Lies are a man’s greatest friend.
এটা এখন আমার প্রায়ই মনে হয়। সবসময়ই তো ওর আশ্রয়েই আছি। ট্রেনে আসতে আসতে ভাবছিলাম যদি কেউ ভাবে, যে যুধিষ্ঠিরের মতো শুধু সত্যিই বলবে এক দিন, তাহলে কেমন হবে। – এই আগের লাইনটা টাইপ করতে গিয়ে খেয়াল হল, সবাই বলে ‘যুধিষ্টির’। ঠিক উচ্চারণ প্রায় কেউ করে না।
যাই হোক, যদি কেউ ভাবে, যে সারাদিন মিথ্যের মধ্যে যাবে না, শুধু সত্যি বলবে। কেমন হয়। ভাবতে গিয়ে অবধারিতভাবেই নিজেকে দিয়েই ভাবতে লাগলাম। যে আমি যদি এটা চেষ্টা করি, কোথায় কোথায় আটকাবে। এটাও ভাবছিলাম যে এই নিয়ে ফেসবুকে একটা স্টেটাস দেবো। মানেই সেটা একটা বেশ পড়ার মতো করে লিখতে হবে। মানে সেটা একটা ‘লেখা’ হবে। আর সেই লেখার একটা প্রধান মশলা হবে, যা দেখা যাচ্ছে, আমার নিজের কথা।
মনে পড়ল একটা লাখ টাকা দামের কথা যা কিছুকাল আগে আমি পড়েছি। তুমি যদি পাকা লিখিয়ে না হও, সবে লেখার দুনিয়ার আসতে চাইছ, এখনো পোড়-খাওয়া কলমবাজ হওনি – এমন যদি হয়, তাহলে মনে রাখবে যে তোমার কিন্তু সম্বল কিছুই নেই; তোমার পাঠককে দেবার মতো স্টাইল, স্কিল, উইজডম, এইসব সেরকম কিছুই নেই, তুমি নেহাত নভিস। তোমার মূলধন একটাই, এক-টাই। তা হল তোমার নিজের জীবন। সেই জীবন তোমাকে ধরে তুলে দিতে হবে পাঠকের হাতে। পাঠকের মুখে। এ ছাড়া শুরু নেই।
কাজটা সহজ না। নিজের জীবন কি সোজা কথা? নিজের জীবন সবচেয়ে স্পর্শকাতর ব্যাপার। পালক না-ফোটা পাখির বাচ্চার বুকের মতো গরম, দপদপ করতে থাকা একটা জিনিস। কেউ তার নাগাল অন্যেকে দেয় না। একটা আবরণ রাখে, পর্দা রাখে। মর্ম ঢাকতে বর্ম। এই বর্মের উপাদান হল মিথ্যা। নিজের সবচেয়ে ভঙ্গুর, ঠুনকো জায়গাগুলো ঢেকে শুধু ভালো ভালো, বলিষ্ঠ অংশগুলো মানুষ জগতের সামনে সাজিয়ে ধরে রাখে। এ না হলে সমাজ থাকত না।
কাজেই, সেইরকম বাজারে সবসময়েই দেখছি বাড়িতে-বাইরে সবসময়েই দেখছি এমন জীবনের ছবি আমাদের চাই না, একজন লিখিয়ের কাছে থেকে আমরা চাই তার বেশী কিছু। আমরা এটাই চাইব যে সেই বিশেষ ছবিটায় বর্ম না থাকুক। আসলটা থাকুক, যতটা সম্ভব। সত্যি থাকুক। আর সেইজন্যেই কাজটা কঠিন। কারণ আমরা সবাই ওইভাবে বাঁচি না, যে সত্যিটাকে প্রকাশিত করব। আমরা ঢেকেঢুকে বাঁচি।
যদি সবাই নিজের জীবনকে নগ্ন করে নিখাদ সত্যিটাকে প্রকাশ করত, তাহলে বোধহয় সবাইই সাহিত্যিক হতে পারত। কাঁচা ডায়েরী যে কোনো লোকেরই – যে সেইভাবে ডায়েরী লেখে – যদি ছেপে বেরোয়, তার একটা আকর্ষণ থাকবেই। সেইভাবে প্রকাশটাই সবাই পারে না। সেইজন্যে ঘুরিয়ে বলা যায়, লেখা বেশ সাহসের কাজ।
কিন্তু যা হচ্ছিল, যুধিষ্ঠিরের মতো যদি আমি একটা দিন কাটাতে যাই, কী হবে।
