এক কাঠুরে ছিল। একদিন সে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে এক গাছের কোটরে একটা পুরোনো প্রদীপ পেল। কাঠুরের কাছে গামছা ছিল, প্রদীপটা সেই গামছা দিয়ে মুছতে যাবে, অমনি সেই ঘষা লেগে প্রদীপের ভিতর থেকে এক জীন বেরিয়ে এল।
– হুহু হাহা হাহা হাহা! হাম প্রদীপ কা দৈত্য হ্যায়। কী ফরমায়েশ আছে, বলো!
গরীব কাঠুরে হঠাৎ এইসব জীন-টিন দেখে প্রথমে অজ্ঞানমতো হয়ে গেছিল। জীন ঘাঁক করে এক গর্জন ছাড়তে সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
– আমার আমার খিদে পেয়েছে। আমার কোঁচড়ের মুড়ি এই দেখুন সব পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি একটু মু-
– খামোশ! মুড়ি খাকে কেয়া হোগা? হাম প্রদীপ কা দৈত্য হ্যায়, আমার সাথ মে ইয়ার্কি পায়া হ্যায়? বিরিয়ানি মাঙ্গো।
– বি বি বিরিয়ানি? আ আচ্ছা
যেই না বলা, অমনি ধাঁ করে কাঠুরের সামনে এক রূপোর রেকাবিতে করে আসল মোগলাই বিরিয়ানি চলে এল। কী তার গন্ধ, কী তার চেহারা! – কাঠুরে সেই বিরিয়ানি খেয়ে শেষ করতে পারল না।
এতক্ষণে তার খুব তেষ্টা পেল।
– একটু জল হবে ভাই?
জল চলে এল।
কাঠুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে জীন বলল – হু হু হা হা হা, আভি কেয়া করনা হ্যায় ফরমায়েশ করো।
কাঠুরে মাথা চুলকে বলল – বাড়ি যাবো।
চোখের পলক পড়তে না পড়তে কাঠুরে দেখল সে তার কুঁড়েঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
পেছন থেকে জীন বলল – এখন কী করব, শিগগির বলো।
কাঠুরে খুব গরীব ছিল আর দেখতেও খুব বিতিকিচ্ছি ছিল, তাই তার কোনো বউ ছিলো না। সে তাই এবার বুদ্ধি করে বলল – আমাকে ফর্সা করে দাও।
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর খেয়াল হতে কাঠুরে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল, হ্যাঁ, সে ফর্সা হয়ে গেছে।
– আভি কেয়া করেঙ্গে, জলদি বলো।
কাঠুরে এতক্ষণে মোটামুটি মোশনে চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি বলল – আমাকে একটা বড়ো রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি করে দাও। আর বাড়ির ভেতরে একটা বাক্সে, না বাক্সে না, একটা সিন্দুকে মোহর ভরে দাও।
পেছনে ধাঁশ ধাঁশ করে দু’টো আওয়াজ হল, কাঠুরে না থেমে বলে চলল – বাড়ির মাঝখানে একটা সুন্দর ফুলবাগান, আর পিছনে একটা ভালো ফলবাগান করে দাও। একপাশে একটা গোয়াল করে দাও, তাতে অনেকগুলো ভালো গরু দিও। ওই পিছনদিক করে একটা পুকুর করে দাও। আর পুকুরটা বাঁধিয়ে দাও।
মুখ থেকে কথা ফেলতে না ফেলতে জীন সব কাজ করে ফেলে, তাই যতক্ষণে কাঠুরের কথা থামল, ততক্ষণে তার বাড়িঘরপুকুরবাগান সব কমপ্লিট হয়ে গেছে।
কাঠুরে বেশ একটা গদগদ ভাব নিয়ে নতুন বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু পেছন থেকে আওয়াজ এল – অ্যাই, কাঁহা যাতা? এখন কী করব, বলো!
কাঠুরে বলল – হে হে আর কী করবে ভাই, আমি যাই একটু পুকুরে নেমে আসি।
জীন খাজা কাঁঠালের মতো মুখ করে বলল – না! আমার কাজ চাই! এক্খুনি কাজ দাও!!
কাঠুরে আবার একটা ‘হে হে’ করতে যাচ্ছিল, জীন এক ধমক মেরে তাকে থামিয়ে দিল। – কাজ দে বলছি কেঠো ছুঁচো, নাহলে তোর মাথাটা এবার ছিঁড়ে নেব!
কাঠুরের মনে হল, ব্যাপারটা কেমন একটা যেন হয়ে গেল। কিন্তু সামনে জীন দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাই কিছু কাজ দিতে হয়। কিন্তু তার যা যা চাওয়ার ছিল সবই তো পেয়ে গেছে, এবার কী চাইবে?
যা দরকার সব পেয়ে যাওয়ার পর মানুষের যা যা চাইবার বাকি থাকে, সেগুলো সাধারণত একটু গোলমেলে ধরনের হয়। কাঠুরে এখন ফর্সা হয়ে গেছে, তাই হঠাৎ করে যে তার কান লাল হয়ে আসছে সেটা জীন স্পষ্ট দেখতে পেল। জীন কিছু কচি খোকা নয়, তার বয়স কম করেও কয়েক হাজার বছর। সুতরাং সে কাঠুরের এই তুতুপুতু মোটেই সহ্য করল না।
– নখরা না করে বলবি, না থাপ্পড় খাবি?
এখানের কিছু অংশ আমাদের আলোচনা না করাই ভালো।
কাঠুরের বিরাট বাড়ির অন্দরমহল থেকে একটা মৃদু ‘ধাঁশ’ আওয়াজ এলো। কাঠুরে ব্যাকুলভাবে সেই দিকে তাকিয়ে বলল, – বাবা, এবার আমায় যেতে দাও? আর কী চাইব, সবই তো হয়ে গেল!
জীন পাথরের মতো গলায় বলল – এখন কী করব বলো। না বললে মরার জন্য তৈরী হও।
কাঠুরে বলল – আর তো কিছু কাজ নেই বাবা! সবই তো তুমি গুছিয়ে দিয়েছ। এবার তুমি নিজে যা খুশী কর না বাবা!
জীন কাঠুরের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল – এখন কী কাজ দেবে বলো। না বললে মরার জন্য তৈরী হও।
কাঠুরে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল – তুমি তো এত উপকার করলে বাবা! এবার আমাকে ছেড়ে দাও! তুমি তো আমি যা বলি তাই শোনো! এখন কেন এরকম ভয় দেখাচ্ছ! তুমি এখন চলে যাও!
জীন ভয়ঙ্কর গলায় বলল – আমি প্রদীপের দৈত্য। আমি সবসময় প্রদীপের মালিকের সব আদেশ মেনে চলি। কিন্তু প্রদীপের মালিক যদি আমাকে কাজ না দেয়, প্রদীপের মালিক যদি আমাকে ভয় না পায়, তাহলে সেই মালিককেই ধরে আমি মেরে ফেলি। – আমাকে কী কাজ দেবে বলো। না বললে মরার জন্য তৈরী হও।