– এই যে দাদা!

– আরে তুই! ইদিক আয়, নীচে কাণ্ডখানা একবার দ্যাখ। চুরুট খাবি?

– আমি ওসব আজেবাজে জিনিস খাই না। ভালো পোলাও মাংস রা-

– (সহাস্যে) হবে, হবে! রাখাল বাজার গেছে, আজ ভারী ভোজ লাগাব। দেখব কত খেতে পারিস!

– আচ্ছা? কাম অন, কাম অন। – কিন্তু এসব কী লাগিয়েছে দাদা? সার্কাস নাকি? তাঁবু-মাবু তুলে একাকার তো!

– ওই তো মজা। শুধু দেখে যা। এরপর কেত্তন শুরু হবে।

– এই ইডিয়েটগুলো কোনোকালে শোধরাবে না। দেখে পিত্তি জ্বলে যায়। ওদিকে দেখেছ? – টিভিতে তোমার কথা বলছে।

– জানি। বচ্ছরভোর মিটমিটে শয়তানি আর মাইক পেলে মিঠি মিঠি বাত। দেখতে দেখতে দিকদারি ধরে গেল! মাঝেমাঝে নিজেকে স্রেফ একটা গাড়ল মনে হয়, জানিস টেনি!

– যাক, চোখ ফুটছে তাহলে।

– তা আর বলতে। উজবুকগুলোকে দ্যাখ একবার? ভক্তি আর ধরে না, একবারে ঝরে ঝরে পড়ছে! এবার শুরু করবে চন্দন আর ফুলবেলপাতা দিয়ে ন্যাকামি। পইপই করে এগুলো করতে বারণ করেছিলাম।

– এসব মডার্ন পলিসি দাদা, তোমার ওই রুলবুক মেনে চলতে গেলে আর এদের স্মার্টফোন কেনা হত না। আর শুধু এদের বলে কী হবে – খুব তো বড় মুখ করে বলে এসেছিলে – ‘I am a voice without a form’!

– ছোঃ। কোথায় ভয়েস… কোথায় ঘোড়াড্ডিমের কী! – ভয়েস! – ঠাকুরঘরে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে ফোটোতে ছাতা ধরিয়ে দিলে, তারা শুনবে ভয়েস। – মুখে ফেনা তুলে তো দিস্তা দিস্তা লেকচার দিয়ে এলাম, – তা ছাপিয়ে তো দিব্যি বিক্কিরি চলছে। তা কাজের বেলায় লবডঙ্কা কেন?

– বিক্রি তো রবীন্দ্ররচনাবলীরও চলছে!

– তা চলছে। তাও ওর বেলা শুধু চন্দনে ক্ষ্যান্ত দিয়েছে, ঘাসপাতা ছোঁড়া এখনো আরম্ভ করেনি। আচ্ছা সে কোথায় বল তো, পাত্তা নেই ক’দিন ধরে?

– রবিদা ভেকেশনে গেছে। বন্দাকুশ রেঞ্জে একমাসের প্রোগ্রাম।

– কী!!! পাহাড়ে গেছে! – আর আমাকে জানালে না যে? ও ব্যাটা পাহাড়ের বোঝেটা কী? তায় আবার বন্দাকুশ – হরি হরি!

– ছিঃ বিলুদা। গুর্দেব শুনলে কী বলবেন? ‘এই তো এত পায়ে চড়ছিস!’

– গুর্দেবের কথা বাদ দে। বিটলে বামুন, বড়বড় লেকচার দিয়ে আমার ঘাড়ে বন্দুক চাপিয়ে কেটে পড়ল। সে পড়ুক ক্ষতি নেই, তা বলে এরকম তামাশা? সেদিন দেখি এক বিশাল হাসপাতাল গেড়ে বসে চুটিয়ে ব্যবসা করছে – তার ওপর বড়বড় করে লেখা ‘বি-বে-কা-ন-ন্দ হা-স-পা-তা-ল’! আরে ইয়ার্কি নাকি?

