ডিসেম্বরের শেষ। 2014।
2014, মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে একশো বছর পেরিয়ে গেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ মানুষগড়া জিনিস ইতিহাসে আগে আসেনি। হয়তো এসেছে – আমেরিকায় এসে ইউরোপিয়ানদের গেড়ে বসার ঘটনা হয়তো বীভৎসতার দিক থেকে বিশ্বযুদ্ধকে ছাপিয়ে যাবে, কিন্তু এতটা বড় পরিসরে মারামারি কাটাকাটি এর আগে হয়নি। – আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারামারি, কাটাকাটির যুগ পেরিয়ে গোলাগুলি, বোমাবাজির যুগ এলো, যুদ্ধ জিনিসটা সাবালক হল।
বিশ্বযুদ্ধ আসলে একটা ভাবধারার চরম উৎকর্ষের পরিচয় – সেই ভাবের নাম জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালিজমেরই কয়েকশো বছরের ফসল – দ্য গ্রেট ওয়ারস। তাই যুদ্ধ লাগার আগে তরুণ ইংরেজ রুপার্ট ব্রুক উদ্দীপ্ত হয়ে লিখছিলেন – ‘If I should die, think only this of me: That there’s some corner of a foreign field that is for ever England.’ দেশের জন্যে মরলেও তা মহৎ কাজ। আর মরা মানে তো শুধু মরা নয় – যত ক’টা বিদেশিকে সাথে নিয়ে যেতে পারা যায়, সেই চেষ্টা। – কিন্তু এই বোকাটে ধারণা ভাঙল কবিতার হাত ধরেই – দেশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করা পরম গৌরবময় – এই স্লোগানকে ‘গ্রেট লাই’ বলা হল – বললেন ফ্রন্টিয়ারে-লড়া সৈনিকরাই। আর যুদ্ধ যখন থামল – তার আগে উইলফ্রেড আওয়েন বললেন – “All a poet can do today is warn.”
ওয়ার্নিং তিনি দিয়েওছিলেন। বলেছিলেন – আহত বাঘিনীর হিংস্রতা নিয়ে আবার যুদ্ধ ফিরে আসবে। সেটা এসেছিল 1939 সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আর এক সৈনিকের হাত ধরে। ইনিও ব্রুকের মতো তীব্র জাতীয়তাবাদী ছিলেন, যদিও এনার প্রকাশটা আরও অনেক বেশী জোরদার। প্যারিস পীস কনফারেন্সে যখন বিজয়ী রাষ্ট্রেরা জার্মানিকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিল, তখন ইনি হাসপাতালের বেডে সেই খবর পড়ে কাঁদছিলেন। তখনই শপথ শক্ত হয়ে গিয়েছিল – দেশের মাথা উঁচু করে দেবেনই।
তা দিয়েছিলেনও। আজ যদি 1945 সালের ফলাফলটা একটু অন্যরকম হত, তাহলেই উনি সারা পৃথিবীতে হিরো হিসেবে পরিচিত হতেন। তা যে হন না, সেটাও তার প্রতিপক্ষের প্রোপাগান্ডার ফলে। নাহলে – যে ধরনের ভাবধারায় আমরা ডেইলি সাঁতার কাটছি, তাতে ওনার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকাই উচিত ছিল।
কিন্তু এসব হয়নি – বরং মানুষের ‘শুভবুদ্ধি’ এইসব বিশ্বযুদ্ধকে একটা লজ্জাজনক, হানিকর ব্যাপার হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা দিয়েছে। খাতায়-কলমে।
এইসব বলার কারণ হল প্রথমত আমি গাণ্ডু। তাই, জ্ঞান ঝেড়ে কোনো লাভ হবে না জেনেও, রুটি ঠাণ্ডা হতে দিয়ে আপডেট খটাখট করে যাচ্ছি। লাইক-ফাইক পাবার লোভও আছে বোধহয় (What? Honesty sells, bro.)। দ্বিতীয় কারণ হল – চারদিকে ‘দেশ’, ‘স্বদেশ’, ‘দেশপ্রেম’, – এসবের খুব ধুয়ো চলছে। ‘দেশপ্রেম’ আমাদের হাতে একটা দুমুখো কয়েন – যার উল্টো পিঠ ‘বিদেশবিদ্বেষ’। যতই সোনু নিগম ‘Imagine’ রেকর্ড করুন না কেন, মেইনস্ট্রীম ধারা অব্যাহত। রবীন্দ্রনাথ অবধি মুখে ফেনা তুলেও সুবিধে করতে পারেননি, সোনু তো সোনু।
বলিউড থেকে আকছার ‘দেশপ্রেমিক’ সিনেমা বেরোচ্ছে। এবং সবগুলোই খুব সফল হয়। বেশ নৈতিক দিক থেকে উঁচুমানের সিনেমা হিসেবেই কদর পায় কোনো কোনোটা। অন্যদিকে খেলার মাঠে – খেলোয়াড়ী মনোভাবের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে প্রতিপক্ষ দেশের দলকে অপমান করা, তাদের দেশ নিয়ে কুৎসা করা। আমাদের সবাইকে ডেইলি দু’চামচ করে ন্যাশনালিজম খাওয়ানো হয়। এগুলো তারই সুফল।
একটা ধারণা ছিল যে সাধারণ মানুষ সব দেশেই এক, তারা কেউ আসলে অন্য দেশকে ঘৃণা করে না, – সব শুধু গভর্নমেন্টের খেলা। কিন্তু সেটা নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘৃণা বাসা বেঁধেছে অনেকদিন। তাকে সাফ করা দুঃসাধ্য। মানুষের সাধারণ মূল্যবোধ আর নৈতিকতার মধ্যে জড়িয়ে গেছে এইসব ধারণা। জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আর সেইটাই – গভর্নমেন্টের খেলা।