– কী করছিস?
– কে? – অ আপনি। আসুন, এদিকটায় বসুন।
– করছিসটা কী?- নেটফ্লিক্স দেখছিলাম। আপনি বোধহয় নেটফ্লিক্স জানেন না –
– কেন জানব না? দু’হাজার কুড়ি সালের বাতাসে কথা বলতে পারি, দু’হাজার কুড়ি সালের আলোয় চোখে দেখতে পারি, আর দু’হাজার কুড়ি সালের স্ট্রীমিং সার্ভিস ব্যবহার করতে পারব না? – কোন্দেশী যুক্তি নিয়ে চলিস বুঝি না।
– বাতাসে কথা বলতে পারি মানে?
– বায়ুমাধ্যমটা না থাকলে কথা বলতিস কী করে, গাধা!
– অ।
– নেটফ্লিক্সে কী দেখছিস?
– আপনি নেটফ্লিক্স দেখেন?
– মাঝে সাঝে। যদিও আমাদের ‘মাঝে সাঝে’ বলে কিছু হয় না। অফুরন্ত সময় যেহেতু, সেহেতু তার কোনো ল্যাজা-মুড়ো নেই।
– আপনাদের কারবারই আলাদা। দাঁড়ান একটু। চা খাবেন?
– চিনি দিবি না। ঘরে মুড়ি আছে?
– আছে, দিচ্ছি।
– তারপর বলুন। হঠাৎ হাজির হলেন যে?
– হঠাৎ আর কী। একে বলে আত্মনির্যাতন। বহুদিন আসিনি তো, তাই চারদিকে একটু ঘুরে দেখতে এসেছিলাম, মানুষজন কী করছে, সবার কেমন অবস্থা। – তা আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই কেন যে বহুকাল এদিক মাড়াইনি সেটা আবার পরিষ্কার মনে পড়ে গেল।
– হুঁ। আপনার কপালে ওইই আছে। আমারও একই অবস্থা, তবে ওই আর কী, মাইক্রো স্কেলে।
– জানি সে কথা। এসব নেশা হয়ে যায়, বুঝলি? কাল যে কথাটা শুনলি সেটা একশো ভাগ সত্যি: ‘Scientific thinking is not natural thinking; religious thinking is natural thinking.’ – সব মানুষ ঠিক নিজের নিজের আফিম বেছে নেয়, তারপর সেই নিয়ে বাঁচে, আর সেই নিয়েই মরে।
– আপনি কি সর্বজ্ঞ নাকি?
– কেন?
– কাল আমি কী শুনছিলাম সেটা আপনি জানলেন কী করে?
– ওঃ, দূর! হা হা হা! ও তো কাল ফ্রেডের কাছে শুনলাম। – সর্বজ্ঞ-টর্বজ্ঞ অতি ফালতু জিনিস। ফাউস্টকে চিনিস তো?
– হ্যাঁ, ওনার আবার কী হল?
– নাটকে লেখেনি ওর আসলে কী হয়েছিল। তোরা এখানে পড়িস ওর আত্মাকে শয়তানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নরকের আগুনে পোড়াবে বলে। আসলে ওসব কিছুই না। ফাউস্ট সময় থাকতে বোঝেনি – ওর চরম ইচ্ছাপূরণই ওর চরম শাস্তি।
– মানে?
– মানে ল্যাপলাস যা বলেছিল তাই, তার স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত। ভেবে দ্যাখ। যে মুহূর্তে ও সর্বজ্ঞ হয়ে পড়ল, – সত্যিই সর্বজ্ঞ – বিশ্বের এক বিন্দু তথ্য ওর অজানা নেই, এমন সর্বজ্ঞ – সেই মুহূর্তেই বাঁচার সমস্ত আনন্দ ওর কাছে ছাইপোড়া হয়ে গেল না?
– এই যা।
– ভেবে দ্যাখ ভালো করে। কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কী হয়েছে, কোথায় কী হবে, সব ও জানে। হাঁটতে বেরোলে পথে কী দেখবে ও জানে, ওর প্রতিটা পদক্ষেপ কোথায় পড়বে ও জানে। খেতে বসে প্রতিটা গ্রাসের স্বাদ, গন্ধ, অনুভূতি ও আগে থেকে জানে। ঘুমোতে যাবার আগে ও জানে কখন সেই ঘুম ভাঙবে, ঘুম ভেঙে উঠে ও জানে আবার রাত নেমে ঘুমোতে যাবার আগে সারাদিন ও কখন কীভাবে চলবে, থামবে, কাজ করবে, ক্লান্ত হবে। একটা বই পড়তে পারে না, একটা ছবি দেখতে পারে না, পৃথিবীতে কোনোকিছু ও আর প্রথমবারের মতো করতে পারে না। সারা দুনিয়ার সমস্তকিছু ওর কাছে একশো শতাংশ প্রেডিক্টেবল। ওর পুরো অস্তিত্বটা সারা জন্মের মতো ছিবড়ে হয়ে গেল, বুঝতে পারছিস? ওকে আর নরকে টেনে নেওয়ার দরকার কী?
– চাপ তো!
– অত্যন্ত চাপ। আর তুই সেই চাপ আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছিলিস।
– কিন্তু দাঁড়ান, এটা যা বললেন – জিনিসটা চেনা চেনা লাগছে। এই সর্বজ্ঞ হওয়ার অভিশাপের ব্যাপারটা।
– হুঁ। এই গোলমালে পড়েছিল জন অস্টারম্যান। মনে পড়ছে?
– …ইয়েস। কিন্তু দাঁড়ান, ওর বেলায় তো -?!!?
– হ্যাঁ, তুই যেটা ভাবছিস সেটা ঠিকই। ফাউস্ট ব্যাটা নিজে জার্মান, ব্যাটা বেঁচেও গেল আর এক জার্মানেরই কল্যাণে।
– বুঝলাম না। কোন জার্মান?
– হেঁঃ হেঁঃ, জার্মান কি আর একটা বাবু? তোমাদের এই বিশ শতকের আগে আমরা কেউ এসব বেরোবে বলে কল্পনাও করিনি। আর এখন দেখোগে যাও, ফাউস্টের পাত্তাটি কোথাও পাবে না, গত চল্লিশ বছর সে আকাশগঙ্গার এধার মাড়ায়নি, কেবল মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র পাই। তোফা আছে, এখনো অবধি বিরাশিটা ডায়রী অ্যালবার্টের কাছে এসে জমা হয়েছে, আরো কত আসবে তার ঠিক নেই।
– কোন অ্যালবার্ট? জার্মান অ্যালবার্ট?
– জার্মান অ্যালবার্টই বটে, যার অপর নাম আইনস্টাইন। তবে সেই জার্মানের কথা বলছিলাম না। ফাউস্টকে বাঁচাল তোদের হাইজেনবার্গ, আনসার্টেনটির তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে। সর্বজ্ঞ হবার যন্ত্রণা কাটাবার ওই এক ওষুধ। তারপর আশি সালে ব্যাটারা দল বেঁধে মহাকাশ দেখতে বেরোল, সেই যে গেল, আপাতত কয়েক হাজার বছরের মধ্যে ফিরবে বলে মনে হচ্ছে না।
– জমাটি ব্যাপারস্যাপার। আইনস্টাইন গেছে?
– উঁহু, তা নইলে আর বললাম কি? আইনস্টাইন কোনোকালেই গ্রুপে কাজ করার লোক ছিল না, সে অভ্যেস এখনো বদলায়নি। একাই থাকে, পোস্ট অফিসে একটা নাম-কা-ওয়াস্তে কাজ সামলায়। প্রচুর সময়, পাস্তা বানায়, বেহালা বাজায়, আর একা একা নিজের কাজ করে।
– ভালোই। আচ্ছা একটা কথা বলুন।
– কী কথা?
– পরলোকটা ইহলোকের চেয়ে অনেক ভালো, তাই না?
– …. এক কথায় উত্তর চাস যদি, তাহলে হ্যাঁ। কিন্তু তুই যেমন ভাবছিস তেমন নয়।
– কীরকম?
– ইহলোকের সমস্তরকম নোংরামি পরলোকেও আছে। কিন্তু স্পেসটাইমটা অসীম। দেশ-কালের কোনো সীমানা যেহেতু নেই, তাই যে যার নিজের মতো থাকতে পারে। তুই যদি নিজে থেকে ঝামেলায় না যাস, কেউ পায়ে পা লাগিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারবে না।
– আই সী।
– নে, এবার উঠি। তুই নেটফ্লিক্সে কী দেখছিলি দ্যাখ।
– সোজা ফিরবেন এখন?
– হ্যাঁ, আর কোথাও দাঁড়াব না। রাতে খিচুড়ি হবার কথা, নরেন বোধহয় সঙ্গে বকফুলভাজা করার তালে আছে। দেরী করলে সমূহ ক্ষতি।
– এই লেখাটা আমি ফেসবুকে পোস্ট করব?
– করে দে, তবে সঙ্গে একটা ক্যাপশনওয়ালা ছবি দিস।
– কী ক্যাপশন দেব?
– লিখে দিস ‘বিদ্যাসাগরের ভূত।’