অমিল খোঁজো তফাৎ বোঝো

না, এটা বোঝা দরকার, কারণ ভালোবাসা অতি বিষম বস্তু। জীবনের বুকে ঝড় তুলে সে মানুষকে রাজা করে দিতে পারে, আবার ভিখারিও করতে পারে। কে যে কখন কীভাবে প্রেমে পড়বে, আর সেই প্রেম তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তার কথা কেউ জানে না। জীবনে যদি কোনোদিন প্রেমে পড়ে যাও, আর কিছু না ভেবে ঝড়ের খেয়ার ভেসে পড়ো – এই হল প্রেমের একমাত্র নিয়ম। অন্য কোনো আইন এখানে খাটে না, এই এক অভিযাত্রা যা কোনোদিন সাবধানে করা যায় না।

প্রেম মানুষকে বদলায়, সূর্যের আলোর মতো, মানুষের পরতে পরতে ঢুকে তার মধ্যেকার অজানা রঙ ফুটিয়ে তোলে, মানুষ নিজের চেহারা নিজে দেখে অবাক বনে যায়। যে মানুষ প্রেমে আছে, তার গায়ে আঘাত লাগে কিন্তু চোট লাগে না, তার চোখে স্বপ্ন লেগে থাকে কিন্তু ঘুম আসে না, তার মন রামধনু হয়ে যায়, তার হাতের কলম আপনিই কাব্যপ্রসূ হয়। প্রবাদ আছে, প্রেমে পড়লে বোকা মানুষ চালাক হয়ে যায়, আর চালাক লোক হয়ে যায় বোকা। একটা মানুষ প্রেমে না পড়া অবধি যা ছিল, প্রেমে পড়ার পরে আর তা থাকে না।

প্রেম কাউকে ভাসায়, কাউকে ডোবায়। এরকম কত আছে, তরতরে তাজা ভালোবাসার গল্প ভুল মোড়ে বাঁক নিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাল অবধি যে কিশোর ছিল, আজ একরাতের তফাতে সে একধাক্কায় বুড়ো হয়ে গেছে। কত আছে, ভালোবাসার পেছনে ছুটতে গিয়ে আস্ত একটা অ্যাডভেঞ্চার চোরাবালিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ভালোবাসার জন্য জাহাজ ভাসিয়ে সে জাহাজ রত্নদ্বীপে গিয়ে উঠেছে, প্রেমের সন্ধানে পথে নেমে সেই পথ রূপকথার দেশে গিয়ে মিশেছে। সবসময় কী আর পথে নামতে হয়? স্টিভ তখন বাবার জু-তে কাজ করে, ক্রকোডাইল এনক্লোজারের সামনে জড়ো হওয়া দর্শকদের কুমীর নিয়ে বলছিল। সেই দর্শকের ভিড়ে ছিল ইউ.এস.এ-র মেয়ে টেরী রেইনস। টেরীকে দেখে স্টিভের মনে হয়েছিল, যেন কেউ মাথার পিছনে কাঠের ডাণ্ডা দিয়ে এক বাড়ি মারল। টেরীর অবস্থাও অনতিবিলম্বে তথৈবচ। সেই হল প্রেমের শুরু। বাকিটা ইতিহাস। প্রেম এভাবেও আসে বইকি!

যারা প্রেম করে সুখী হয়, তাদের কাছে প্রেমের মতো ভালো কিছু আর হয় না। যারা প্রেম করে হ্যাপি এণ্ডিং পায় না, তারা L-O-V-E দিয়ে ‘ভ্যালি অফ টিয়ার্স’ মার্কা ফুল ফর্ম বানায়।

তবে প্রেমে ব্যর্থ হলেই যে শুধু লোকে কবিতা লেখে, এটা একেবারে বাজে কথা। লোকে কবিতা লেখে প্রেমে পড়ে। সফল হল না ব্যর্থ, সেটা কোনো ব্যাপারই না। প্রেমের কোনো সফল-বিফল নেই। যে প্রেম করেছে সে চিরকালই ক্রিজে থেকে চুটিয়ে খেলে গেছে। সেটা বন্ধ হয় তখনই যখন প্রেমিকের মনের ভিতর প্রেম মরে যায়। তখন আর সে প্রেমিক থাকে না, তখন আর তার কোনো কবিতা থাকে না।

প্রেম এক অদ্ভুত জিনিস। পৃথিবীতে একজন প্রেমিকের চেয়ে বড় নিঃস্বার্থপর কেউ নেই। আবার একজন প্রেমিকের চেয়ে বড় স্বার্থপরও হয়তো পৃথিবীতে কেউ নেই। প্রেম হল চূড়ান্ত চরমপন্থা, তার কোনো মাঝ হয় না। একজন প্রেমে-পড়া মানুষের উপস্থিতি তার আশেপাশের লোকের কাছে যে কী পরিমাণ বিরক্তিকর হতে পারে, তার আন্দাজ অনেকেরই আছে। সে নিজে কিন্তু ক্লুলেস। আবার কোথাও একজন লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমে পড়েছে, সে টেরও পায় না যে সবাই সব বুঝতে পারছে। সে চুপিচুপি, ফিসফিসিয়ে, আড়ালে আবডালে তার একান্ত গোপন প্রেম চালিয়ে যায়।

কারো সাথে কারো গল্প মিলবে না। বলেই মনে হল, সত্যি কি তাই? সবার সাথেই সবার গল্প কি মিলেই যায় না? এই হল প্রেম। নাগালে ধরা অসম্ভব। সাধে কি বলছি বিষম বস্তু। কোনো ফর্মূলাতে ধরা যাবে না, কোনো সমতা নেই, ঠিক নেই কোনোকিছুর।

প্রেমিক, মানে যে প্রেম করছে। পুংলিঙ্গ, তাহলে স্ত্রীলিঙ্গ হল প্রেমিকা। – গোলমাল হয়ে যায় এইখানে, যে প্রেমিক যে মেয়েটাকে ভালোবাসছে, সে কিন্তু তার প্রেমিকা না-ও হতে পারে। মেয়েটাও যদি তাকে ভালোবাসে তাহলেই না সে তার প্রেমিকা! তা না হলে? কী বলা হবে! – একটা শব্দ আছে প্রেয়সী। ঠিক হবে কি না ফ্রেণ্ডলিস্টের স্যারেরা বলবে। ? কিন্তু তাহলে প্রেয়সীর একটা পুংলিঙ্গ দরকার। কী হবে?

তারপর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

স্কুলে যখন পড়ি, এক বন্ধু একদিন জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা, ক্রাশ, ইনফ্যাচুয়েশন, আর লাভ – এই তিনটের তফাৎ কী?

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথে এক ছোটো তারা সূর্যের তিন নম্বর গ্রহে দাঁড়িয়ে একটা সতেরো বছরের ছেলে আরেকটা সতেরো বছরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, ক্রাশ, ইনফ্যাচুয়েশন, আর লাভ – এই তিনটের তফাৎ কী।

তখনকার মতো দুজন মিলে ডিকশনারি দেখে মানেগুলো পড়ে, একরকম করে বুঝে মাথা ঠাণ্ডা করেছিলাম। এখন আরেকটু বয়স বেড়েছে। তাই মনে পুরানো দিনের কথা আসে। প্রশ্নটা তো ভাই আজও রয়েই গেছে!

জীবনে তো কোনোদিন বুঝতে পারলাম না, প্রেম করছি না ক্রাশ হয়েছে না ইনফ্যাচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যখন হয়, তখন তো ওই একইরকম মনে হয়। তার নাম কে কখন কী দেয়, কে তা বোঝে, আর কে পরোয়া করে। লোকে অনেকরকম বলে, বন্ধুরা সতীর্থরা সাবধান করে, গাইড্যান্স দিতে চায়। সবই বিলাস। ঝড়ের খেয়া যদি ভাসে, সে ভাসবেই, কারও মানা শুনবে না। সে কীসের জন্য যে নোঙর তুলল, কীসের জন্য পাল ছাড়ল, সে নৌকা ডুববে না ভাসবে, – সব পরের কথা। ভেসে পড়াটাই আসল। লক্ষ্মীরে হারাবই যদি, অলক্ষ্মীরে পাবই!

যার তফাত প্র্যাকটিকাল ল্যাবে করতে পারলাম না, তার ডিফারেন্স চার্ট বানাব থিওরি ক্লাসে বসে?
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *