কথায় আছে, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পার অমূল্য রতন।’
আমার এখনকার ইস্কুলে ছাত্রছাত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। সিবিএসসি বোর্ড, তার সিলেবাস বছর বছর আধুনিক হওয়ার বদলে পৌরাণিক হয়ে চলেছে। রামরাজ্য আসছে তো, তার জন্য প্রজা তৈরী হচ্ছে কারখানায়। যে সিটিজেনের চোখ নেই, শিং নেই, নোখ নেই।
আমি বাজে লোক, তাই এইরকম শান্তিপূর্ণ জিনিসপত্র দেখলে গা কিরকির করে। ইংরেজী পড়ানোর সুবিধে হল, চ্যাপ্টার পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক বেআইনি কথাবার্তা মিশিয়ে দেওয়া যায়। এই সুবিধে ইতিহাস পড়ানোর বেলাতেও থাকে। আমি যখন কয়েকমাস হিস্ট্রি টীচার ছিলাম, তখন এইসব মিসচীফ ম্যানেজ করা শিখেছিলাম।
বৃষ্টির জন্য স্কুলের অ্যানুয়াল কনসার্ট পিছিয়ে গেল। কথা ছিল পাঁচ-ছয় তারিখে খোলা স্টেজে নাচগান হবে। তার জন্য পুজোর ছুটির পর থেকে টানা প্র্যাক্টিস চলছে। পড়াশোনায় জলাঞ্জলি, ক্লাসফাস আদ্ধেক সময় বন্ধ, মাইক লাগিয়ে বক্স বাজিয়ে নাচ প্র্যাকটিস হচ্ছে। বাছাবাছির কোনো ব্যাপার নেই, ইস্কুলসুদ্ধ সব ছেলেমেয়েই নাচবে, কারণ পইসা তো সবার বাবামাই দ্যায়? তাদের বাচ্চা স্টেজে চড়বে না কেন? – তাই প্র্যাকটিস চলেছে। এর মধ্যেই আবার যেসব বাচ্চারা একটু বলিয়েকইয়ে ধরনের, মানে যাদের ‘পাবলিক স্পিকিং’ স্কিল আছে, তাদের থেকে বেছে বেছে গণ্ডাপনেরো সঞ্চালক বার করতে হবে। সাধারণভাবে আমরা বলি অ্যাংকর, আর এইসব নামী ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে বলে ‘compere’.
আমি সহ আরো কিছু টীচারের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল, এই ‘কমপেয়ার’দের সামলানোর। সেই সামলানোর গল্প বলার মতো ধৈর্য্য বা মুড কোনোটাই নেই, জাস্ট ঝাঁটজ্বলা কেস। তবে মাঝেমধ্যে হত কী, সেই একই লাইন বকবক করতে করতে ছেলেমেয়েগুলোও বিরক্ত হয়ে যেত, আমারও আর ভাল্লাগতো না। তখন আমি একবার টক করে দেখে নিতাম ধারেকাছে অন্য কোনো বুড়োধাড়ি লোকপত্র আছে কিনা। তার পর ওদের যতগুলোকে পারতাম জড়ো করে গল্প করতে বসতাম।
এদের মধ্যেই কয়েকটা আছে বইপোকা। সিনেমা দ্যাখে, গান শোনে, এলভিস প্রেসলের নাম জানে। হ্যারি পটারের জান-কবুল ভক্ত আছে কয়েকজনা। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার মার্ভেল ফ্যান। একদিন সুপারহিরোদের নিয়ে কথা তুললাম। – সুপারম্যান পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত সুপারহিরো, কিন্তু সবচেয়ে আন্ডাররেটেড বললেও খুব একটা ভুল বলা হয় না। কারণ সুপারম্যানের হিরোইজম আসলে যেখানটায়, সেখানটা নিয়ে প্রায় কেউই কোনো কথা বলে না। আকাশে ওড়া আর চোখ দিয়ে লেসার ছোঁড়াটা নিছক কসমেটিক। সুপারম্যানের আসল অতিমানবিকতা অন্য জায়গায়। জেফ লোয়েব একটা বইয়ে ব্রুসের মুখ দিয়ে সেটা বলিয়েছেন – “It is a remarkable dichotomy. In many ways, Clark is the most human of us all. Then he shoots fire from the skies and it is difficult not to think of him as a god. And how fortunate we all are that it does not occur to him.” — এইসব নিয়ে ভাঁট হল খানিক। ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সেই ক্ষমতার কাছে নিজেকে হারিয়ে না ফেলা কতটা অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে, তাই নিয়ে ভাবাভাবি হল। ফ্যান্টাসি আর সায়েন্স ফিকশন নিয়ে রড সারলিং-এর সেই লেজেন্ডারী লাইনটা নিয়েও ঘাঁটলাম একটু। দুঃখের বিষয় যে শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের কথা টানা গেল না – এরা কেউ বাংলা পড়ে না।
আমার একটা মতলব ছিল যে এদেরকে একটু ইউরোপ-আমেরিকার ইতিহাসের ব্যাপারে বলতে হবে। অন্তত আমরা যেটুকু শিখেছিলাম সেইটুকু। ছত্রপতি-মার্কা ইতিহাস পড়ে পড়ে এদের মাথায় ছাতা পড়ে যাচ্ছে। সেটা চটানো খুব দরকার। আমি যেখানে ক্লাসটীচার সেখানে ইংরেজী ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মোটামুটি বস্টন টী পার্টি থেকে শুরু করে নেপোলিয়ন অবধি এসেছে, কিন্তু এই কমপেয়ারিং টীমটার সঙ্গে আলাদা করে বসার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এরা আবার বেশীরভাগই এইটে পড়ে, তাই আমার সাথে এদের এমনিতে কোনো ক্লাস নেই।
এই বৃষ্টির জন্য কনসার্ট পিছিয়ে গিয়ে আজকে হঠাৎ একটা সুযোগ হয়ে গেল।
আমি দলটাকে বললাম তেতলার তিন নম্বর করিডোরের খালি ক্লাসঘরটায় গিয়ে বসতে, আমি যাচ্ছি। তারপর বাকি সব দিক দেখেশুনে মিনিট দশেকের মাথায় গিয়ে পৌঁছলাম।
ঢুকে দেখি দিনের বেলায় ব্যাটারা লাইট-ফ্যান সব চালিয়ে বসে আছে। সব অফ করলাম, তারপর বললাম, “লাইট জ্বালিয়েছিলিস কেন? আর ইউ পীপল দিস অ্যাফরেইড অফ শ্যাডোজ?” শুনে ধার থেকে এক বালক বলল “স্যার দ্য নাইট ইজ ডার্ক, অ্যান্ড ফুল অফ টেররস।” আমি হেব্বি খুশী হয়ে তাকে বললাম, “বাট উই আর দ্য লীগ অফ শ্যাডোজ।”
তারপর স্প্যানিশদের ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ আবিষ্কার আর ব্রিটিশদের থার্টিন কলোনিজ পত্তনের কিসসা শুরু করলাম। — যখন বেশ রেলিশ করে ব্রিটিশদের গোঁয়ার্তুমি আর কলোনিস্টদের ব্যাডঅ্যাসারির কথা বলছি, তখন একটা মেয়ে হঠাৎ প্রবল আপত্তি সহকারে প্রশ্ন করে বসল, – আচ্ছা সবসময় ব্রিটিশ আর ইউরোপিয়ানদের ব্যাপারে বাজেই বলা হয় কেন? সবসময় গান্ধী-ফান্ধীদের ব্যাপারে ভালোই বলা হয় কেন? উল্টোটাও তো হতে পারে! কখনো ওদের ব্যাপারে ভালো আর এদের ব্যাপারে খারাপ কিছু বলা হয় না কেন?