– কারোরই হাল ভালো না, বুঝলে। আমি তো নীচে যাওয়া অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি। কাল জয়ন্তরা এসেছিল, ওরাও পুরো দলটা দু’হাজারতেরোয় ‘চাঁদের পাহাড়’ সিনেমা বেরোনোর পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এসেছে।

– বেশ করেছে। শঙ্করকে বলিস, দুঃখু না করতে। ওর যা দুরবস্থা হয়েছে, সে জিনিস ওরও আগে আমার হয়েছিল। ওই বছরই।

– যুবসমাজের এতবড় আইকন তুমি সেজেছিল, তাকে তুমি দুরবস্থা বলছ! তোমার এক্সপেকটেশন লেভেলেরও বলিহারি, দাদা।

– আর কোনো এক্সপেকটেশন নেই রে টেনি। তবে এদের একটু ধাতানি দেওয়া দরকার। হাড় জ্বালিয়ে খেল। এত মিথ্যাচার, এত মিথ্যাচার। একেবারে নির্লজ্জ স্বার্থপরতা!

– একটা সত্যি কথা বলো তো দাদা। দেখছ তো সব। আশা রাখো এখনও?

– দ্যাখ, একটা ফাইনাইট ন্যাচারাল প্রসেস অনন্তকাল ধরে একইরকম সফলভাবে চলতে থাকবে, এমনটা আশা করা পাগলের কর্ম। মানুষ আর পাঁচটা জীবের থেকে এবিষয়ে কোনো অংশে আলাদা নয়। অ্যাজ আ স্পিসিজ, সে লোপ পেতে বাধ্য। সেদিক থেকে দেখলে আশা রাখা কথাটার কোনো মানে নেই। একটা অবনমন আসবে, এবং গল্প শেষ হবেই। – কিন্তু অস্তিত্বের জন্যে সংগ্রামও তো একটা জৈবিক ক্রিয়া! সেই লড়াইটা দেবার রক্তের জোর এতটা কমে গেছে, এটা দেখেই খারাপ লাগে। লোকে সাহস ধরার আগেই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে! সারা দুনিয়ায় অন্যায়-অবিচার তো আমাদের সময়েও ছিল, – রোজগারের চিন্তা, বাড়িতে অভুক্ত পরিবার, মাথায় হাজারো চাপ, এদের গালভরা ভাষায় যাকে বলে ‘একজিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস’ – সেসব কী আর আমার ছিল না, আমার বাপদাদাদের কারও ছিল না? – তাও আদর্শকে জোর করে ধরে রাখার সাহসটা তো আমি দেখিয়েছিলাম। কোনোরকম ‘সিকিওরিটি’ বা ‘মামার জোর’ ছাড়াই চান্স তো নিয়েছিলাম! – আর আবার যদি আমাকে জন্মাতে হয়, আমি আবার সেই চান্স নেব। সে যুগ পাল্টাক আর যাই হোক। যুগের আমি থোড়াই কেয়ার করি।
বিজ্ঞান-বিজ্ঞান করে এত লাফালাফি – তা বাপু পৃথিবীশুদ্ধু বিজ্ঞানীরা যে কথা বলে বলে হয়রান হয়ে গেলেন, তা শুনতে কি পাও না? এখনও অন্যের ঘাড়ে পা দিয়ে নিজের ঝোলা ভরানো ছাড়া আর কিছু শেখা গেল না?

– বাদ দাও তো। খিদে-খিদে পাচ্ছে।

– ধ্যাত্তোর খিদে! ওই যে নীচে চালকলামাখা পেসাদ দিচ্ছে খাবিগে যা!

– কাম ডাউন, ব্রাদার। আরে ওই তো আইসক্রিম যাচ্ছে! – এই, আইসক্রিম!!!! …… দুটো বার দাও তো, – ম্যাঙ্গো আছে? – একটা ম্যাঙ্গো আর একটা ভ্যানিলা দাও। না না পলিপ্যাক লাগবে না – খাব। হ্যাঁ। – এই নাও, – নাঃ ফেরত লাগবে না, এই দাদা ট্রিট দিচ্ছেন সবাইকে। হ্যাঁ এসো!

– আমি ট্রিট দিচ্ছি, না?

– দিচ্ছ না? তোমার সেই অমর লাইন – জীবে প্রেম করে যেই জন… আহা! নাও ধর। এই ম্যাঙ্গোটা দুর্দান্ত।

– হুঁ। একটা প্লেট হলে ভালো হত। এই কাগজের বাক্স খেতে খেতে কেমন নেতিয়ে যায়, – তখন আইসক্র‌িম সামলাবো, না খাবো। – হুম। ভালো তো!! এটা নতুন বেরিয়েছে, নারে?

– হুঁ। হ্যাপি বার্থডে!

**********************************

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *