আমার ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই ক্লাস টেনের ফেয়ারওয়েল ছিল। এদের নিয়ম, – ক্লাস নাইনের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস টেনকে ফেয়ারওয়েল দেবে। সেদিনকার অনুষ্ঠানে আমার এক ছাত্রী (নাইনের; এই টেনকে আমি কোনোদিন কিছু পড়াইনি) ওর নিজের লেখা শায়েরী পড়েছিল। নাম জানতাম না তখন, কিন্তু চিনে রেখেছিলাম।
এদের সিলেবাসে ভারতের ইতিহাসও আছে। কিন্তু আমি যখন ঢুকেছি ততদিনে সেসব পড়া হয়ে গেছে। সিপাহী বিদ্রোহ, কংগ্রেস, বঙ্গভঙ্গ, গান্ধী, নেতাজী। সব একটু একটু করে ছোঁয়া। কী পড়েছে কী জেনেছে জানি না।
আমি চাইছিলাম একদিন একটা ফাঁকা ক্লাস পেতে। একটা জিনিস ওদেরকে শোনানোর ছিল। আমার নিজের দ্বারা হবে না বলে প্ল্যানও করে রেখেছিলাম – সেদিনকার সেই শায়রকে ধরব। ক্লাসের সামনে একটা উর্দু কবিতা পড়ে শোনাতে হবে ওকে।
কবিতার আসল উর্দু চেহারা ছাড়াও ট্রান্সলিটারেশন পেয়েছিলাম দেবনাগরী আর রোমানে। আমার উর্দু নীল, হিন্দী লাল, আর রোমানে এইসব ভাষা টুকলে ঠিক উচ্চারণের কোনো হদিস থাকে না। তাই, পড়ার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিলে চলবে না জানতাম। হিন্দী-উর্দু কবিতার সাথে মোটামুটি পরিচিত কাউকে চাই।
একদিন সকালে উপরওয়ালার খাতা এসে হাজির – অমুক পিরিয়ড প্রক্সি নিতে হবে, ক্লাস নাইন এ। আমি মনের আনন্দে সই করে দিলাম। তারপর স্টাফরুমের একটা কম্পিউটার খুলে ক্রোমে কবিতাটা বার করে খাতায় টুকে রাখলাম। এই খাতাটা আমার সঙ্গেই ক্লাসে যায়।
যথাসময়ে ক্লাসে গিয়ে দেখি, সেদিন সেই ছাত্রীটি অনুপস্থিত। – জিজ্ঞেস করলাম, – তোরা কে ভালো হিন্দী পড়তে পারবি বল। হিন্দী না, উর্দু, কিন্তু আমার কাছে ইংরেজীতে বয়ান লেখা আছে, হিন্দী কবিতা-গান জানা থাকলে খুব অসুবিধে হবে না।
দু’জন মেয়ে হাত তুলল।
প্রথমজনকে ডেকে বললাম, – আগে একবার নিজে রিডিং পড়ে নে। তারপর ক্লাসকে পড়ে শোনা।
কয়েকবার অাটকাল, কিন্তু পড়ল। তারপর দু’নম্বরকে ডেকে বললাম, – এবার তুই শোনা।
কবিতাটা নীচে দিলাম। আমি বাংলায় ট্রান্সলিটারেট করছি, কিন্তু অনেক গলদ থাকবে এতে। যে জানে সে শুধরে দেবে কমেন্টে।
“লগতা নহীঁ হ্যায় জী মেরা উজাড়ে দয়ার মেঁ
কিসকী বনী হ্যায় আলম-এ-নাপায়েদার মেঁ
বুলবুল কো পাসবাঁ সে না সৈয়াদ সে গিলা
কিসমৎ মেঁ কয়েদ লিখী থী ফসল-এ-বাহার মেঁ
কহ দো ইন হসরতোঁ সে কহীঁ আউর যা বসেঁ
ইতনী জগেহ কঁহা হ্যায় দিল-এ-দাগদার মেঁ
ইক শাখ-এ-গুল পে বৈঠ কে বুলবুল হ্যায় শাদমাঁ
কাঁটে বিছা দিয়ে হ্যাঁয় দিল-এ-লালাজার মেঁ
উমর-এ-দরাজ মাঙ্গকে লায়ে থে চার দিন
দো আরজু মেঁ কট গয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ
দিন জিন্দগী কে খতম হুয়ে শাম হো গয়ি
ফৈলা কে পাঁও সোয়েঁঙ্গে কুঁজ-এ-মজার মেঁ
কিৎনা হ্যায় বদনসীব ‘জফর’ দফ্ন কে লিয়ে
দো গজ জমীন ভী না মিলী কু-এ-ইয়ার মেঁ ”
এই কবিতাটা পড়লেই আমার একটা ইয়ে পায়। তাইজন্যে আমি আগে থাকতেই, যখন কবিতাটা খাতায় টুকছিলাম তখনই, ওই ইয়েটা একটু ‘মোক্ষণ’ করে নিয়েছিলাম। তাই এখন শো-এর মধ্যিখানে কোনো অসুবিধা হল না। কবিতা পড়া শেষ হলে ওদের জিজ্ঞেস করলাম, – কার লেখা জানিস?
ওরা জানত না। আমি বললাম – লাস্ট স্তবকটা আরেকবার পড়ে শোনা। – শোনাল। জিজ্ঞেস করলাম, – এই জাফর কে, জানিস?
এই কবিতার কবি বাহাদুর শাহ জাফর। যার নাম ইতিহাস বইয়ে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ বলে লেখা থাকে। মুঘল বংশের শেষ সম্রাট বলে যাকে সব স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীরা একডাকে চেনে। দু্র্বল ছিল, হেরে গেছিল, মায়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মরে গেছিল। সবাই জানে।
ওদের বললাম, – দ্যাখ, লোকটা কোনোদিনও রাজা হতে চায়নি। লোকটা আসলে কবি ছিল। আর কিছুই না। রাজার ঘরে জন্মে গিয়েছিল, তাই রাজা করে দেওয়া হয়েছিল।… তোরা তো জানিস, আমি আসলে ইংরেজীর ছাত্র। আমি যখন গ্র্যাজুয়েশনের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, আমাদের একটা নাটক পাঠ্য ছিল। ‘এডওয়ার্ড দ্য সেকেণ্ড’। ক্রিস্টোফার মার্লো বলে একজনের লেখা। এই মার্লো শেক্সপীয়ারের সময়কার লোক ছিলেন, দারুণ ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার ছিলেন। কিন্তু সেসব এখন থাক। এই যে নাটকটা আমাদের ছিল, এতে ছিল রাজা এডওয়ার্ড দ্য সেকেণ্ডের কথা। এও রাজা হতে চায়নি। রাজা হবার মতো যোগ্যতাও ছিল না। কিন্তু রাজার ছেলে ছিল, তাই রাজা হতে হয়েছিল; রাজা না হয়ে কোনো উপায় ছিল না।
জাফরও তো রাজা হতে চাননি। ট্র্যাজেডি অফ কিংশিপ তাঁকে রাজা করল। রাজা সাজিয়ে সবকিছু কেড়ে নিল। কতটুকু চেয়েছিলেন? একটা জীবন চেয়েছিলেন, একটুখানি ফুরসৎ। প্রিয় দেশের মাটিতে দু’গজ জমি। কিছুই পেলেন না। ইংরেজের মনে হল আরো ক্ষমতা দরকার, তারা নিয়ম করল বাদশা আর লাল কিল্লায় থাকতে পাবেন না, অন্য জায়গায় সরে যেতে হবে। দেশের মানুষ চটে লাল হয়ে গেল। বাদশার কী মনে হল কেউ জানল না। ইংরেজ রেললাইন পাতল, টেলিগ্রাফ টাঙাল, সতীদাহ তুলে দিল, অজুহাতের পর অজুহাত দিয়ে রাজ্যের পর রাজ্য দখল করে নিল। দেশের মানুষ যুদ্ধ করল, বিদ্রোহ করল। সবাই মিলে চীৎকার করে বাদশাকে তামাম হিন্দুস্তানের মালিক ঘোষণা করে দিয়ে নেতা বলে মাথায় তুলে নিল। গুলি-গোলা-তরোয়াল-কামানের গোলমালের মধ্যে জাফরের গলা কেউ শুনতে পেল না।
কিছু শোনবার ছিল কি?
তোরা তো এখনকার মানুষ, আধুনিক যুগের। তোরা জানিস, সব মানুষ সমান হয় না। আমি ভালো খেলোয়াড়, কিন্তু আমি ভালো ডিজাইনার না-ই হতে পারি। তুই ভালো অঙ্ক করিস, তুই ইংরেজীতে ভালো না-ই হতে পারিস। আমরা সবাইই তো মাত্র অল্প কয়েকটা জিনিসে ভালো, বাকি সবকিছুতে দুর্বল। তোরা জানিস, ডাক্তারের মেয়ে হলেই ডাক্তারী পড়তে হবে এমন কোনো কথা হয় না। ইঞ্জিনীয়ারের ছেলে হলেই ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ যেতে হবে এমন চাপ দেওয়া যায় না। তোরা আমাকে বলতে পারিস, রাজার ছেলে হলেই কেন তাকে রাজা হতে হবে?
একজন মানুষ, যিনি কবিতা ভালোবাসতেন, তাঁকে ইতিহাস কেন মুঘল বংশের শেষ সম্রাট হিসেবেই মনে রাখবে? কেন তোরা তাঁকে কবি হিসেবে চিনবি না?
…….
… এদের ক্লাস টেনের সিলেবাসে যা আছে, তার অনেকটাই নাইনেই আগেভাগে পড়া হয়ে গেছে। পরের বছর যদি এদের পড়ানোর সুযোগ পাই তাহলে সিলেবাস শেষ করার চাপ ততটা হয়তো থাকবে না। দেখি।
~