সব সত্যি বলতে হবে, মানে মিথ্যে বলা যাবে না। কোন্ কোন্ ব্যাপারে এমনিতে আমরা মিথ্যের আশ্রয় নিই ভাবা যাক। একটা হল – কারুর ওপর খুব রাগ বা বিরক্তি হচ্ছে, বিচ্ছিরি রকম মাথা গরম হতে চাইছে, কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলি না। মানে রাগটা দমন করছি এমন না। মনে মনে গালি দিচ্ছিই। কিন্তু মুখে বলছি না। এটা একরকম দৈনন্দিন মিথ্যে। আর কী? লোককে সামনাসামনি ভালো বলতে কারো তেমন আটকায় না, খারাপ বলতেই আটকায়। ভালো বলতে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে আটকায়, যেমন যদি কাউকে বেশ পছন্দ হয়, মেট্রোয় একটা ছেলের একটা মেয়েকে দেখে ভালো লাগল। সেটা কিন্তু বলা যাবে না। তাহলে প্রেমজ আকর্ষণ বা কামজ আকর্ষণ হল আরেকটা ক্ষেত্র, যেটায় আমাদের মিথ্যে বজায় রাখতে হয়। এখানে বলি যে মিথ্যে বলতে আমি ঠিক কী বোঝাচ্ছি। The truth, the whole truth, and nothing but the truth নয় যা, তাকেই মিথ্যে বলছি।
অর্থাৎ, যেটা বলছি সেটা সত্যি হতে হবে; এবং আধা সত্যি হলে হবে না, গল্প অর্ধেক বাকি রেখে দিলে চলবে না, পুরোটা বলতে হবে; মানে ‘রাম আমাকে মেরেছে’ বলে চুপ করে গেলে চলবে না, ‘আমি রামকে গালি দিয়েছিলাম তাই রাম আমাকে মেরেছে’ – এটা পুরোটা বলতে হবে। আর সত্যি বলে তার পিছনে হালকা মিথ্যের লেজুড় লাগালেও চলবে না। সত্যিটুকুই, ব্যস। কেবলমাত্র সম্পূর্ণ সত্যিটা নিখুঁতভাবে পেশ করলে তবেই সেটাকে আমি ‘সত্যি’ বলছি।
এই হিসেবে মুখে-একরকম-মনে-একরকম হওয়াটা অবশ্যই মিথ্যাচার। তার মানে এই না যে যা মনে হবে দুম করে তাই করতে হবে। মনে যদি সত্যিই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলে তাহলে মুখে সেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য ব্যাপারকে আনার দরকার নেই। মানে আমার মাঝেমাঝে যদি মনে হয় যে জিলিপি চুরি করব, তার মানেই কি আমাকে চুরি করতে যেতে হবে? তা না, কারণ আমি নিজেই ভেবেছি যে নাঃ, চুরি করব না। যদি এমন হয় যে আমি চুরি করতে চাই, একদম চাই, পেলেই করব, করছি না বটে কিন্তু পারলেই নির্ঘাত করব – তাহলে আমি চুরি করি আর নাই করি আমি চোর।
এখানে একটা ছোট প্যাঁচ আছে। সরাসরি সম্পর্ক হয়তো নেই, কিন্তু অ্যাসোসিয়েশন অফ আইডিয়াজ। আমার জীবনে যে কয়েকটা মূল কোডেক্স আছে, তার মধ্যে একটা বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ বলেছেন অভী হও। মানে ভয় ছাড়ো। কোনো কাজ করতে ইচ্ছে হলেই করতে নেই, তার ভালোমন্দ বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র ভয়ের কারণে কোনো কাজ থেকে পিছিয়ে গেলে চলবে না। যদি ভয় ছাড়া অন্য কারণ থাকে, কাজটা না করার, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আমার একটা কাজ করতে ইচ্ছে, সেটা করছি না তার একমাত্র কারণ হল আমি সেটা করতে ভয় পাচ্ছি, তাহলে বিবেকানন্দের অনুসারী হিসেবে আমার অবশ্যই সেই কাজটা করা উচিত। আর কিছু না হোক ভয়টাকে ছাড়ানোর জন্যেই।
যেমন, আমি পোকামাকড়ে আগ্রহী। কিন্তু আমি বরাবর প্রেয়িং ম্যান্টিস বা গঙ্গাফড়িং ধরতে ভয় পাই। কোনো কারণ নেই, আমি বহুবার অন্যেদের দেখেছি ধরতে, নিরাপদে নাড়াচাড়া করতে, জানি যে বিপদ কিছুই নেই সেরকম, বড়জোর আঁচড় দিতে পারে হয়তো। আমার না ধরারও কোনো কারণ নেই, কারণ আমি পোকামাকড় ধরে কোনো আঘাত দিই না, চোট না দিয়ে আমার সাধ্যের মধ্যে যতটা পারি দেখে-টেখে আবার ছেড়ে দিই ভালো জায়গায়। আমি গঙ্গাফড়িং ধরি না কারণ সাহস পাই না। ওই বিশাল ফোলা পেট আর বড় ডানা আর ওই হাতকরাত বাগিয়ে বসে থাকা – ওটা দেখলেই আমার ভয় হয়, যেটার কোনো মানে নেই। কাজেই আমার অবশ্যই এই পোকাটিকে ধরা উচিত।
কোথা থেকে কোথায় চলে এলো। তাহলে যুধিষ্ঠিরের মতো একটা দিন কাটাতে গেলে কী হবে?
প্রথমেই তো অনেক লোকের সাথে অসভ্য অসভ্য ব্যবহার করতে হবে। প্রচুর ঝামেলা। ওই এক মিথ্যাকে সত্যি করতে গেলেই যা হবে তাতে আমি হাসপাতাল চলে যাবো মারধর খেয়ে।
অনেক মেকি ভাব-জমানো লোকের মেকি বন্ধুত্ব হারাবো। সেটা এমনিতে বিশেষ ক্ষতি নয়, কিন্তু এই দিনে শুধু আদর্শবাদ দিয়ে তো আর চলে না। কাজেই সেইটাও একটা চাপের বিষয় হবে। আর প্রফেসর বা ভবিষ্যতে বস জাতীয় লোকেদের সাথে সত্যাচরণ করতে গেলে তো একদম ডুবে যাবো। আর আমার কিছু ভীম-অর্জুন মার্কা ভাইও নেই।
আমার নিয়ম অনুসারে, শুধু লোককে তেল না মারলেই হবে না, ঠিক জায়গামতো ধাতানিও দিতে হবে। কাজেই অবস্থা আরোই সঙ্গীন।
এর পরে যদি আবার ওই ‘যে-কমপ্লিমেন্ট-দেওয়া-বারণ’ সেসব দিতে আরম্ভ করি তাহলে তো কী যে হবে সবাই বুঝতেই পারছে। ওরেব্বাপরে বাপ। ফেসবুকে যেসব পেজ-এ লাইক দিতে ইচ্ছে করে তাই-ই সবসময় দেয়া হয়ে ওঠে না, আবার সারাদিন ধরে সর্বসমক্ষে সৎসাহস দেখানো। মাথায় থাক!
মোট কথা যুধিষ্ঠিরের মতো একটা দিন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না। এই যুগে না – সে তো আমি বুঝতেই পারছি। অন্য যুগ হলে বা আমি আরো জোরালো চরিত্রের কেউ হলে কতটা পারতাম তা জানি না। এখন যা দেখছি, শুধু বেছে বেছে নিরাপদ জায়গাতেই সত্যি কথা বলা যাচ্ছে, উপযুক্ত শ্রোতা পেলে তবেই মুখ খোলা যাচ্ছে। এখনও আমি চাকরি পাইনি কোনো। পাওয়ার পরে আরো বাড়বে এসব। কস্ট্যুম পরে কাজে যেতে হবে। কামানো গাল, ইস্তিরি করা জামা, এইসব। কারণ যেসব উচ্চতর চাকরিতে এসব ছোটখাট জিনিস দেখা হয় না সেগুলো আমি পাব না।
আপাতত নাশপাতি খেতে যেতে হবে। এটি আমার বড়ই প্রিয় ফল। মাঝে মাঝেই মনে হয়, যে নাশপাতি চুরি করতে পারলে ভালো হত।