জানার বয়স

প্রায়ই মনে হয়, – সত্যি কত কিছু জানি না।

জল কেন স্বচ্ছ, চাঁদের রঙ কেন হলুদ। চাঁদের রঙ না হয় সোনালী হতে পারে কিন্তু কেন স্কুলে পড়া কবিতায় জোছনার রঙ ছিল সিলভার? বোলতারা কী খায়। সাইবেরিয়ার মানুষ কী ভাষায় কথা বলে। আবোল তাবোল কিছু একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে খাড়া করে দেখুন – দেখবেন জানেন না।

মাত্র যে ক’টা জিনিস জানলে আমাদের চলে যায়, আমরা সাধারণ মানুষ শুধু সেটুকুই জেনে থাকি। যারা গবেষণা করেন তাঁরা নিজেদের রাস্তায় যতদূর যাওয়া যায় এগিয়ে যান, তারপর আরও পথ তৈরী করার চেষ্টা করেন। এটা তাঁরা করেন কারণ তাঁদের ধাতটাই পড়াশোনা করার, জানার, খোঁজার। অন্য কিছুর চেয়ে এটাই তাঁদের জীবিকা হিসেবে বেশী স্যুটেবল । শিক্ষাজীবন কর্মজীবন সমান। আর আরেকধরনের জানা হয় যা ঠিক প্রোফেসর শঙ্কুর লাইনের না – অনেকটা ফেলুদার লাইনের কাজ। দুইধরনের জানারই অনেক গুরুত্ব, অনেক দাম।

কিন্তু ‘যে ক’টা জিনিস জানলে আমাদের চলে যায়’ ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে কিনা সেটা না জানলেও কি আমাদের চলে যেত? – উত্তরটা সোজা নয়, ঠিক এককথায় দেবার মতন নয় (ওয়াটসন বলেছে শার্লক হোমস নাকি ব্যাপারটা জানত না কিন্তু সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল, হোমসের মতো মানুষ কনসাল্টিং ডিটেকটিভ হয়ে ওটা জানবে না তা হয় না, ওয়াটসন ওয়াজ প্র্যাংকড)।

আমরা যখন নতুন কিছু জানতে পারি, তখন সেই সাথে সাথে একটা দায়িত্বও আমাদের ওপর এসে পড়ে। নতুন যে জিনিস জানলাম, তাকে নিজেদের ধ্যানধারণা, দৃষ্টিভঙ্গী, জীবনদর্শন – এই সব কিছুর সাথে মিলিয়ে একাত্ম করে নেওয়া প্রয়োজন হয়। এটার একটা সরল চেহারা আমরা দেখি যখন কম্পিউটার ওএস নতুন আপডেট নেবার পর স্টার্ট নিতে দেরী করে। একই কথা। শুধু আমাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশী জটিল।

একজন টু বা থ্রির ছাত্র যখন প্রথম সৌরজগৎ নিয়ে জানছে, শিখছে, তখন সে শুধু কিছু তথ্য মনে টুকে নিচ্ছে এমনটা নয়। তার দুনিয়াকে দেখার চোখটাই বদলে যাচ্ছে, তার কাছে ছবিটাই পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সুয্যিমামা আউট, সূর্য ইন। যদি সে ক্লাস ফাইভে উঠেও সূর্যকে মামা বলে ডাকে, তাহলে তার বন্ধুরা হাসাহাসি করবে। কারণ ততদিনে তার চিন্তাভাবনা বদলে যাওয়ার কথা, সেই সাথে তাল মিলিয়ে কাজকর্মও বদলে যাওয়ার কথা। ‘বড় হওয়া’ একেই বলে। আর এইজন্যেই লোকে পড়াশোনা করে। শুধু জ্ঞান অর্জন করার জন্য কখনোই নয়, বরং সেই জ্ঞানকে নিজের সবকিছুর মধ্যে ফুটিয়ে তোলার জন্য। স্যাররা এটাকেই ‘হজম হওয়া’ বলতেন।

ঠিক এইজন্যেই – যখন কেউ কলেজ বা ইউনির ছাত্রদের বলে – ‘এটা পড়াশোনার বয়স, পড়াশোনা করো, পাকামো পরে করবে’, তখন সেটার কোনো মানে হয় না। সেই বয়সের ছাত্ররা যা শিখছে, তা তাদের জীবনে যাপনে চারিয়ে যেতে বাধ্য। তারা যত ভালো ছাত্র হবে তত বেশী করে চারিয়ে যেতে বাধ্য। তাদের পক্ষে কূপমণ্ডুক হওয়া, স্বার্থপর হওয়া, হিংসাপরায়ণ হওয়া, অন্যায়সহ হওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়, ঠিক যে কারণে একজন অ্যাস্ট্রোনমির ছাত্রের পক্ষে আর সূর্যকে মামা বলা সম্ভব নয়।

এটা মানুষের বোঝা উচিত।

আর সেই কথা মনে রেখে নতুন যা কিছু আমরা জানতে পারছি, তার সাথে সঙ্গতি রেখে নিজেদের কাজের ধারাও বদলে ফেলা উচিত। জানতে পারা একটা নিষ্ক্রিয় অসাড় ব্যাপার নয়, সেটা একটা লম্বা রিঅ্যাকশনের প্রথম ধাপ। আমার সামনে একটা ওয়াইট এনে ফেলা হল আমার জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্যে না – সেটা দেখে আমার মতি এবং গতি দুটোই বদলাবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাই। তা যদি না হয় তো সেটা খুব ভয়ের এবং দুর্ভাগ্যের বিষয়।

যেসব মানুষ নানারকম না-জানা জিনিসকে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে এনে ফেলছেন, তাঁরা জানুন আর না-ই জানুন, তাঁদের প্রতি আমাদের এই একটা দায় থেকে যায়। আমরা সে দায় প্রায় কখনোই মনে রাখি না। সেই কথা আমাদের মনে করিয়ে দেবার জন্য কিছু লোক মাঝেমাঝে মরিয়া হয়ে আমাদের ধাক্কা দিয়ে যায়। বার বার চীৎকার করে বলে, – ভুলে যেও না, মনে করো, মনে রাখো! সেইমতো কাজ করো!

আশ্চর্যের বিষয় এই যে এদেরকে আমরা সমাজবিরোধী বলে দাগিয়ে দিই। স্থাবর হয়ে থাকা যেন আমাদের মুদ্রাদোষ, বদল যে প্রাণের প্রথম শর্ত সেকথা আমরা যেন ভুলে গেছি।

এখন দেশে ইউনিফর্মিটির ধুম উঠেছে। ইউনিটি আর ইউনিফর্মিটি এক কথা নয় – এটা সবাই ভুলে যাচ্ছে। এমনকী যারা টিভি দেখে তারাও মিস করে গেছে, – দেওয়ালের এপারে যারা তারা কেউ কারোর মতো নয়, কারণ তারা এখনো জ্যান্ত। আর ওপার থেকে যারা আসছে, তারা সবাই এক, ইউনিফর্ম, তাদের কোনো বিকার নেই বিভেদ নেই কিচ্ছু নেই। এই ইউনিফর্মিটির মুখোমুখি দাঁড়াতে গেলে ইউনিটির খুব দরকার। টিভির গল্পে পরের সীজনের দেরী থাকতে পারে। কিন্তু এখানে আমাদের হাতে আর খুব বেশী সময় নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *