ফাইনম্যানদাদা আসল খবর রাখত।
দাদার যখন অল্প বয়স, বছর দশেক হবে, – একদিন এক বন্ধু এক পাখি দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, বল তো ওটা কী পাখি? ফাইনম্যান বলল – জানিনাতো। সেই শুনে বন্ধু বলল, এঃ, জানিসনা? ওটা হল ব্রাউন-থ্রোটেড থ্রাশ। তোর বাবা তোকে কিচ্ছু শেখায় না। — কিন্তু ফাইনম্যান জানত, বাবা তাকে আসলে যা শেখানোর সবই শেখায়। বাবা একদিন একটা পাখি দেখিয়ে তাকে বলেছিল, – ওটা কী পাখি জানিস? ওটা হলোগে স্পেনসার্স ওয়ার্বলার। — ডাহা গুল কিন্তু। বাবা আদৌ জানে না পাখিটার আসল নাম কী। কিন্তু নাম না জেনেও বাবা বলে চলে – ইটালিয়ানে ওর নাম হল চুত্তো লাপিত্তিদা, বুঝলি। পর্তুগীজে ওকে বলে বম দা পেইদা। চীনা ভাষায় ওর নাম চুং-লং-তা, আর জাপানীতে কাতানো তেকেদা। বুঝলি সব? কিন্তু দুনিয়ার সব ভাষাতেও ওই পাখির নাম তুই জেনে ফেলিস যদি, তাও দেখবি শেষমেষ পাখিটার ব্যাপারে তুই কিছুই জানলি না। বরং তার চেয়ে পাখিটাকে দ্যাখ, পাখিটা কী করে তাই ভালো করে দ্যাখ। ওটাই আসল। নামে কিছুই আসে যায় না। একটা জিনিসকে জানা, আর একটা জিনিসের নামটুকুকে জানা – এদুটো এক কথা না।
এই জন্য বললাম, ফাইনম্যানদাদা আসল খবর ঠিক রাখত। আত্মজীবনীতে, একদম শুরুর দিকেই – যাতে ভবিষ্যতের অ-পাঠক সমাজও প্রথম কয়েকটা পাতা পড়তে গিয়ে ভুল করে ওটুকু পড়ে ফ্যালে – বড় বড় করে ঘটনাটা লিখে রেখেছিল।
কিন্তু বিরাদর-এ-মন, জানো তো কবি গেয়েছেন – ‘শোন গো জগদানন্দ দাদা, গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব, অশ্বে পিটিলে হয় যে গাধা।” মানবজাতি স্বভাবতই গাণ্ডু। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে সমঝদার করবে এমন কোনো পয়গম্বর আজ অবধি ত্রিসংসারে পয়দা হয়নি। আমাদের বাপ আদম ছিল গাণ্ডুসম্রাট, – সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলেছে।
যারা হাঁ করে বসে আছে, থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার লাগবে বলে, তাদের সখেদে জানাই, – আশা নাই। আপনারা ভাবছেন আবার বোম্বা-খোম্বা নিয়ে দুমদাম করে মহাযুদ্ধ লাগবে? বিচ্ প্লীজ! দেখুন, উনিশ শতকের যুদ্ধ একরকম ছিল, বিশ শতকে সেই যুদ্ধের মডেল পালটে গেছিল। একবার না, অন্তত দু’তিনবার। একুশ শতকে সেই মডেল আবার পালটেছে। যাঁরা কামান-মিসাইল ওয়ালা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখার জন্য বসে আছেন, ওর দেখা পাবেন না। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অলরেডি চলছে, ওয়ার ক্যাজুয়ালটি হিসেবে হাজার হাজার অলরেডি মরছে, নতুন বিশ্বযুদ্ধের আওয়েন-স্যাসূনরাও অলরেডি রক্ত দিয়ে লিখে চলছেন একুশ শতকের অ্যানথেম ফর ডুমড য়ুথ। ধাঁধা লেগে আছে আপনাদের চোখে, ধাঁধা লেগে আছে আমাদের চোখে, চোখ খুলুন, চোখ খুলে দিন আমার, আপনার, তাকান, দেখুন, দম নিন, জানুন আপনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণপণে বেঁচে আছেন একটিবার মরার অপেক্ষায়।
দেখুন, জানুন, ঢোঁক গিলুন, স্বীকার করুন আপনি যুদ্ধবন্দী, মেসেজ করুন মধ্যরাত্রে হোয়াটস্অ্যাপ সঙ্গীকে, খুঁজুন ইঁটের ভিড়ে আপনার পছন্দসই নেসেসারি ঈভিল, নতুন কিছু নয় জেনেও ওয়ালে শেয়ার করুন ওই গানটার ভিডিও যেটা আপনার বোবা জবানিটুকু সাড়েচারমিনিটে নিখুঁত বলে দেয়, আদর করুন নিজের ভাঙাচোরাকে, স্নান করুন নিজের নিরর্থকতায়, পালকের মতো হাল্কা হয়ে ভাবুন আপনার আর কোনোদিন কোনো মুক্ত হওয়ার দায় নেই।
আপনি যুদ্ধ দেখার জন্য বসে আছেন। না। আপনি ‘যুদ্ধ’ দেখার জন্য বসে আছেন।
ধোঁয়াটে হয়ে যাওয়া অয়েল পেন্টিংএর তরোয়াল, কামান। সেপিয়া আর সাদাকালো ছবির পোড়াদেহ, ছাই শহর। রক্তে-কাদা ট্রেঞ্চ, বেয়নেট, পুঁজ। — নাঃ, এই ড্রামাটিক যুদ্ধ এখন রিয়্যাল লাইফের চেয়ে ফিল্মে আর প্রোপাগাণ্ডাতেই বেশী প্রফিট দেয়। দেশে-দেশে যুদ্ধ লাগা অবসোলিট হয়ে গেছে। ন্যাশনালিজম খুব খারাপ বলে আফসোস ছিল না আপনার? জেনে খুশী হবেন যে ন্যাশনালিজম ইজ ডেড। এখন শুধু ইন্টারন্যাশনাল অলিগোক্র্যাসি।
বর্ডারগুলো রাখা হয়েছে কারণ ওই লোকগুলির তাতে কারবার করতে সুবিধা হয়। আমাদেরও ব্লকবাস্টার এনজয় করতে সুবিধা হয়। কেন জানেন, কারণ এই যুগে সবাই উইনার। যে হারে সেও ‘লাস্ট উইনার’। এ হল পজিটিভিটির যুগ। আপনি মরে যেতে পারেন কিন্তু বাজি রেখে বলা যেতে পারে যে ইউ উইল এনজয় ডেথ।
এতক্ষণে এসে বোঝা যাচ্ছে যে পোস্টটা আর ঠিক সবার কাছে কোহেরেন্ট নেই। ভেরী গুড। গ্রেট আর্টের লক্ষণ। এখন থেমে গেলে সেটা ক্রাইম।
এই যে ধরা যাক স্কুল। নামে ‘স্কুল’ আছে বলেই কি আর সত্যি সত্যি স্কুল আছে? স্কুল স্কুল গন্ধ আছে, ঘরবাড়িগুলো স্কুলের মতো, বইখাতাপেনসিলটেপ সব ইতিউতি, বাচ্চারা ঘরে ঘরে, চক ডাস্টার রেজিস্টার সবই আছে। কিন্তু আরও আছে, কারণ আপনি চেয়েছেন। নাচ, গান, ক্রসওয়ার্ড, ফোটোগ্রাফি, কীবোর্ড, থ্রিডিপ্রিন্টিং, আর্ট, দাবা, ইলোকিউশন, পাবলিক স্পিকিং, রিসাইটেশন, থিয়েটার, আই.টি., যন্ত্রসঙ্গীত, রীডার্স ক্লাব, দুর্বলদের জন্য কোচিং, সবলদের জন্য কোচিং, সবরকম বলদের জন্য ১০০% পার্টিসিপেশন একজিবিশন প্রোজেক্ট প্রেজেন্টেশন স্পেলবী ওয়ার্কশিট আর্টপেপার হাতেরকাজ তুলোর পেঙ্গুইন থার্মোকলের আগ্নেয়গিরি কাগজের ফুল – নির্ভুল, নির্ভুল। কারা করায়? না ওই টীচাররাই করায়। তাহলে কারা পড়ায়? কেন ওই টীচাররাই পড়ায়? শিক্ষকরাই জাতির কারিগর, জানেন না? কতো দায়িত্ব তাঁদের??
দিয়ে দেখা যায় যারা বেরোল, যারা হঠাৎই আর ঠিক “১০০% পার্টিসিপেশন” জিনিসটা দুনিয়ার বুকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। কোথাও জায়গা নেই। জায়গা তো ছিল। ভরে গেছে যে।
‘আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’
নামে ভুলবেন না। নাম এক থাকলেও নামের আড়ালের জিনিস বদলে যায়। আপনিই কি বদলাননি, বলুন?