যেচে নিষিদ্ধ ভাঁট দিতে বসেছি, এখন তো আর এইসব বেয়াড়া প্রশ্নে না করে দেওয়া যায় না? তাই অতঃপর তাকে বোঝাতে হল যে হে সরলমতি বালিকা, তুমি জান না, ইস্কুলে যাহা পড়ানো হইয়া থাকে তাহা ট্রুথ, হোল ট্রুথ এবং নাথিং বাট দ্য ট্রুথ নহে। ইহার বাহিরেও ব্যাপার আছে, যাহা তুমি কখনো কোনো পাঠ্যপুস্তকে পড়িবে না। সেই সমস্ত ধূসর জিনিস ঘাঁটিয়া দেখ, ভালোর ব্যাপারে খারাপ এবং খারাপের ব্যাপারে ভালো যথেষ্ট বলা হইয়াছে।
তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, – স্যার, তাহলে ক্লাসে টীচাররা সব জানা সত্ত্বেও আমাদেরকে ঠিক জিনিসগুলো পড়ান না কেন?
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, – কারণ টীচারদের চাকরি বাঁচিয়ে পেট চালাতে হয়।
কারো নাম না করেই বললাম কীভাবে সত্যি কথা বলার দায়ে মানুষজনকে খুন হতে হচ্ছে – কাছে, দূরে। বললাম যে ভারতবর্ষ ফ্যাসিস্ট দেশ হয়ে যাচ্ছে। বললাম যে পুষ্পক বিমানকে প্রথম এরোপ্লেন বলা হচ্ছে যে দেশের বিজ্ঞান মঞ্চে, সেই দেশে শিক্ষকদের সত্যভাষণ বন্ধ থাকাই স্বাভাবিক।
দ্য ডেইলি প্রফেট কেন ডার্ক লর্ডের কথা সবাইকে সময় থাকতে জানায়নি, রিটা স্কিটার দেশের প্রথম সারির সেলিব্রিটি সাংবাদিক হয়েও কেন মিথ্যে কলাম লিখে গেছে মাসের পর মাস, ক্ষমতাসীন শক্তি কীভাবে রদবদল করে দিয়েছে খবরের কাগজ থেকে পাঠ্য বইয়ের চেহারা, – বললাম সেই কথা।
এবং এটাও বললাম – বলতেই হত – যে সত্যির মুখ কোনোদিনই একটা নয়। একই লোক এক গল্প থেকে আরেক গল্পে হিরো থেকে ভিলেন হয়ে যায়। একই দেশ এক ন্যারেটিভ থেকে আরেক ন্যারেটিভে নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে যায়। উদাহরণ দিতে গিয়ে না ভাবতেই একটা নাম মুখে উঠে এল… সেভারাস স্নেপ।
এরা এখনো ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’ দেখেনি সবাই। ‘দ্য ডার্ক নাইট’ও না। দেখার পর সীজারের প্রসঙ্গ তুলতে পারব। — যদিও এদের মধ্যে একজন আছে যার মা টিনটিন পাগল, বাবা মার্ভেল ভক্ত, আর সে নিজে পোকা অ্যাসটেরিক্সের। এইসব বীজাণুর পারস্পরিক আদানপ্রদান ঘটানো দরকার এদের মধ্যে। সিবিএসসি বোর্ড যতই পট্টি লাগাক আর গণ্ডি কাটুক, রাস্তা তো কোথাও না কোথাও বেরোবেই। মগজধোলাই কি অত সস্তা ভাই? ইতিহাস নিজেই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, একটু সুযোগ পেলে।
ওপরওপর তেমন আশাজনক নয় কোনোকিছু। সব খারাপের দিকেই যাচ্ছে। পোড়া ছাইয়ের স্তূপ জমছে চারদিকে।… কিন্তু আগুন কোনোদিন উপর থেকে নীচে নামে না, নীচ থেকেই বেয়ে ওঠে। সেই কথা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। সুতরাং যেখানে দেখিবে ছাই…