বেনিয়াসহকথা – ৬

আজকে নারী দিবস ছিল বলে স্টাফরুমের কিছু নারী স্টাফ ‘অফ ডে’ নেবার তালে ছিল। পড়াতে না হলে মোটামুটি সবাইই বেঁচে যায়, অ্যান্ড আই প্রুভ দ্য রুল। – আমার ‘নন অ্যালাইনমেন্ট’ পড়ানোর কথা ফোর্থ পিরিয়ডে, থার্ড পিরিয়ড নাগাদ এক ম্যাম বললেন – ‘মানস স্যার উইল ইউ টেক দ্য ক্লাস ইন নাইন এ? ইট ইজ গোয়িঙ অন রাইট নাও।’ আমি বসে বসে আজ কোন গানগুলো শোনাবো ভাবছিলাম, এই প্রশ্ন শুনে লাফিয়ে উঠে বললাম – ‘সেনডুবে, বেশ্টিমট, ডেফিনিটলি, অ্যাবসোল্যুমঁঅ, অবশ্যই, জরুর’ – বলে পা চালিয়ে দিলাম। পিরিয়ডটার মাত্র পনেরো মিনিট বাকি আছে।

আমার আজকের প্লেলিস্টে একটা গান থাকবে কাল থেকেই ভাবা ছিল – কৌশিক গাঙ্গুলীর ছবিতে অরিজিৎ সিং-এর গাওয়া গান, ‘অপুর পায়ের ছাপ’। কাল আমি স্কুল থেকে ফেরার আগে তাই ওদের ক্লাসের হোয়াইট বোর্ডটায় একটা কাশক্ষেত আর রেলগাড়ির ছবি এঁকে এসেছিলাম। ততক্ষণে স্কুল ফাঁকা, কেউ জানে না আমি এইসব করেছি। আজকে ওদের ক্লাসে ঢুকে সবাইকে চুপ করিয়ে বসাচ্ছি – দু’তিনজন চার্জ করে বসল, স্যার বোর্ডের যে ছবিটা ছিল ওটা আপনি এঁকেছিলেন? আমি একটু ইয়ে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু করে লাভ নেই, একটু পরেই সব টের পাবে, – তাই সারেন্ডার করে দিলাম।

আগের দিন ‘বর্ন টু রান’-টা ওরা বিশেষ ফলো করতে পারেনি বলল। স্বাভাবিক, প্রথমবার ওই ভয়ানক এনার্জি আর ওরকম মার্কামারা ঘ্যাসঘেসে গলা – কিছু না বুঝতে পারারই কথা। আমি ইচ্ছে করেই ওটা খাইয়েছিলাম, এস্পেশালি ভিডিওটার জন্য। আজকে প্রথমে চালালাম জনি ক্যাশের ‘হার্ট’। গানের কয়েকটা লাইন আগে বোর্ডে লিখে দিলাম, একবার পড়ে নেয়ার জন্য। কেউ কেউ জানে, এখন – এই মুহূর্তে – এই গানটার একটা আলাদা মাত্রা আছে। কয়েকদিন আগে একটা ফিল্ম রিলিজ করেছে, তার সাথে গানটা খুব খুব একাত্মভাবে জড়িয়ে আছে এখন। – ভিডিও আরম্ভ হলে ওরাও কয়েকজন ঠিক চিনতে পারল। – শেষ হবার পরে লেকচারের মধ্যে একবার দু’লাইনে লোগানকে ছুঁয়ে গেলাম।

এরপর কে’নানের ‘ওয়েভিং ফ্ল্যাগ’, আসলটা। এটা শোনাতে শোনাতে খেয়াল হল, – এদেরকে মায়ার ‘কেজেড বার্ড’ শোনাতে হবে একদিন। আমার একটাই ইয়ে, ক্লাসের মধ্যে লেকচার দিতে দিতে চোখ ভিজে যায়। – কিন্তু এখন যুগ বদলে গেছে। এখনকার ‘প্রফেশনাল’ ছাত্ররা যদি মাঝেমাঝে ইতিহাস-কথন-রত টীচারের চোখে জল দেখে, সেটা মনে হয় ওদের জন্যে ভালোই। ইন এনি কেস আমি তো আর ওদের থেকে কিছু লুকাই না।

‘ওয়েভিং ফ্ল্যাগ’ শেষ হল। আমি বললাম, ‘তোরা সত্যজিৎ রায়ের নাম জানিস। সত্যজিৎ রায় একটা বাংলা উপন্যাসের ওপর একটা ছবি বানিয়েছিলেন। বানাতে বানাতে পয়সা শেষ হয়ে গেছিল, – তখনকার বম্বের একজন বড় শিল্পী নিজের পকেট থেকে পয়সা বার করে সিনেমা শেষ করার জন্য সত্যজিৎকে দিয়েছিলেন। বম্বের সেই শিল্পীর নাম ছিল কিশোর কুমার।’

‘সিনেমাটায় একটা ছোট্ট ছেলে ছিল, তার নাম ছিল অপু।’

অল্প করেই বললাম যেটুকু না বললে নয়। ভিডিওটা ধরতে পারবে না নাহলে। তারপর চালালাম।
… ক্লাসরুমের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তেইশটা নিস্তব্ধ মুখ এক বুক গান নিয়ে অপু দেখছে।

—- তার পরে আরো মিনিট বিশেক সময় পড়ে। কী করি? – লাকি আলির ‘আনজানি রাহোঁ মে’ এমনিতেও শোনাতাম, – সেটাই বাছলাম। অসাধারণ গান, – কিন্তু শেষ হবার পরে একজন বলল ‘স্যার আগেরটা বেশী সুন্দর ছিল।’ — আমি মুখে বললাম – ‘গানের ওরকম বেশী-কম মাপা যায় না।’

কিন্তু এখনো দশ মিনিট বাকি!

এরা আর যাই শুনুক জিন্দেগীতে কোনোদিন আফ্রিকার কোনো ভাষা শোনেনি, তাই ‘মালাইকা’-টা ভাবছিলাম কাল শোনাব। কিন্তু… সময় যখন আছে… হোয়াই নট?

এটার সাবটাইটেল ছিল না, কিন্তু তাতে কিছু এসে গেল না দেখলাম। যাওয়ার কথাও না, গুপী গাইনের প্রথম গীতিসূত্র অনুসারে এ ভাষা এমন কথা বলে বোঝে রে সকলে উঁচা নিচা ছোট বড় সমান – কোথাও আটকায় না।

কালকে ফার্স্ট পিরিয়ড আছে। দেখি ল্যাটিন সাম আর ভাটিয়ালি কেমন জমে।

~

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *