জলছবি

যে জিনিসটা হবেই, তা নিয়ে হাহুতাশ ধস্তাধস্তি করে লাভ আছে কিছু?

পুরুলিয়ায় বর্ষাকালে প্রচণ্ড বৃষ্টি হত। ছাতায় সেই বৃষ্টিকে কিছু করা যেত না। কারণ বৃষ্টির সাথে সাথে উঠত ভীষণ জোর বাতাস, আর সেই ঝড়ে ছাতার আর কিছু রাখত না। কোনোক্রমে ছাতা বাঁচলেও জামাকাপড় জলের ছাটে ভিজে একসা হয়ে যেত। আমরা বলতাম যে পুরুলিয়ায় শুধু ‘বৃষ্টি’ বলে কিছু হয় না, যা হয় সব ‘ঝড়বৃষ্টি’।

তা, আমাদের তো সন্ধের ভজনে ধুতি পরে যেতে হত। ফেরার পথে প্রায়ই বাইরে বৃষ্টি। ধুতির পেছনে কাদার স্প্রে পেন্টিং দিতে দিতে আমরা ছাতা আঁকড়ে ধামে ফিরতাম। সেসব আমাদের সেভেন-এইট-নাইন বয়স। বিদ্যাপীঠের হাজার নিয়মকানুনের কাঁটা সত্ত্বেও ফুলফোটা প্রথম গোলাপবাগান। সেই সময়েই আমার একটা মহান উপলব্ধি হয়। এই যে বৃষ্টি, মেঘ, কাদা, মাটি, ঝড়, – এসব জিনিস তো ভাই আমি এই পৃথিবীতে আসার বহু আগে থেকে এখানে আছে। মানুষ আসারই বহু আগে থেকে এরা এখানে আছে। তো আমি যদি এখন আউট অফ নোহোয়্যার উদয় হই, তাহলে এদের সাথে কীভাবে আমি মানিয়ে নিয়ে সারভাইভ করব সেটা আমার ভাববার বিষয়। সেটা তো আর কখনো বৃষ্টির মাথাব্যথা হতে পারে না। এইরকমভাবে বৃষ্টি ট্রায়াসিকেও হত, এখনও হচ্ছে, পরেও হবে, কাদার ছিটে টী-রেক্সের পায়েও লাগত, এখন আমার পায়েও লাগবে। ডীল উইথ ইট।
তারপর থেকে আর কী, বৃষ্টি সোজা হয়ে গেল।

ক্লাস নাইন থেকে পেতে আরম্ভ করলাম স্বপনদার ক্লাস। স্বপনদা এমন একজন টীচার ছিলেন যিনি এখনকার দিনে পড়ালে প্রত্যেক সপ্তাহে তিনমাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি যেতেন। তা, স্বপনদার একটা ব্যাপার ছিল। পুরুলিয়ায় প্রতি বছর ভীষণ শীত পড়ত। বাইরে হু হু ঠাণ্ডা হাওয়া, মাফলার সোয়েটার ইত্যাদি পরে স্কুল যেতে হত। গিয়ে আমরা আগে জানলাগুলো বন্ধ করে ক্লাসে বসতাম, ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরটা একটু একটু গরম হত। তা স্বপনদা করতেন কী ক্লাসে এসে আগে সমস্ত জানলাগুলো হাট করে খুলে দিতেন। কেন? না এনজয় দ্য উইন্ড!! এনজয় দ্য কোল্ড!!! এটাই তো আনন্দ! প্রকৃতির ঐশ্বর্যকে বুকে টেনে নাও! ও ওয়াইল্ড ওয়েস্ট উইন্ড!!!! — ব্যাস এইভাবে তারপর ক্লাস চলত। যাদের জানলার পাশে সীট তারা ভূতগ্রস্ত সিন্ধুঘোটকের মতো ওয়াইল্ড ওয়েস্ট উইন্ডের স্নেহস্পর্শ পেতে পেতে ইংরেজী সাহিত্যের ক্লাস করত। কারো কিছু বলবারও ছিল না কারণ স্বপনদা নিজে বাই মাদার্স গ্রেস ওই বিকট ঠাণ্ডায় সারা শীতকাল হাফশার্ট পরে কাটাতেন।

সুতরাং নেক্সট লেভেল হল এই – যাহা হইবেই, যাহা হইয়াই থাকে, তাহার সাথে কুস্তি করিও না। বরং প্রেম কর।

এই শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ করা নিতান্তই প্রয়োজন।

মহামতি ডারউইন আমাদের ইভল্যুশন তত্ত্ব শিখিয়ে গেছেন। সেই তত্ত্ব বলে, প্রাণী মাত্রেই অন্য কোনো প্রাণী থেকে উদ্ভুত। এবং এই ধারার মধ্যে মিশে আছে পরিবর্তন। এক প্রাণী বদলে অন্য প্রাণী হয়ে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চিরপরিবর্তনশীল। সেই সাথে তাল মিলিয়ে প্রাণীরাও বদলাতে বাধ্য, কারণ যারা বদলাবে না তারা লুপ্ত হয়ে যাবে।

আমরাও বদলাচ্ছি। যদিও আমরা টের পাই না, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমরা বিবর্তনের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে চলছি। Every thought we have, every action we take, every decision we make is a line of code in this program that has been running since forever.

মৌমাছিদের জীবনযাত্রা খুব সুষম। একটা রাণী মৌমাছি থাকে, কয়েকটা পুরুষ, আর কয়েকশো শ্রমিক। এদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে সমাজে। পুরুষ শুক্রাণু জোগায়, রাণী ডিম পাড়ে, বাকি চাক বানানো ফুল খোঁজা মধু তৈরী বাচ্চা বড় করা পাহারাদারি ইত্যাদি সব কাজ শ্রমিকরা করে। এদের কোনোধরনের কোনো ইউনিয়ন লাগে না, এদের কোনোরকম কোনো বিপ্লব হয় না, এদের মধ্যে কোনো ষোড়শ লুই বা ভলতেয়ার জন্মায় না বা জন্মানোর দরকার হয় না। এদের সবটাই ছকা আছে, এবং সেই ছক মতোই নিখুঁতভাবে এদের জীবন চলে। কেউ কোনোরকম কিছু চাপ নেয় না।

যত ঝামেলা আমাদের।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা বিবর্তনশীল। আমরাও বদলাবো, কারণ আমরা বদলাচ্ছি। মানুষ এখন সভ্যতার সেই দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আর কোনো দোলাচলের অবকাশ থাকবে না। একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন কাজ করবে সর্বত্র।

যেমন ধরা যাক স্কুল। স্কুলে এখন আর আগের মতো খেয়ালখুশি ছন্নছাড়া কাজকর্ম হয় না। যেকোনো ক্লাসের প্রতিটা সেকশনের প্রতিটা ছাত্রের খাতায় হুবহু একই কথা লেখা আছে কি না সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়। ছাত্ররা যাতে কোনো ক্লাসে যা শোনার কথা তার থেকে অালাদারকম কিছু শুনে না ফেলে সেই ব্যাপারে সর্তকতা জারী রাখা হয়। বকুনি নামক নিষ্ঠুর এবং নোংরা জিনিসটি যাতে কোনো কদাচারী শিক্ষক ভুলেও প্রয়োগ না করেন সেই দিকে তীক্ষ্ণ নজর থাকে। শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে ঠিক কী সম্পর্ক থাকবে, এবং মোর ইম্পর্ট্যান্টলি কী সম্পর্ক থাকবেনা, সেই দিকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। এই যেমন ছাত্রদের ছোঁয়া বারণ, পুরুষ শিক্ষক হলে তো ছোঁয়া বেশী বারণ, কারণ কে না জানে ছেলেরা রেপ করে। ছাত্ররা টীচার্স ডে-তে কলম দিলে নেওয়া বারণ। ‘উঠতি বয়সের ছাত্রীরা’ পুরুষ শিক্ষকদের সাথে যদি বেশী কথাবার্তা বলে তাহলে সেটায় অংশ নেওয়া বারণ, বরং তাকে থামিয়ে ফিরিয়ে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়, কারণ কে জানে সে কী মতলবে ওসব করছে?? স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোনো ছাত্রকে লিখিত কিছু দেওয়া বারণ, কারণ তা থেকে আইনি ঝামেলা হতে পারে। এই যেমন সামনের ছুটিতে কী কী বই পড়া যেতে পারে তা নিয়ে ক্লাসে মুখে কিছু বলা যেতেই পারে, কিন্তু কাগজে কোনো প্রমাণ রাখা চলবে না। ছাত্রদের অভিভাবক অফেন্স নিয়ে অভিযোগ আনতে পারেন এবং তা আনলে অভিভাবককে কোনোভাবেই নিরাশ করা হবে না কারণ তিনিই কাস্টমার এবং বাই আগরওয়াল’স থার্ড ল তিনি অলওয়েজ রাইট।

এইসবে আপনার রাগে বা শোকে মুহ্যমান হওয়ার কিছুই নেই কারণ আপনিই বলুন, আপনি চাকরি করেন আপনার আদার হাফ চাকরি করেন, আপনাদের ঘন্টা সময় থাকে বাচ্চাকে দেখার, আপনি কি চাইবেন না যে ইস্কুলে সবকিছু ‘ঠিকঠাক চলুক’? এই তো সেদিন কোন এক ইস্কুলে কোন এক বাস কণ্ডাক্টর না কে বাথরুমের ভেতর কোন এক বাচ্চার গলা কেটে খুন করেছে। তো আপনি চাইবেন না ক্লাসে টীচাররা প্রতি তিরিশ মিনিটে গুণতি করুক সব বাচ্চা আছে কিনা এবং কেউ না থাকলে সে কোথায় গেল? যে মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হয়, আপনি কি তার বাপের চেয়ে স্কুলকে মাইনে কিছু কম দেন? তাহলে আপনার ছেলের খাতাতেও পর্যাপ্ত পরিমাণে নম্বর বা নিদেনপক্ষে টীচারের খাটুনির প্রমাণ (পড়ুন চেকিং-এর দাগ) থাকবে না কেন?

সুতরাং স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন। একচুল এদিকওদিক হবে না। স্কুলে টীচারপত্র ছাড়াও এক ডজন কোঅর্ডিনেটার, কয়েকটা হেডমাস্টার, দু’টো প্রিন্সিপাল, একটা অ্যাডমিন, একটা হেড-প্রিন্সিপাল আছে, তারা পরম সাবধানতায় আপনার বাচ্চাকে আগলে রাখবে, আর চিন্তা নেই আপনার পয়সা মার যাবে না, ওই হেডমাস্টার আর ছোটো প্রিন্সিপালগুলো নিজের নিজের সাবজেক্টের ক্লাসও নেবে। আপনার আদরের মানিককে পাকা হলমার্ক দিয়ে পাশ করানোর দায়িত্ব হামাদের। তার পরে কাজকর্মের কী হবে আপনি বুঝে লিবেন হেঁহেঁ।

জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে চাপ নেওয়ার কিছু নেই। বিশ্বজোড়া নানাবিধ টালমাটাল পরিস্থিতি নিয়ে চাপ নেওয়ার কিছু নেই। কোথায় কোন্ হেঁপো বুড়ো বিনাচিকিৎসায় মরছে তার জন্য চাপ নেওয়ার কিছু নেই। আপনি যেখান দিয়ে হাগু করেন, সেই কোলনের তলায় কয়েক বিলিয়ন মাইক্রোব সংসার করে আপনি জানেন? ওদের কাছে যেমন আপনি কিচ্ছু না, একটা স্টুল-ক্যারিয়িং ভেসেল মাত্র, – এই গ্রহটা যেমন আপনার কাছে কিচ্ছু না, একটা রিসোর্স ক্যারিয়িং রক মাত্র, এই লেখাটা যেমন আমার-আপনার-সবার কাছে কিচ্ছু না, এই বিশ্রী জীবনের খানিকটা সময় কাটিয়ে পার করে দেওয়ার একটা অছিলা মাত্র — তেমনি এই সমস্ত সমস্যা চাপ বিপত্তি এসব কিচ্ছু না। সব প্রবলেম মিটে যাবে। বিবর্তন চলবে। সমাজ স্টেবল হবে। মানুষ মৌমাছি হবে। কলরব শান্ত হবে।

তারপর একদিন হঠাৎ অদ্ভুত এক কমলা বিকেলে -, …

কী জানি। আমি তো আর থাকব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *