আমি এখন ঋষিকোণ্ডা বিচে বালির উপর বসে আছি। দূরে সার সার নৌকা দাঁড়িয়ে আছে, জেলেরা বাঁশ পুঁতে মাছধরার জাল বুনছে, কতকগুলো ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা এই ভরবিকেলেও ঢেউয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। আরো দূরে বেশকিছু ট্যুরিস্ট দেখা যাচ্ছে, ছোট্ট ছোট্ট নারকেলের দোকান, চায়ের গুমটি। বালির উপর দিয়ে ঘোড়া হাঁটছে, হকাররা মুক্তো দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, কেনার জন্য ঝুলোঝুলি করছে। গুটিকয়েক ক্যামেরাম্যান, তারা হাঁটু অবধি প্যান্ট গুটিয়ে জলে নেমে নানারকমভাবে ছবি তুলছে। একদম শেষমাথায় সমুদ্র যেখানে আকাশের সঙ্গে মিশেছে, সেখানের রংটা সিঁদুরগোলা লাল হয়ে আছে। মাঝআকাশে ছোট্ট একটা তারা জ্বলজ্বল করছে।
কাল সারারাত গুল গাড়ি চালিয়েছে। আমরা যখন কোনোমতে বেরোই, তখন বাজে প্রায় সাড়ে তিনটে। লাশগুলো পরপর শোয়ানো ছিল আমাদের কটেজের সামনে। বেরোনোর সময় আমরা ওগুলোর দিকে ফিরেও দেখিনি। কলকাতায় একবার ফোন করেছিলাম, ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল, তারপর গুল আমার ফোনটা নিয়ে কাকে যেন একটা ফোন করল, কিছুক্ষণ দুর্বোধ্য তেলুগুতে কিসব কথাবার্তা বলল, তারপর ফোনটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ বড় করে হাসল। ‘সুব্বারাওকে বলে দিলাম আমরা দারিংবাড়ি থেকে বেরিয়েছি। ওরা বিশাখাপত্তনমে আমাদের জন্য ওয়েট করবে।’
আমি কিছু না বলে গুলের গালে ছোট্ট একটা চুমু খেলাম, তারপর কোনোমতে পিছনের সিটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।
দুপুরে গুল যখন আমার ঘুম ভাঙাল, তখন বাজে প্রায় একটা। ঘুম ভেঙে যাকে বলে হকচকিয়ে গেছিলাম আমি। চারপাশে পাথরের দেওয়াল, পাথরের মেঝে, ইয়া উঁচু সিলিং থেকে লম্বা লম্বা দুটো টিউবলাইট ঝুলছে। আমার কানে সমুদ্রের আওয়াজ আসছিল। কোনোমতে টলতে টলতে আমি খাট থেকে নামলাম। গুল আমাকে ধরে ধরে সামনের ছোট্ট ঝুলবারান্দায় নিয়ে এল। এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার ঘুম উড়ে গেল। সামনেই সমুদ্র।
এই দুর্গটা এককালে পর্তুগিজদের ছিল। লোকে বলে আলবুর্কাক নিজে নাকি দুর্গটা বানিয়েছিলেন থাকবেন বলে, তারপরে নানা কারণে আর থাকা হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত হয়ে পড়েছিল দুর্গটা, বছরদশেক আগে সুব্বারাও, গ্রামশিস্তাদের তেলেঙ্গানা ইউনিটের কমানদান্তের বাবা এটা সরকারের কাছ থেকে কিনে নেন। স্যাফ্রনিস্টরা এখানে সরকারে নেই, যারা সরকারে, তাদের সঙ্গেও স্যাফ্রনিস্টদের মোটামুটি আদায়-কাঁচকলায়, অতএব গ্রামশিস্তা-স্পার্টাকানরা এখানে মোটামুটি নির্বিবাদেই কাজকর্ম করতে পারে। এই দুর্গটা গ্রামশিস্তাদের প্রধান ঘাঁটি, এবং আমার আর গুলের এইমুহূর্তের আস্তানা, মানে যতদিন না কাউন্সিল থেকে পরের কোনো নির্দেশ পাচ্ছি।
গুলই আমাকে ভাল করে স্নান করিয়ে দিল, চুল আঁচড়ে দিল, তারপর আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে কলকাতার গল্প বলল। কাল রাতে আমরা যখন ফোন করেছিলাম, তার আগেই লড়াই শেষ হয়ে গেছে। যে পঞ্চাশজন কাল সাড়ে দশটা অবধিও লড়ে যাচ্ছিল, তারা সবাই মোটামুটি মারা গেছে, বেঁচে গেছে শুধু রফি আর লিজা। খুব সম্ভবত ওরা কোথাও লুকিয়ে আছে। আমার সঙ্গে যখন ঈশানের কথা হয়, তার ঠিক পরেই ছেলেটা এলএমজি-র গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, আর্শাদ, অপুও। স্পার্টাকানদের প্রত্যেকটা অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, হালালদের উপাসনামন্দিরেরও একই অবস্থা। যে ক’জন স্পার্টাকান নেতাকে হাতের সামনে পেয়েছে স্যাফ্রনিস্ট আর পুলিশ, সবাইকে ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়েছে। আজিদ বা আর মালবিকাদি ধরা পড়েছিল, আজিদ বা-র দাঁতমুখ ফাটিয়ে, হাতপায়ের সব নখ উপড়ে মেডিকেল কলেজের সামনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, মালবিকাদিকে গণধর্ষণ করেছে স্যাফ্রনিস্ট আর আর্মি, তারপর জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে। গুল চোখের কোনায় জমা একফোঁটা জল মুছে বলল, ‘কলকাতায় আর ইন্টারন্যাশনাল গাওয়ার লোক রইল না শানু।’
গুল এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের জলে পা ভেজাচ্ছে। ওর ফর্সা পায়ের গোছ দেখা যাচ্ছে; সমুদ্রের জল এসে ওর পা ভিজিয়ে দিচ্ছে, কয়েকটা ঝিনুক ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, আর আরো চকচক করছে গুলের পাদুটো, এমনকি, ওর সাইবারনেটিক আর্মের থেকেও বেশি। হাওয়ায় গুলের বাদামি চুল উড়ছে, লুটোপুটি ওর মুখ জুড়ে, কাঁধ জুড়ে। এই সময় গুলকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে, এমনকি শুধু আমাদের নিজেদের সময়ের থেকেও বেশি সুন্দর। আমি গলা তুলে ওকে ডাকলাম।
‘গুল!’
গুল আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল, তারপর জল ভেঙে এসে আমার পাশে বসল।
‘বল।’
‘ক্যাসেটদুটো কই?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘যথাস্থানে,’ হাসল গুল, ‘সুব্বারাওকে দিয়ে দিয়েছি। রাতে সিন্ধু আসবে, কোড ব্রেকার, দেখি ও কি বের করতে পারে!’
আমি গুলের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে রইলাম। সূর্য বেশ কিছুক্ষণ হল ডুবে গেছে, সমুদ্রের জলে লাল ভাবটাও আর নেই। একটা দুটো করে টুপটাপ আলো জ্বলে উঠছে চারপাশে। আকাশের রং এখন কালচে নীল।
গুল দেখি হঠাৎ করে পকেট হাতড়ে একটা কাগজ বের করল। আমি অবাক হয়ে গুলের দিকে তাকালাম। ‘আজিদ বা-র চিঠি,’ গুল ছোট্ট হেসে বলল, ‘ক্যাসেটের খাপের মধ্যে ছিল, সুব্বারাও পেয়ে আমাকে দিয়েছে। ভুলে গেছিলাম প্রায়, হঠাৎই মনে পড়ে গেল।’
‘চিঠিটা পড়।’ আমি বললাম।
গুল চিঠির ভাঁজ খুলল। উপরে আমাদের গ্রামশিস্তাদের চিহ্ন, মুঠোবদ্ধ হাত একটা গোলাপ ধরে রেখেছে, তার নিচ থেকে আজিদ বা-র মুক্তোর মত হাতের লেখা শুরু হচ্ছে।
‘গুল,
এটা চিঠি লেখার সময় নয়, তবুও তোকে লিখছি, কারণ সব কথা বলার আর সময় হয়তো নেই; হয়তো কি, সত্যিই নেই। আমি বেশি কথা বলতে পারি না, আবেগ-টাবেগ আমার আসেও না। তোরা ক্লাসে ঠিকই বলতি, সাহিত্যের প্রফেসর না হয়ে আমার অঙ্ক করা উচিত ছিল। সে অঙ্কও আজ করে ফেলেছি। কলেজ স্ট্রীটে পজিশনাল ওয়ারের জন্য এর চেয়ে ভাল বেস মারিঘেল্লা কি, স্বয়ং দেলেক্লুজ বা জুকভ এলেও সাজাতে পারতেন না। কিন্তু একটাই আফসোস থেকে গেল, তোদের আর প্রমিথিউস আনবাউন্ড পড়ানো হল না। ত্রিসংসারে আমার নিজের কেউ নেই। তুই আমার মেয়ের মত ছিলি, তাই যা আবদার তোর কাছেই করতে পারি। পড়ার অভ্যেসটা ছাড়িসনা, বেসটা বাজিয়ে যাস। একজন ভাল প্রফেসর বা মিউজিশিয়ান— তুই যেটা চাস, সেটাই হতে পারিস, খালি একটু মন দিস। সাহানাকে আগলে রাখবি সবসময়। মেয়েটা তোকে ছাড়া আর কিচ্ছু চেনে না। ওর সঙ্গে একদম রাগারাগি করবি না। আর ধৈর্য ধরতে শেখ। সামনের রাস্তা বড্ড কঠিন, কিন্তু যে ধৈর্য ধরে থাকবে, সে-ই জিতবে। নাৎসীরা পারেনি, স্যাফ্রনিস্টরাও পারবে না। হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিম্প্রে।
পুনশ্চ, একবার রবি ঠাকুরকে মনে না করলে বাবা-মেয়ের সম্পর্কটা পূর্ণতা পায় না বলেই আমার বিশ্বাস। তাই শেষটা হোক রবি ঠাকুরেই—
‘তোমারে যা দিয়েছিনু
সে তোমারই দান
গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়
হে বন্ধু, বিদায়।’
চিঠিটা শেষ করে গুল আমার দিকে তাকাল। আমি গুলের দিকে তাকালাম। আমাদের দু’জনের চোখেই জল, তবু আমরা হাসছি, দু’জনেই।
সমুদ্র থেকে সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে। একটা রুপোর থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে। সেই চাঁদের আলো আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেই চাঁদের আলোয় ভিজে আমি গুলকে চুমু খেলাম। গুল আমাকে চুমু খেল। একটা আকাশিরঙা পাখি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।
বিপ্লব যে কখন, কিভাবে, কোথায় শুরু হবে— কেউ বলতে পারে না; তবুও সেই ছেলেটা আসে। তাকে আসতেই হয়।