মানুষ যখন অন্য মানুষের কাছে তার নিজের কষ্টের কথা বলে, তখন তার মনে যা জেগে থাকে তা হল মানুষের ওপর বিশ্বাস। এই বিশ্বাস, যে অন্যজনে আমার কথা শুনবে, বুঝবে, এবং সহানুভূতিশীল হবে। মানুষের শুভবোধের ওপর এই মজ্জাগত বিশ্বাস থাকে বলেই আমরা কারো সাথে নিজের দুঃখের কথা ভাগ করে নিতে ভরসা পাই। এটা না থাকলে কেউ কারো সামনে মুখ খুলত না, দুর্বলতার কথা পাঁচজনের সামনে মেলে ধরত না। লুকিয়েই রাখত। যেখানেই দেখা যাবে যে কেউ অপরের কাছে নিজের কষ্টের কথা ভাগ করে নিতে চাইছে, বুঝতে হবে যে তার সেই শ্রোতার শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা আছে।
ইতিহাসে যখনই মানুষ নিজের ব্যক্তিগত ক্ষতিকে স্বীকার করে, ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে – কোনো আন্দোলন, প্রতিবাদ, বিপ্লব বা আদর্শের জন্য জোট বেঁধেছে, তখন প্রতিবারেই সমষ্টির শুভবুদ্ধির ওপর তার অটল আস্থা কাজ করেছে। ফরাসী বিপ্লবে যে কৃষক নেমেছে সে এই বিশ্বাস নিয়েই নেমেছে যে বাকি সব মানুষও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপ্লব করবে; বুড়িবালামের যুদ্ধে যে প্রাণ দিয়েছে সে এই বিশ্বাস নিয়েই মরেছে যে সে যাদের জন্য মরল তারা এই লড়াই চালিয়ে নিয়ে যাবে, তারা আপোষ করবে না। কোনো একদিন যে সেই উত্তরপুরুষরা একে অন্যেকে পথেঘাটে মেরে ফেলবে, এই কথা সেই শহীদরা কোনোদিন ভাবেনি। – এই যে সমষ্টির ওপর বিশ্বাস, এটা যেকোনো লড়াইয়ের মূলে থাকে। এটা না থাকলে কখনোই কোনো আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না। এই জোরটা যাতে কোনোদিন নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্যেই একজন বলে গেছিলেন, “মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।” তিনিও জানতেন মানুষ কত নীচে নামে, জীবনে কম ব্যথা পাননি মানুষের হাতে। কিন্তু তাও জমি ছাড়েননি। কনভিকশন ছাড়েননি।
এখনকার দিনের সমস্যা হল আমরা সবাই ভাবি যে ‘পাবলিক’ = আবাল।
মানে ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস’ জিনিসটা নেই। আছে, দুর্বলভাবে। এবং এই জিনিসটা একটা ক্রিস্ট্যাল ল্যাটিসের মতো সবার মধ্যে ছড়িয়ে আছে। চেনাজানাদের মধ্যে সবাই সবাইকে একটুখানি বিশ্বাস করে, ব্যাস তার বেশী নয়। আমার জন্যে কিছু মানুষ কয়েক পা এগিয়ে আসবে, এইটুকু বিশ্বাস আছে, কিন্তু খুব বেশীদূর এগোবে এই বিশ্বাস নেই। তাই যে ভিকটিম, সে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে একটু শান্তি পাবার সাহসটুকু পায়। কিন্তু পাল্টা আঘাত হানবার যোগাড় করার সাহস পায় না, কারণ গ্যারান্টি নেই যে কারো সাহায্য পাবে। পেলেও, যতদূর দরকার ততদূর পাবে সে সম্ভাবনা প্রায় নেই। ‘আমার বেলা কে করে তার নেই ঠিক’ – এটাই সবাই ভাবে। এবং সবাই ভাবে যে এটাই সবাই ভাবে।
তাই কনসিকোয়েন্সের কথা আসছে। যদি এই বিশ্বাস থাকত যে “ওরা আমার পেছনে গুণ্ডা লাগাবে? আমার বন্ধুরা আছে, সব সামলে নেব। ওরা আমার চাকরি খেয়ে দেবে? আমার লোকেরা আছে, ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” এই ভরসার জায়গা থাকলে ভয়ের জায়গাটা থাকত না। ভয় আসে এই থেকেই, যে আমি তো দুম করে যুদ্ধ ঘোষণা করব, তারপর কেউ আমার হয়ে লড়বে তো? কেউ আমার জন্য ঢাল হবে তো? বুড়িবালামের তীরে যারা লড়েছিল, তাদের সেই বিশ্বাসের জোর ছিল। আমাদের এখন নেই। অবশ্যই সেটা ১৯১৫ ছিল আর এটা ২০১৮, সারা পৃথিবীটাই বদলে গেছে। মানুষে-মানুষে রসায়ন বদলাবে না তা হয় না।
এখানেই আমাদের দলের অস্তিত্ব আলাদা করে মানে করে নিতে পারে। যেখানে আর যা কিছু থাক বা না থাক, একটা অসম্ভব কমিটমেন্ট, অদ্ভুত একটা বিশ্বাস থাকবে সবার মধ্যে। All for one, one for all. এটাই অবস্থান হওয়া দরকার, আমার মনে হয়। স্তূপ করা ইটের রাশি, আর ইটের দেওয়াল – দুটো এক কথা নয়। Human wall মানে হিউম্যান ওয়ালই, হিউম্যান হীপ অফ ব্রিকস না। এই বন্ড চাই। মানুষকে বিশ্বাস করার সাহস চাই।
সাহস থাকলে তা থেকে বিশ্বাস তৈরী হবে; বিশ্বাস তৈরী হলে ভরসা হবে; ভরসা হলে সবাই মুখ খুলবে এবং যতদূর বলা দরকার সবটাই বলবে, অসঙ্কোচে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক – কোনো বাধাই আর দাঁড়াবে না, কারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাপোর্ট তার পাশেও দাঁড়াচ্ছে। মানুষ তার নিজের সামাজিক জোর, টাকার জোর, রাজনৈতিক জোর নিয়ে তার পাশে দাঁড়াচ্ছে, সোজা কথা। এই ধক চাই।
বড় বড় ইস্যুর সমাধান ছোট কথায় হয় না। বড় চাবিই লাগে। এই চাবিটার নাম trust, commitment, love।