মশারি ব্যাপারটা অনেকটা দুর্গের মতো। দুর্গ থাকলেই যে সুরক্ষা সুনিশ্চিত তার কোনো মানে নেই, ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়, এমনকি স্ট্র্যাটেজি ঠিক রাখতে হয়। অঞ্জনদার মশারি পড়ে অনেক কথা মনে পড়ল। আমিও আর এক হস্টেল ভেটেরান। বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপে নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মশারি ওয়ারফেয়ারে অভ্যস্ত। জার্নাল থেকে খানিক তুলে দিই।
মশারির একটা ক্রিটিকাল বৈশিষ্ট্য হল তার ঝুল। জালি-জালি দেয়ালের নীচের দিকে যে কাপড়ের পাড় দেওয়া অংশটা, তার উচ্চতার ওপর নির্ভর করে মশারি ভালো করে গোঁজা যাবে কি না। যদি ঝুল কম হয়, তাহলে তোষকের নীচে মশারি সুগভীরভাবে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যাবে না, – রাতে যদি বেমক্কা হাত ছুঁড়ে মশারিতে লাগে তাহলেই ফুস। গোঁজা খুলে গিয়ে মশারির নিম্নভাগে ফোঁকর তৈরী হবে এবং তাই দিয়ে উদ্ভিন্নযৌবনা মশকীরা দলে দলে আপনাকে সঙ্গ দিতে ছুটে আসবে। ট্রাস্ট মী ইটস নট রোমান্টিক।
কাজেই পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে ক্লাস ফোরে ভর্তি হওয়ার প্রথম বাজার যখন করছিলাম, ট্রাঙ্ক-তোষক-বালিশ-বাক্স ইত্যাদির জন্য, তখন মশারি কেনবার বেলায় বাবা দেখেশুনেই নিয়েছিল যাতে গ্রাসরূট লেভেল ঠিকঠাক থাকে। আমার মশারি ছিল সাদা। এরও অনেক কার্যকারণ আছে, পরে বলছি।
পুরুলিয়ায় মশারি টাঙানোর প্রধান অ্যাকসেসরি ছিল T-স্ট্যান্ড।
আমাদের সিঙ্গল খাটের শিয়রের দিকে থাকত শেল্ফ, নিজেদের জিনিস রাখার জন্য। সেই শেল্ফের দুই দিকে দুটো হুক দেওয়ালের সাথে লাগানো, – মশারির নর্থ এন্ডের দুই মাথা আটকাবে এই দুই হুকে। পায়ের দিকে, খাটের সাথে করে লাগানো থাকত দুটো আয়তাকার লোহার আংটা। একটা ওপরে, একটা তার নীচে, – ফুটখানেক দূরত্ব। এই আংটার মধ্যে দিয়ে গলানো হত একটা কাঠের বড় T, – আমাদের পরিভাষায় T-স্ট্যান্ড। এই T-র দুই মাথায় খাঁজ কাটা থাকত, তাতে মশারির বাকি দুই কোণা আটকে দিতে হত। বিনা গিঁটের এই মশারি টাঙানো ভালোই ছিল আমাদের। পরে অবশ্য যখন একটু বড় হই, তখনকার হস্টেলে T-স্ট্যান্ড থাকত না, ঘরে টাঙানো কাপড়ের তারেই মশারির দড়ি বেঁধে নিতাম।
মশারির দড়ি হবে ছিমছাম, নির্মেদ, যথাসম্ভব আঁশবিযুক্ত। কারণ, বলে লাভ নেই মশারি টাঙানো একরকম ক্লেশবিশেষ। রাত বারোটা অবধি আড্ডা মারার পর, যখন সোজা শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে কিন্তু মশারি না টাঙালে মৃত্যু অবধারিত, তখন কোনোমতে স্যাটস্যাট দড়ি বেঁধে তো কাজ সেরে দেয়া গেল। পরদিন সকালে ঘুমচোখে যখন সেই মশারি খোলা হয়, তখন আর চোখ বা হাত কিছুই ঠিকমতো কাজ করে না। সিদ্ধি-খাওয়া গোরিলার মতো হ্যাঁচকা মেরে দড়ি খোলার চেষ্টা হয়, – তাতে দড়ি কখনো পটাং করে ছিঁড়ে যায়, কখনো ভুল দড়িতে টান লেগে ফাঁস বসে গিয়ে গিঁট পড়ে যায়। তখন পিটিপিটিয়ে আধবোজা ধাঁধিয়ে-যাওয়া চোখে সেই গিঁট খোলা, নরকযন্ত্রণা। ফ্যাসফেসে পাটের দড়ি হলে এসব সময়ে আর রক্ষা থাকে না। শেষে বিরক্তিতে টান মেরে দড়ি ছিঁড়ে ফেলতে হয়। কাপড়ের তারে জমে দুর্বল দোআঁশলা রজ্জুগ্রন্থি।
রামকৃষ্ণ মিশনের ছাইত্র বইল্যা কথা, একটু আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকলে এইসব অসুবিধা সামাল দেওয়া তেমন বড় ব্যাপার না। জটিলতর কিছু বিষয় আছে।
সেই যে একজন লোক ছিল, যে মশাদের বোকা বানানোর জন্য এক দারুণ ফন্দি করেছিল। মশারি না গুঁজে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে আছে। জিজ্ঞেস করাতে কুটিল হেসে বলল, – ‘সব মশাগুলো ঢুকুক, তারপর ওদেরকে মশারির ভিতর আটকে আমি বাইরে শোব।’ – বোধকরি এই অনামা মহাপুরুষের নাম চাণক্য আর মেকিয়াভেলির পরেই থাকা উচিত। সমস্যাটা অতি বাস্তব। মশারির ভিতর ঢোকার পরেও যদি আবার বাইরে বেরোতে হয় – কারো কারো হয়ই, আলো নিভিয়ে মশারির ভিতরে ঢুকে বালিশে মাথা দেবার পরেই একবার বাথরুম পায় – তাহলে সেই ফাঁকে কিছু মশা ঢুকে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এটা মশারির ড্রব্যাক। অসাধারণ ক্ষিপ্রতা এবং দৃষ্টিশক্তি না থাকলে এর থেকে পার পাওয়া অসম্ভব। এবার মশারিতে পুনরায় ঢুকে আপনি শয্যা নিলেন, খানিক পরে একটা ঘুমঘুম ভাব এমন সময় আপনার কানের কাছে এসে পুনপুন করতে লাগল। বা হাতের ওপর আচমকা তীব্র শুণ্ডস্ফুটন। এর চেয়ে বেশী মাথাগরম করা জিনিস জীবনে কমই আছে। আপনি তারপর আবার মশারি থেকে বেরিয়ে আলো জ্বেলে আবার মশারির ভিতর ঢুকে (নোট হাউ দে ইউজ ইউ এগেইনস্ট ইওরসেল্ফ, দোজ ইনফারনাল ইনসেক্টস) মশা খুঁজতে লাগলেন। এইবারে আপনার মশারির রঙ একটা বড় ভূমিকা নেবে। যদি মশারির রঙ সাদা হয়, তাহলে কৃষ্ণকায় মশার শরীর আপনি খুঁজে পাবেন সহজে। অ্যানোফিলিস হলেও। একটু গাঢ় রঙ হলে ওদের লুকোতে সুবিধা। সাদা হলেও যে পাবেন তার কোনো মানে নেই, মশারা নিনজা হয়। ওরা বোঝে যে ইনভিজিবিলিটি ইজ আ ম্যাটার অফ পেশেন্স অ্যান্ড অ্যাজিলিটি। যাইহোক তারপর আপনি মশাটশা মেরে আবার আলো নিবিয়ে শুতে যাবেন এবং সেই ফাঁকে আবার … মানে যা হবার হবেই, আপনি ঠেকাতে পারবেন না।
এই মশারিতে ঢোকা প্রসঙ্গে, – পুরুলিয়ায় থাকতে দেখতাম, কিছু মণিপুরী বন্ধুদের একধরনের দারুণ শৌখীন মোলায়েম মশারি থাকত, তার গায়ে আবার আলাদা দরজা থাকত। কীভাবে ঠিক সেটা কাজ করত, কোনোদিন জেনে নেওয়া হয়নি।
সাদা মশারির কার্যকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু রঙীন মশারির মাহাত্ম্য কিছু কম নয়। নরম মশারির গায়ে ফুল-লতা-পাতার কারুকাজ, উজ্জ্বল গোলাপির ওপর গাঢ় সবুজ পাতার নকশা – জানলা দিয়ে এসে পড়া নিঝুম চাঁদের আলোয় এক অপূর্ব মায়ালোকের সৃষ্টি করে। সেই অ্যাপীল মোটেই ফেলনা নয়। তেমন তেমন বাহারি মশারি দেখলে আপনি লোভ সামলাতে পারবেন না, সুন্দর শাড়ীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমার তো মনে হয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে মশারির ভালোরকম পোটেনশিয়াল আছে। বিশেষ করে এই গরমে, সুতির মশারি দিয়ে তৈরী জামা কী অসাধারণ আরাম হবে ভাবুন তো?
হস্টেলে যারা থাকে তাদের যে বাড়ি থেকে সাধারণত রঙীন মশারি দেওয়া হয়, তার একটা অন্য বড় কারণ আছে। নরেন্দ্রপুরে যখন পড়ি তখন আমাদের হস্টেল-অনুশাসনলিপিতে সত্যদা একটা পয়েন্ট রেখেছিলেন – “মশারি নোংরা রাখবে না, নিয়মিত কাচবে। তোমরা মশারি প্রায় কাচ না।”এই পয়েন্ট প্রমাণ করে, হস্টেল চালানোর ব্যাপারে সত্যদা কত অভিজ্ঞ ছিলেন। মশারি কাচা ব্যাপারটা হস্টেলে আমাদের ছিল না বললেই হয়। তার কারণও আছে। হস্টেলের বাথরুমগুলো সবই গণ-বাথরুম হয়। তাতে বড় বিছানার চাদর, মশারি – এইধরনের কাপড় কাচার উপযুক্ত পরিসর থাকে না। অতবড় জিনিস কেচে শুকোতে দেওয়ারও জায়গা থাকে না হস্টেলের করিডোরে টাঙানো সার সার তারে। আমরা জামাকাপড় বিছানার চাদর সবকিছু হপ্তায় হপ্তায় ধোপাবাড়ি পাঠাতাম, সেরকমই নিয়ম ছিল। এবার ঘটনা হল, সব কাপড়ই দু-সেট কী চার-সেট করে থাকত আমাদের, ধোপার কাছে এক সেট যেত, অন্য সেট দিয়ে আমরা চালাতাম। কিন্তু মশারি তো সাকুল্যে একটাই। তাকে ধোপায় দিলে হপ্তাভর যাব কোথায়, খাব কী? কাজেই ওটা থাকত। বাবা-মায়েরা এটা বিলক্ষণ বুঝতেন, তাই সাদা মশারি না দিয়ে হলুদ-আকাশী-গোলাপী রঙের মশারি দিতেন, যাতে ময়লা হলে সহজে বোঝা না যায়।
আমার সাদা মশারি পুরুলিয়ায় ক্লাস ফোরের শিবানন্দ সদন থেকে নরেন্দ্রপুরে বি.এ.-র ব্রহ্মানন্দ ভবন অবধি আমার সাথে ছিল। যখন এইটে পড়ি, নীল মার্কার কলম দিয়ে মশারির সাদা ছাদে একদিন এঁকেছিলাম এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোটো-বড়ো পাঁচমাথা তারা, তার মাঝ দিয়ে লেখা ‘টুইংকল টুইংকল লিট্ল স্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর…’। মশারির চাঁদোয়ার তলায় শুয়ে যখন রাতে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তখন মাথার ওপর জেগে থাকত সেই আকাশ-করা-ছাদ। হাত বাড়িয়ে ছুঁতাম কখনো বা।
এখন তো আকাশ অনেক দূরে চলে গেছে।