বহুকাল আগে উপাধ্যায়দাকে দেখেছিলাম, একটা বেঁটেমতো বাক্স হাতে, প্রদ্যোত মহারাজকে কী জানি কী দেখাচ্ছেন। উপাধ্যায়দা আমাদের হস্টেলের বাগানের কেয়ারটেকার ছিলেন, ‘মালী’ বললাম না কারণ সেটা বললে যে কোয়াসি-রাবীন্দ্রিক ছবিটা মনে ভেসে ওঠে উপাধ্যায়দা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বাগান করার কাজের পাশাপাশি ছেলেদের ওপর নজর রাখার কাজটাও প্যারালেলি করতেন, এবং স্বাভাবিকভাবেই বানর ছাত্রদের চক্ষুশূল ছিলেন। আশ্রম-পুরাণে দু’টি লাইন থেকে গেছে – “আমার কাজ গার্ডেনিং, কিন্তু আমি করি ওয়ার্ডেনিং।”
সেদিন উপাধ্যায়দা মহারাজকে যা দেখাচ্ছিলেন, সেটা ছিল ভার্মিকালচারের বাক্স।
ভার্মিকালচার মানে ভার্ম – অর্থাৎ ওয়ার্ম – দিয়ে সার কালচার করানো। কেঁচো যে কৃষকের বন্ধু সে তো জানা কথাই, এবং সেই হিসেবে মালীরও বন্ধু। কিন্তু মাটির ভেতরে বাস করা কেঁচোকে দিয়ে এমনিতে যতটা উপকার হয়, তার উপরে আরো খানিকটা উপকার আদায় করে নেওয়া যায় এই ভার্মিকালচার দিয়ে। ছোট পরিসরে সারযোগ্য জৈব জিনিস রেখে, তাতে প্রচুর কেঁচো ছেড়ে দিয়ে, বেশ কয়েক সপ্তাহ (বা মাস) ধরে এই প্রক্রিয়া চলে।
বিদ্যাপীঠে থাকতে জিনিসটা শেখা হয়নি। বিদ্যাপীঠ ছাড়ার পর থেকে কোনোদিন বাগান করাও হয়নি যে সেই সুযোগে শিখব। চোদ্দো বছর পর, এই কিছুদিন আগে, অবশেষে সে সুযোগ পেলাম।
ঘরের পাশে চারটে টবগাছ। তাদের জন্যেই মাথায় এসেছিল ব্যাপারটা। তারপর ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখি, খুব একটা জটিল কিছু কাজ নয়। ধাপে ধাপে ছবি দিয়ে বোঝানো আছে কীভাবে ভার্মিকমপোস্ট বানাতে হয়।
একটা প্লাস্টিকের বাক্স লাগে, তার গায়ে আর তলায় ছ্যাঁদা, যাতে জল-হাওয়া চলাচল করতে পায়। সেই বাক্সে বেশ খানিকটা কুচোনো (বা ফালি করে কাটা) কাগজ দিতে হয় – খবরের কাগজ চলতে পারে, যত নরম হয় ততই ভালো, খুব স্টিফ গ্লসি কাগজ হলে লাভ হবে না। এই কাগজকুচো হবে কেঁচোর বেডিং। এবার তার ওপরে হালকা করে মাটি ছড়িয়ে দিতে হয়, তারপর কেঁচো ছাড়তে হয়। হপ্তায় একবার করে অল্প খানিকটা তরিতরকারীর খোসা যোগান দিয়ে গেলেই যথেষ্ট। পুরো সিস্টেমটা হালকা ভিজে-ভিজে থাকতে হবে, জল-জমা নয়, কিন্তু শুকনোও নয়, এরকম। দিনে একবার সামান্য জল ছিটিয়ে দিলে কাজ চলে যায়।
কতগুলো কেঁচো ছাড়তে হয়? সেটা যে ছাড়ছে তার ওপর। বিদেশে বাগানওয়ালারা কৌটোভরা জ্যান্ত কেঁচো কেনে, এদেশে সে জিনিস কীভাবে পাওয়া যায় জানি না। কেউ সোজাসুজি বাগান থেকে কেঁচো ধরেও ছাড়তে পারে। তবে তাতে বেশী কেঁচো হবে না, কৌটো কিনলে এক কৌটোয় হাজারটা কেঁচো থাকে। কোন্ জাতের কেঁচো দিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজ হয় তারও নামধাম আছে, কিন্তু আপাতত অতটা না ভাবলেও চলবে।
একবার কেঁচোরা বাসা বাঁধলে চিন্তা নেই, ওরা উভলিঙ্গ প্রাণী, জনসংখ্যাবৃদ্ধির ব্যাপারটা নিজেরাই দেখে নেবে। আর কৌটোর ছ্যাঁদা দিয়ে কেঁচো পালিয়ে যাবে বলে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই, ওরা আলো পছন্দ করে না, কৌটোর ভেতরে যে মাটি-পাতা-খোসা-কাগজ ভরা অন্ধকার সোঁদা পরিবেশ তৈরী হয়েছে, তা ছেড়ে ওরা কোত্থাও যাবে না।
বেশী কেঁচো থাকলে কম দিন সময় লাগবে, কম কেঁচো থাকলে বেশী দিন। কৌটোর মধ্যে যে কাগজ আর খোসা দেয়া হয়েছে, কেঁচোরা সেই কাঁচামাল থেকে ধীরে ধীরে ফার্স্টক্লাস কমপোস্ট তৈরী করবে। সে এক শেক্সপীয়রিয় ব্যাপার।
আমি যখন ঠিক করলাম ভার্মিকালচার করব, তখন লকডাউন চলছে। কাস্টমাইজড বাক্স-ফাক্স আর পাই কোথায়? একটা খালি থাম্স-আপের বোতল নিয়ে ওপরটা কেটে বাদ দিলাম। তারপর গায়ে ফুটো করলাম কয়েকটা (ফুটো করার যন্ত্র ছিল না, কাটার দিয়ে কেটে কেটে করলাম, খুব বিকট দেখতে হয়েছিল)। তারপর তাতে কাগজকুচো আর অল্প মাটি দিলাম। ভোররাতে বৃষ্টি হলে পরদিন সকালে দেখেছিলাম কেঁচোরা বেরোয়, সেই সুযোগ বুঝে দু’তিনদিন ধরে খানকতক কেঁচো ধরলাম। ধরতাম আর ওই থাম্স-আপের বোতলে ছাড়তাম, তারপর ওপরে একটা প্লাস্টিকের বাটিচাপা দিয়ে রাখতাম যাতে অন্ধকার হয়। ভেতরে কী হচ্ছে ওপর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু এটা পরিষ্কার বোঝা গেল যে ফুটো দিয়ে কেঁচো না পালানোর তত্ত্বটা সত্য।
প্রায় মাসখানেক পরে একটু নেড়েচেড়ে বুঝলাম, কেঁচোগুলো এখনও আছে, বেশ কিছুটা কাগজকুচো রিসাইকলও করেছে। কলার খোসা-টোসা যা অল্প দিয়েছিলাম, তাও দেখতে পাচ্ছি না। মোট কথা, নট আ ফেলিওর।
তাই উৎসাহিত হয়ে ভার্মিকালচার.২ লঞ্চ করলাম। বড় কৌটো, এতে হাত ঢোকানো যাবে, ঢাকনা আছে, উন্নত উপায়ে ছিদ্র করা হইয়াছে। এসব কালকের কথা। আজ সকালে বেরিয়েছিলাম কাঁচামাল যোগাড় করতে। তা, বাড়ির সামনেই যা পাবার পাওয়া গেল।
আমি ভেবেছিলাম, শুধু কাগজকুচো না দিয়ে এবার সঙ্গে কিছু পাতা-টাতা দেব। আসল বাগানের কাছাকাছি পরিবেশ যতটা দেওয়া যায়। সকালে সাড়ে ছ’টায় (বাংলায় চেয়ে পুণার সময় একটু পিছিয়ে) বেরিয়ে দেখি, প্রচুর শিউলি পড়ে আছে। আর ওপাশে একটা ভাঙা নিমের ডাল খসে পড়েছে পথের ধারে।
আরো খানিকটা হেঁটে গেলে একটা রাস্তার ধারে একটা কৃষ্ণচূড়া পড়ে। সেখান থেকে অল্প মেটেরিয়াল নিয়ে এলাম। আর ক’টা সাইজওয়ালা পাতা। – এসবের সঙ্গে মেশানোর জন্য কাগজ আগে থেকেই কুচোনো ছিল। খবরের কাগজ নেই, তাই ব্রাউনপেপারের ফেলনা ঠোঙা, দোকানের রসিদ, আর টয়লেট পেপার দিয়ে বানালাম, খবরের কাগজের চেয়ে ভালোই হল। তারপর মিশিয়ে জমা করে দিলাম কৌটোর ভেতর। নিমপাতা, শিউলি, কৃষ্ণচূড়া, সব মিলে বেশ শৌখিন ব্যাপার। ঘর থেকে প্রায় প্যালেসের পর্যায়ে চলে গেছে। সকালে কলা খেয়েছিলাম, তার খোসা থেকে খানিকটা ছিঁড়ে ছোট ছোট টুকরো করে ভেতরে দিয়ে দিলাম। আসবাব, খাবার, – সব তৈরী।
এইবার কিছু ভাড়াটে চাই।