গন্ধ

কত স্বপ্ন ছিল, শহরের প্রান্তে একটা কাবাড়খানায় আবর্জনা সামলানোর কাজ থাকবে। একটা জঞ্জালতোলা ট্রাক নিয়ে পার্টনারের সাথে বেরোতে হবে মাঝে মাঝে, শহরে টহল দিতে। ডেরায় সম্পূর্ণ প্রাইভেসি, কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। আর কোয়ার্টারের নীচে বেসমেন্টে লুকোনো থাকবে আমাদের গোপন জেট প্লেনের হ্যাঙ্গার। গাড়ি সারাইয়ের মাঝখানে হঠাৎ ভীষণ জোরে লাল আলো জ্বলে সাইরেন অ্যালার্ম বেজে উঠবে, আর চমকে উঠেই সাথে সাথে স্ক্রুড্রাইভার-স্প্যানার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হ্যাঙ্গারের দিকে ছুটতে শুরু করব।

নাঃ, সেসব আর এ জীবনে হল না।

ক্লাস এইটে যখন পড়ি, তখন কোন্ এক বাংলা ক্লাসে কার্তিকদা কী প্রসঙ্গে যেন জিজ্ঞেস করলেন, “মোহন পড়িসনি? দস্যু মোহন?” — মোহন কারও জানা ছিল না, কাজেই সেদিন ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু তার পরেই কোনো এক ছুটিতে বাড়ী ফিরে একদিন এক বইয়ের দোকানের সবচেয়ে উপরের তাকে দেখলাম রাখা লাল রঙের মোটা একটা বই, গায়ে লেখা ‘মোহন অমনিবাস – ১’। নামাতে বললাম, কিনতে পারবো কিনা সেই কথা ভাবতে ভাবতে। লাল রঙের বোর্ড বাঁধাই মলাট, তলার দিকে একটা কালো হ্যাট আর আইমাস্কের ছবি, – মলাট খুলে দেখলাম দেড় ইঞ্চি মোটা বইয়ের দাম লেখা আছে পঞ্চাশ টাকা।

সেবার বিদ্যাপীঠে ফিরে আমি আমার ব্যাচে মোহন ইন্ট্রোডিউস করি। আমার জীবনে যে কয়েকটা পীয়ারলেস পুণ্যকর্মের জন্যে আমি ভয়ঙ্কর গর্বিত, তার মধ্যে একটা হল আমি ক্লাস ফোরে আমার ব্যাচে টেনিদা ইন্ট্রোডিউস করেছিলাম (কারোও পড়া ছিল না টেনিদা, ‘কুণ্ডুমশাই মুণ্ডু নাচায়’ শুনে তো আমার এক কুণ্ডুবংশোদ্ভুত ক্লাসমেট স্যারকে কমপ্লেনই করে ফেলেছিল, ‘স্যার ও আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে ছড়া বলছে’, স্যার আমাকে বলেছিলেন ‘অ্যাইঃ ওর নামে ওরকম বলিসনা!!!’)। আর আরেকটা হল আমি ক্লাস এইটে আমার ব্যাচে মোহন নামক মাদকদ্রব্যটি আমদানী করেছিলাম। আমার বইয়ে লাইন দিয়ে গোটাকতক বইপাগল ছেলে মোহন পড়ে ফেলল, পড়ে ফিদা হয়ে গেল, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স আর ফাইভ ফাইন্ড আউটার্সের পাশাপাশি মোহনের অ্যাডভেঞ্চারেও সামিল হতে থাকলাম আমরা, সন্ধের স্টাডির গুলতানিতে, ডাইনিং হলের ভাঁটে, ভজন হলের গ্যাঁজানোয়। তখন কোথায় মার্ভেল, কোথায় নোলান!!!

জীবনের লক্ষ্য তখন রোমহর্ষক উপন্যাসের সুরে গাঁথা।

তারপর আস্তে আস্তে ভোঁতা হতে থাকল সেইসব চাঁছাছোলা, ইম্প্র্যাকটিকাল ধ্যানধারণা। ফীলিং বাদ দিয়ে থিংকিং-এ ঢুকে গেলাম ব্রুস লির উপদেশ অগ্রাহ্য করে। মরণ হাতছানি পাঠাতে শুরু করল, ‘এসো, আমার ছায়ায় ঘুরে যাও।’

একদিন সামনের কার্পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একা একাই স্বীকার করে ফেললাম – না, অমন কখনো হয় না।

কিন্তু রক্ত বিষিয়ে গেলে সেই দোষ কাটানো খুব শক্ত।

গুগল ক্লাসরুমে একটা আলাদা গ্রুপ খুলেছি আজ কয়েকদিন হল। ‘রুম অফ রিকোয়্যারমেন্ট’। তাতে বেছে বেছে কিছু বইপোকা ছেলেমেয়ে রেখেছি। এবার নিয়মিত মাল জুগিয়ে যাব। সুপারহিরো ফিকশন, গল্পের বই পড়া ভার্সাস গল্পের বই না পড়া, আর ইতিহাসের সাথে সাহিত্যের যুগলবন্দী – এই তিনটে ফ্রন্টে কাজ অলরেডি শুরু করেছি। আজকে হালকা করে একটু এইটিজ-এর টিভি সিরিজ নিয়েও খোঁচাখুঁচি হল। এরা কয়েকজন ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-এর ভক্ত। সুবিধেই হচ্ছে। ফাঁকা সময় পেয়ে সুপারম্যানের হদ্দ-চেনা গল্প জোর করে আবার নিজে মুখে বলে শোনালাম একদিন। শুনিয়ে বললাম – ‘শিশুসুলভ লাগল??’ বলল ‘নাহ্।’

একজন মেয়ে জানাল যে তার বাবা ওল্ড স্কুল মার্ভেল ফ্যান। বাড়িতে কমিক্সের ডাঁই আছে নাকি। আমি বললাম, ‘রোসো, তুমিও পাবে।’ আরেকটা মেয়ে একদিন হঠাৎ করে বলল, “আমার বাবা নাইট রাইডারের ভক্ত! আমিও। নাইট রাইডার ব্যাপক!!!!” – আমি শুনে স্রেফ হাঁ হয়ে গেলাম। নাইট রাইডারের রি-রান আমি দেখতাম এত ছোট বয়সে যখনকার স্মৃতিও আমার ভালোরকম নেই। পিসতুতো দাদা ফ্যান ছিল, সোমবার রাত সাড়ে ন’টায় ডিডি ওয়ান খুলে বসে যেত, বাড়িসুদ্ধ সবাই দেখত। আমিও। গাড়িটা অদ্ভুত দারুণ লাগত। বিদ্যাপীঠে বন্ধুদের কাউকে কাউকে ‘নাইট রাইডার বলে একটা বহু পুরোনো সিরিজ’-এর কথা বলেছিলাম, কেউ চিনতে পারেনি, আমলও দেয়নি বিশেষ। পরে কলেজের সময় আমি টরেন্টে পুরো সিরিজটা পেয়ে নামিয়ে ফেলি। – এখন কোথা থেকে ক্লাস এইটের এই মেয়ে বলছে তার বাবা নাইট রাইডার পাগল। সে নিজেও নাইট রাইডার বলতে অজ্ঞান।

বব মার্লের ওপর যারা গুলি চালিয়েছিল তারা একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তাদের গুলি মার্লেকে আহত করেছিল। চোট সত্ত্বেও মার্লে পারফর্ম করবেন বলেন। কেন বিশ্রাম নিচ্ছেন না, একথা জিজ্ঞেস করায় জবাব দিয়েছিলেন, ‘যারা দুনিয়াটাকে কুৎসিত করে দিতে চাইছে তারা কি আর বিশ্রাম নিচ্ছে ভাই? আমারও বিশ্রাম নিলে চলবে না।’

যার জন্যেই – গথাম কোনোদিনও শুচি হবে না জেনেও – জনৈক পাগল ভদ্রলোক প্রতি রাতে গার্গয়লের মাথায় চড়ে শহর পাহারা দেন।

উধোর সেই বয়সের ইয়েটা কীভাবে ম্যানেজ করত সেটা রহস্য থেকে গেছে। ব্যাপারটা এখানেই কোথাও একটা আছে, গন্ধ পাচ্ছি যেন মনে হচ্ছে। আরেকটু হাতড়াতে থাকলে নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।

^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *