিলেন একবার কবিতা থেকে কোট করে। ‘পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার।’ আমি নাস্তিক, ভগবান মানি না (আসলে কমপ্লিট মোনিস্ট) – এই কোটে ‘তিনি’ কে জিজ্ঞেস করলে ভালো বলতে পারব না, তবে অভিঘাতটা বরাবর মনে থেকে যায়। পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার। এই সারাজীবন ধরে হাসি-কান্না-বিরহ-মিলন-ভাঙা-গড়া মিলে যা চলেছে তা একটা পূজা, নট ধূপধুনো, নট ফুলবেলপাতা, এই পূজার উপচার অন্য। লড়াই… সংগ্রাম অপার। নয় নয় এ মধুর খেলা।
মিলেমিশে যায় সবকিছু। ডাম্বলডোর তো একই কথা বলেছিল।
এখন আপনি ইতিহাস ঘেঁটে কোনোক্রমে যদি তথ্য হাজির করে বলেন যে না না না বিবেকানন্দ তো আসলে এরকম ছিলেন না, উনি আসলে এরম, তোমার মনের ইমেজটা ভুল, অসত্য, তাহলে সেটা আমাকে শুনিয়ে কোনোই লাভ নেই কারণ আমি তো ভাই উলভারিনেও বিশ্বাস করি।
আমি একটা গল্পের চরিত্র, এই গল্প আমার জীবন। আমি যাদের নিয়ে থাকি তারাও গল্পের চরিত্র। আমি বিবেকানন্দকে দেখিনি এবং হয়তো উনি অন্যকিছু ছিলেন, হবেও বা, কিন্তু আমার বিবেকানন্দ যেহেতু আমার পার্সোনাল লোক, যেহেতু আমি তার ফোটো ছাপিয়ে বাজারে বিক্রি করি না এবং মন্দির গড়ে সবাইকে পুজো দিতে বলি না, তাই আমার বিবেকানন্দের ভার্সনটাও আমার পার্সোনাল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট অফ হিস্টরিক্যাল মিউজিং। বললাম যে, আমি ব্যাটম্যান উলভারিনেও বিশ্বাস করি। তাদের কথা পড়ে, তাদের কাজকর্ম মনে করে আমি জীবনে চলার দম পাই। তুমি পাও না, পেও না।
একজনের কথা বলতে গিয়ে আরেকজনের লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘বস্তুত মানুষ-ঘটিত ব্যাপারে একই জায়গায় আমরা অনেক উল্টা কাণ্ড দেখিতে পাই। মানুষের দেখা-অংশের মধ্যে যে-সকল বৈপরীত্য প্রকাশ পায় মানুষের না-দেখা অংশের মধ্যেই নিশ্চয় তাহার একটা নিগূঢ় সমন্বয় আছে; অতএব আসল সত্যটা যে প্রত্যক্ষের উপরেই ভাসিয়া বেড়াইতেছে তাহা নহে, অপ্রত্যক্ষের মধ্যেই ডুবিয়া আছে; এইজন্যই তাহাকে লইয়া এত তর্ক, এত দলাদলি এবং এইজন্যই একই ইতিহাসের দুই বিরুদ্ধ পক্ষে ওকালতনামা দিয়া থাকে।…অল্প লোকই এমন পুরাপুরি বলিষ্ঠ যে তাঁহাদের ধর্মবোধকে ষোলো-আনা কাজে লাগাইতে পারেন। কিছু-না-কিছু ভ্রষ্টতা আসিয়া পড়ে। কারণ, আমরা সকলেই হীনতা হইতে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছি, চরমে আসিয়া দাঁড়াই নাই। কিন্তু জীবনে আমরা যে-কোনো স্থায়ী বড়ো জিনিস গড়িয়া তুলি, তাহা আমাদের অন্তরের ধর্মবুদ্ধির সাহায্যেই ঘটে, ভ্রষ্টতার সাহায্যে নহে।’ … বিবেকানন্দ হাজারো কারণে ভুলভাল হতে পারে, কিন্তু সে তো আমিও, বাকি সবাইও। এটাই তো পৃথিবী।
বিবেকানন্দের ব্যাপারে আমার প্রথম খটকা লেগেছিল ক্লাস ইলেভেনে। আমি তখন একাগ্র বিবেকানন্দ-ফ্যান, কিছুদিন আগে সঞ্জীব মহারাজ ঘুরে গেছেন, তার কয়েকমাস আগে জীতাত্মানন্দ, আমি রীতিমত লং টার্মে ফুটছি। জীতাত্মানন্দের সাথে মীট হবার পর প্রায় তিন-চারদিন আমার হাঁটার স্টাইল পালটে গেছিল। স্টোর থেকে ‘লেকচারস ফ্রম কলম্বো টু আলমোরা’ কিনেছি, সাথে করে ডায়নামাইটের মতো নিয়ে বেড়াই। সেই সময় লাগল ধাক্কা। বিবেকানন্দকে ‘আইডিয়াল’ থেকে ‘রিয়্যাল’-এ নামানোর সেই আমার শুরু।
ক্লাস ইলেভেনে আমার দু’বার মাথার ফিউজ উড়ে গেছিল। প্রথমবার যেকারণে উড়েছিল সেটা হচ্ছে বায়োলজির ইভলিউশন। ক্লাসে গোটা দুই বন্ধুর গোটা তিনেক বিদেশী বায়োলজি বই ছিল, সেগুলো ঘেঁটে পড়ছিলাম ক’দিন। তা, ইভলিউশন চ্যাপ্টারটা পড়ে জাস্ট খেয়ে গেলাম। রাতে খাবার ঘন্টা পড়েছে, আমি করিডোর দিয়ে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি কী পাগল লেভেলের জিনিস এই মিউটেশন হয়ে হয়ে এতরকম ধরনের প্রাণের বিবর্তন, একটা সাকসেসফুল ক্যামোফ্লাজ তৈরী হতে কী লেভেলের চান্স লাগে, কী অসম্ভব অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্যি! ভাবছি আর মাথায় তারাবাজি ফাটছে। এইরকম সময় একদিন সন্ধেবেলা দেখি ‘স্বামী-শিষ্য সংবাদ’ না কীসে যেন স্বামীজী মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে শিষ্যকে কচ্ছপের এক্সপ্লেনেশন দিচ্ছেন – আদিম কালের সাপ বহু যুগ একস্থানে স্থবির হয়ে বসে থেকে থেকে খোলা জমে গিয়ে কচ্ছপ হয়ে গেছে।
মাথায় ঢকাস করে ঢিল পড়ল: কী হল ব্যাপারটা???
কিছুতেই নিতে পারিনি এই অদ্ভুত স্বামীজী-ব্র্যান্ড থিওরি। এবং তখনি বুঝেছিলাম যে না বস, ব্লাইন্ডলি আর নেওয়া যাচ্ছে না। তুমি এনসাইক্লোপিডিয়া মুখস্থ করে থাকলেও থাকতে পারো, কিন্তু তোমার যুগের এনসাইক্লোপিডিয়াও এখন ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে।
তাহলে বিবেকানন্দের কোনটা আমার কাছে থেকে গেছে? …একদিন নাইনের ইংরেজী ক্লাসে শক্তিদা ঢুকে ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখলেন –
Have thou no home. What home can hold thee, friend?
The sky thy roof, the grass thy bed; and food
What chance may bring, well cooked or ill, judge not.
….. Like rolling river free
Thou ever be…
লিখে বললেন – “ট্রাই টু গেস দ্য পোয়েট!”
ক্লাসে কারুরই ‘The Song of the Sannyasin’ পড়া ছিল না, আমার তো নয়ই। কিন্তু তাও, দু’একজন ভুল উত্তর দেওয়ার পর, আমি হাত তুলে ঠিক জবাব দিয়ে ফেলেছিলাম, আন্দাজেই শিওর হয়ে। সেই থেকে এই লাইন ক’টা আর ভুলিনি। এই লাইনগুলোয় যে জিনিসটার গন্ধ মাখা আছে, আমার কাছে সেইখানেই বিবেকানন্দ।
আমি শক্তিদাকে বলেছিলাম, স্যার আমার দু’জনকে খুব একরকম মনে হয়, টেনিদা আর বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ টেনিদাকে পেলে খুব খুশী হতেন। – শক্তিদা টেনিদার ফ্যান নন, শুনে হেসেছিলেন।
কিন্তু সত্যি আমার কাছে টেনিদা স্বামীজীর মডেল চ্যালা। কেন সেটা বুঝতে গেলে ‘কম্বল নিরুদ্দেশ’ আর ‘চারমূর্তির অভিযান’ আবার চেক করে নিন। কোন পাতা সেটাও বলে দেওয়া যেত, কিন্তু দেব না। টেনিদা ইজ নট জাস্ট আ ফুলিশ বুলি অ্যান্ড লাউডমাউথ। সেই মুডে প্রায়সময়েই থাকে বটে, বাট দ্যাট ইজ নট টেনিদা। সেটা যে ভাবে, সে কোনোদিন আইনস্টাইনকে ধ্যাদ্ধেড়ে ঝোপড়াপানা বুড়ো বলে বর্ণনা করে বসতে পারে। – শক্তিদাকে খাওয়ানো যায়নি, কিন্তু পরে একবার আমি ফেসবুকে একটা পোস্টে টেনিদার সাথে বিবেকানন্দের মোলাকাত করিয়েছিলাম, সেটা লোকে খেয়েছিল।
বিবেকানন্দ বলত ‘আগের জন্মে আমি বাবর ছিলাম।’ বাবরের বর্ণনায় ইতিহাস বইয়ে লেখা থাকে – ‘আফগান অ্যাডভেঞ্চারার’। রাজা-বাদশা নয়, দুঃসাহসী অভিযাত্রী। তার সিংহাসনে বসার কোনো দরকার নেই, নট রিয়েলি। বাবরের সমাধি বাকি সব মুঘল বাদশার সমাধির থেকে আলাদা। কবি ছিলেন বাবর। বিবেকানন্দের ছবিটাও সেরকমভাবে থেকে গেছে আমার মধ্যে।
কাল পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এমন সময় নীচ থেকে ইতিউতি কয়েকটা শুকনো সেগুন পাতা উড়িয়ে একটা হাওয়া উঠল। প্রথমে পাতা, তারপরে ধুলো উঠল সঙ্গে। পাক খেতে খেতে একটা ঘূর্ণির মতো হয়ে আমাদের বাঁদিক থেকে এসে ডানদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপাশে মিলিয়ে গেল। অনেকক্ষণ অবধি দেখতে পাচ্ছিলাম, পাক খেয়ে শুকনো পাতার রাশ আকাশে উঠে যাচ্ছে, দূর থেকে চিল মনে হয়, পাতা বলে বোঝা যায় না। …পাশের জন বলল, ‘আমিও কখনো এরকম দেখিনি।’
পথের ধারে তিনজন মানুষ একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে – পাহাড়ের গা বেয়ে বাতাস উঠে শুকনো পাতার ঘূর্ণি তুলে চলে গেল। তার ছবিও তোলেনি কেউ, মানুষকে গল্প করার মতো কথাও নয় কিছু, রামধনু বা প্রজাপতির মতো তো নয়। কিন্তু অন্য রকম এক ধরনের দেখার মধ্যে কখনো কখনো একটা অদ্ভুত বিস্ময় থমকে থাকে, তার ঠিক ছবি হয় না। সায়েন্স ফিকশনের মানুষরা বলেন, ‘সেন্স অফ ওয়ান্ডার’। এই বিস্ময়বোধ না থাকলে পৃথিবীর বেশীটাই আর দেখা হয় না। মনে আছে ব্রহ্মানন্দ সদনে শোনা স্বপনদার মুখের কথা – মানুষকে শুধুমাত্র মানুষ বলে এতটা আর কেউ ভালোবাসেনি। – জানি এর বিরোধী কথা বিবেকানন্দের বই ঘাঁটলে দাঁড় করানো যায়। এর চেয়ে বেশী কে কে ভালোবেসেছিল তা নিয়েও কথা হতে পারে। জীবনে আওড়ানো সমস্ত লাইনের হিসাব নিতে বসলে প্রমাণ করে দেওয়া সম্ভব যে কোনো মা-বাবা আসলে তাঁদের সন্তানকে ভালোবাসেন না। কে কখন কী ভেবে কতটুকু কী বলে আর কতটা বলে না, কেউ জানে না। কেউ যদি একবার অবাক হয়ে ভাবে, সাহস করে তাকায়, তাকিয়ে বিস্মিত হয় – একমাত্র তখন একজন মানুষকে সত্যি সত্যি জানতে পারা যায়। কোন মানুষের আগুন কোথায় লুকোনো থাকে, তা জানার অার কোনো রাস্তা নেই। কেবলমাত্র সূর্যটাকে মুখে নিয়ে গিলে ফেললে তখন বোঝা যায় – ‘রু-ব-রু… রওশনি…..’