যখন বেশ ছোট ছিলাম, তখন শুনতাম জিনিসটাকে বলা হত ‘এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি’। একটু বড় হতে হতে এই নামটা বদলে হয়ে যায় ‘কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি’। এই বদলটা আসলে একটা সংশোধন, শুধু নামে নয়, যে জিনিসটা নিয়ে কথা হচ্ছে, তা সম্বন্ধে আমাদের ধারণায় একটা বড় ধরনের সংশোধন। কারণ পুরোনো নামটার অর্থ, সিলেবাসের বাইরের কাজকর্ম; আর নতুন যে নাম দেওয়া হল তার অর্থ, সিলেবাসের পাশাপাশি চালাতে হবে এমন কাজকর্ম।
কেন এই ‘অ্যাকটিভিটি’কে বাইরে সরিয়ে না রেখে বিদ্যাভ্যাসের আঙিনায় টেনে নেওয়া হল, তা বুঝতে গিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ, কাউকে উদ্ধৃত করতে বাকি রাখিনি। কিন্তু উদ্ধৃত করতে পারলেই একটা নতুন কথা আত্মস্থ হয় না। কারিকুলাম-ঘেঁষা স্বভাব আমাদের অভিভাবকদের আজকের নয়। আমরা ভাবি সব দোষ মেকলের, কিন্তু আসলে বিষয়টা আরো গোলমেলে। চেনা এবং মাপা পথ ধরে এগোনোর প্রবণতা, এবং অচেনা, নন-কোয়ান্টিফায়েড পরিসরে সন্তান পা বাড়াতে চাইলে তাকে নিরুৎসাহিত করা – এটা একটা অনেক পুরোনো সীমাবদ্ধতা, এর সমাধানও ততোধিক দুরূহ।
ভারতবর্ষে জন্মানো ছেলেমেয়েদের জীবনপ্রদীপের সলতে পাকানো শুরু হয় যে বইয়ের হাত ধরে, তার নাম রামায়ণ। রামায়ণ আমরা সবাই পড়েছি, গল্পটা আমাদের সবার মনে আছে নিশ্চয়ই।
যদি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, রামচন্দ্রের জীবনে প্রথম ‘টার্নিং পয়েন্ট’ কী? কোন ঘটনা প্রথম তাঁর জীবনের ধারাকে মোড় ফিরিয়ে নতুন খাতে বইয়ে দিল? – উত্তর, বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রামচন্দ্রের প্রথম বনগমন, সঙ্গে অনুজ লক্ষ্মণ। আমরা এই ঘটনাটাকে একবার ভালো করে খুঁটিয়ে দেখব।
ঋষি বিশ্বামিত্র অযোধ্যায় উপস্থিত হতে রাজা দশরথ সপার্ষদ তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন, আদর করে বসালেন। কিন্তু বিশ্বামিত্রের কথা শুনে রাজার হাসিমুখ শুকিয়ে গেল। ঋষি বললেন, তিনি নিছক বেড়াতে আসেননি, তিনি রামচন্দ্রকে কিছুদিনের জন্য চান। আশ্রমে বড় রাক্ষসের উপদ্রব, যাগযজ্ঞে অত্যন্ত অসুবিধা হচ্ছে। দশরথের বড় ছেলেটির সুখ্যাতি বিশ্বামিত্র ইতিমধ্যেই শুনেছেন, ছেলেটির ক্ষমতার ওপর তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস আছে, দশরথ অবিলম্বে রামকে তাঁর সঙ্গে ছেড়ে দিন, রাম গিয়ে যুদ্ধ করে রাক্ষসদের তাড়াবেন। – বিশ্বামিত্রের এই কথার প্রভাব ভারী চমৎকার হল, রাজা দশরথ মাটিতে পড়ে মূর্ছা গেলেন।
যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। দশরথ ত্রেতাযুগের মানুষ ছিলেন – মূর্ছা গিয়েছিলেন। কলিযুগের মানুষ হলে বোধ করি কোর্টে যেতেন। তাঁর পরম আদরের সন্তান রাম, অযোধ্যার চোখের মণি, মাত্র ষোলো বছর বয়স – তাকে ঋষি বিশ্বামিত্র সঙ্গে নিতে চান রাক্ষস সামলানোর কাজে লাগাতে? এ কি কোনো ছোট ছেলের কাজ!
অথচ আমরা জানি, এই প্রথম বনগমনই রামচন্দ্রের জীবনের মোড় নাটকীয়ভাবে ফিরিয়ে দেবে, রাম ও লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্রের সঙ্গে অরণ্যে কাটাবেন অনেকগুলো দিন, খোলা আকাশের নীচে বন্য পরিবেশে বাঁচার পাঠ পাবেন, নতুন ধরনের অস্ত্রকৌশল শিখবেন, ঋষির মুখে ইতিহাসের কাহিনী শুনতে শুনতে স্বদেশকে পুনরাবিষ্কার করবেন, এবং অবশেষে এই ‘ফিল্ড ট্রিপ’ পরিণতি পাবে মিথিলায়, হরধনু ভঙ্গ হয়ে রাম ও সীতার পরিণয়ে। বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বনে যাওয়ার অধ্যায়, রামচন্দ্রের boy থেকে man হয়ে ওঠার অধ্যায়। দশরথ তো বোকা নন, তবে তিনি বাবা হয়ে নিজের ছেলের বিকাশের পথে এভাবে বাধা দিচ্ছিলেন কেন?
আমরা প্রশ্নটা একটু অন্যভাবে করতে পারি, – বাবা দশরথ, যিনি রামকে বাইরে ছাড়তে চান না, আর আচার্য বিশ্বামিত্র, যিনি রামকে সোজা খোলা জগতে নিয়ে গিয়ে বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে চান – এই দু’জনের মধ্যে রামের বেশী শুভাকাঙ্ক্ষী কে?
উত্তর হল- শুভাকাঙ্ক্ষী দু’জনেই, কিন্তু জীবনের কোন পর্যায়ে কোন জনের প্রভাব রামচন্দ্রের ব্যক্তিত্বের বিকাশের পক্ষে বেশী প্রয়োজনীয়, সেটা বিচার করে দেখা দরকার। দশরথ চান রামকে আগলে রাখতে; জীবনকে আগলে রাখার দরকার আছে। কিন্তু জীবনের ধর্ম প্রসারিত হওয়া, আগলে রাখার আঙিনা সময়ের সাথে সাথে স্বভাবতই ছোট হয়ে পড়ে, তখন তাকে অতিক্রম করে বিশ্বামিত্রের হাত ধরে বৃহৎ জীবনের প্রান্তরে বেরিয়ে পড়তে হয়। এই যে বৃহৎকে বরণ করে নেওয়ার শিক্ষা, একে শ্রেয় বলে চিনতে পারেন না বলেই দশরথ তাঁর সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও মূর্ছা যান।
আমরা লক্ষ্য করব যে এই অধ্যায়ের সূচনায় রামচন্দ্রের বয়স ষোলো – আমাদের ছেলেমেয়েরা ঠিক যে বয়সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। তিনি এতদিন ভাইদের সঙ্গে রাজধানীতে রাজকীয় আয়োজনে স্বয়ং ঋষি বশিষ্ঠের তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেছেন। কিন্তু তাঁর চরিত্রের উত্তরণ ঘটাতে গিয়ে আদিকবি নিয়ে আসছেন একজন বহিরাগতকে, যিনি রামচন্দ্রের ‘কারিকুলার’ বিদ্যাচর্চায় কোনোরকম ভাগ নেননি, যিনি এমন প্রস্তাব নিয়ে আসছেন যা সম্পূর্ণ অকল্পনীয়, সে প্রস্তাব শুনে এতদিনের যত্ন করে গড়ে-পিটে তোলা রাজকুমারদের রীতিমতো সর্বনাশ হয়ে যাবে এমন ভয় পেয়ে দশরথ সিঁটিয়ে যাচ্ছেন। দশরথ শেষপর্যন্ত রাজি হলেন কখন? যখন বিশ্বামিত্রের এক্সট্রা-কারিকুলার প্রস্তাবে বশিষ্ঠের কারিকুলার অ্যাপ্রুভালের ছাপ পড়ল, বশিষ্ঠ রাজাকে বোঝালেন – ছেলেকে ওঁর সঙ্গে দিন, এতে ওর ভালোই হবে। মানে, বশিষ্ঠ রাজাকে বোঝালেন, এক্সট্রা নয়, এ এক্সকারশন আদতে কো-কারিকুলার। পাঠক হিসেবে আমরা বুঝলাম, এইবারেই আসল পাবলিক একজামিনেশন, এতদিনের শিক্ষালাভ আসলে ছিল শুধু পড়া-পড়া খেলা।
আমাদের কালে এগিয়ে আসা যাক।
কারিকুলাম জিনিসটা মূলত কী?
১৯১৮ সালে জন ফ্র্যাঙ্কলিন ববিট লিখছেন, একজন শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে গেলে তাকে যে সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়ে ওপারে পৌঁছতে হয়, সেই সমস্তরকম অভিজ্ঞতার একটা সামগ্রিক ‘রেসকোর্স’ হল ‘কারিকুলাম’। ববিট বলছেন, কারিকুলাম আসলে একটা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করার জায়গা, যাতে একজন শিশুর বড় হয়ে যেমন হওয়া উচিত, ঠিক তেমন হবার জন্য তার যে যে কাজ ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার, সেই সমস্ত কাজ ও অভিজ্ঞতার সুযোগ তাকে দেওয়া হয়।
‘সিলেবাস’ বলতে আমরা যা বুঝি, তেমন শোনাচ্ছে কি? – না, শোনাচ্ছে না। যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ববিটের মূল চিন্তার অনুসারী হত, তাহলে কো-কারিকুলার বলে যা কিছুকে চিহ্নিত করছি তার সবটাই কারিকুলামের আওতায় থাকত। কিন্তু তা নেই। সমস্ত ধরনের কাজ দূরে থাকুক, খেলার মাঠটুকুও আমাদের সব স্কুলে থাকে না, গানবাজনা বা ছবি আঁকাকে তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ বলে বেশীরভাগ অভিভাবক পাশে সরিয়ে রাখেন। আমাদের কাছে সিলেবাস বা কারিকুলাম বলতে আট-দশটা সাবজেক্টের টেক্সটবুকে যা ছাপা থাকে, সেইটুকু।
কিন্তু এই সীমিত সংজ্ঞাকেও যদি মেনে নিই, তাহলেও আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে এই খণ্ডিত কারিকুলাম মোটেই শিক্ষার সবকিছু নয়। মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়াকে বলা হয় ‘সামথিং অফ এভরিথিং’, এবং সেই সিলেবাসটা একটা অত্যন্ত জেনারেলাইজড জিনিস, তাতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কোনো জায়গা নেই। ছাত্র সাঁওতালপল্লীর বাসিন্দা হোক বা সল্টলেকের, এই মেশিন-মেড কারিকুলাম সবার জন্য এক। একটা কথা আছে যে মাছের যোগ্যতার পরীক্ষা নিতে গেলে তাকে গাছে চড়তে বললে চলে না। তাহলে আমাদের এই বারোয়ারি কারিকুলামের উদ্দেশ্য কী, তার সার্থকতা কোথায়? – আছে, তবে সংজ্ঞার মতো এর সার্থকতাও সীমিত। এই কারিকুলাম আমাদের একটা গড় মাপের জায়গা করে দেয়, যার ওপর ভর করে আমরা নিজেদের রাস্তা বুঝে নিতে পারি। কারিকুলাম আবশ্যিকভাবে স্টার্টিং পয়েন্ট, কোনোমতেই এন্ড পয়েন্ট নয়। ‘কো-কারিকুলার’ বলে দেগে দিয়ে যে জিনিসগুলোকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর বলে নির্দিষ্ট করা হচ্ছে, সেগুলো আসলে কারিকুলামের ঘর থেকে বাইরের দুনিয়ায় বেরিয়ে আসার দরজা। দরজা-ছাড়া ঘর শবাধারের নামান্তর। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনে বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও যে কর্মজীবনে রিপ্লেসেবল অ্যাসেট হয়ে থেকে যায়, তার কারণ তারা কারিকুলামের বাইরে বেরিয়ে নিজেকে নিজের মতো করে তৈরী করে না। কারিকুলাম সবার ক্ষেত্রেই এক। শুধুমাত্র সেই ছাঁচে নিজেকে বেঁধে রাখলে সে ছাত্র আখেরে রিপ্লেসেবল অ্যাসেট হতে বাধ্য।
তাহলে, এক নম্বর কাজ হল, কারিকুলামের খড়কাঠামোর ওপরে স্বাধীনভাবে মাটি ও রঙ চাপানোর পরিসরটা ছাত্রদের দিতে হবে, না হলে তারা ব্যক্তিত্বহীন ‘ড্রয়েড’-এ পরিণত হবে। এবারে আরেকটা জরুরী প্রশ্ন। এই মাটি ও রঙ চাপানোর কাজটা করবে কে?
গবেষণা বলছে, শিশুরা – না, আমরা ‘শিশু’ শব্দটাকে এইখানে এড়িয়ে যাব, কারণ ‘শিশু’ শব্দটার মধ্যে একটা পুতুলত্ব আছে, যেটা আমাদের ভুলিয়ে দেয় যে শিশুরা আসলে অল্পবয়সী মানুষ; গবেষণা বলছে, মানুষ তার শৈশবে যখন প্রথম সামাজিক হতে শেখে, তখন তার এই শিক্ষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অন্যান্য সমবয়সী মানুষেরা। ২ বছরের বাচ্চার মধ্যে একটা অফুরন্ত অগোছালো ছোটাছুটি থাকে, সে তখনো নিজেকেই চেনে না, তার মনের মধ্যে নিজের সাইকোলজিক্যাল কোহেরেন্স তখনো গড়ে ওঠেনি। এটা গড়ে উঠবে ৩ বছর বয়স হতে না হতেই, এবং তার পাশাপাশি অন্য আরেকজন শিশুর নিজস্বতার সঙ্গে নিজের নিজস্বতাকে যুক্ত করে দু’জনে একসঙ্গে মিলে কিছু করা – এই ক্ষমতারও জন্ম ও বিকাশ হবে ৩ বছরে পা দেবার আশেপাশে। এই ‘অন্য একজনের স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে নিজের স্বাতন্ত্র্যকে যুক্ত করে যৌথ লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া’ – এই জিনিসটাই সাইকোলজিস্টদের ভাষায় ‘প্লে’, আমরা বাংলায় বলব ‘খেলা’, কারণ জিনিসটা শিশুদের মধ্যে আক্ষরিকভাবেই খেলা হিসেবে দেখা দেয়। খেলা জিনিসটাই তাই – একাধিক মানুষ মিলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যৌথ লক্ষ্যের দিকে এগোনো। এই ট্রেনিংটা ২ থেকে ৪ বছর বয়সের মধ্যে ঠিকমতো না হলে সেই বাচ্চার সোশিওপ্যাথি সারাজীবন স্থায়ী হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাবা-মায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এইখানে – ৪ বছর বয়সের মধ্যে এটা নিশ্চিত করা যে তাঁদের সন্তান তার সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে খেলতে পারে। জোর করে ‘অ্যাই খেলছিস না কেন’ বলে খেলানোর কথা হচ্ছে না। শিশুর পার্সোনালিটি এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে অন্য শিশু তার সঙ্গে খেলতে অনিচ্ছুক না হয় (যে বাচ্চা অত্যধিক চেঁচায়, কাঁদে, কথা না শুনে হাত-পা ছোঁড়ে, ইত্যাদি – তার সঙ্গে অন্য বাচ্চারা খেলতে চায় না, লক্ষ্য করে দেখবেন)। যে শিশুর নিজের ভাই বা বোন থাকে, তার এটা তৈরী হয় সহজে, কারণ প্রায় সমবয়স্ক ভাইবোনেরা পরস্পরের মধ্যে নার্সিসিজম তৈরী হতে দেয় না; যে শিশু একা তার ভরসা প্রতিবেশী শিশুরা; কিন্তু এর বিকল্প নেই। আর এটা তৈরী হয়ে গেলে, চিন্তা নেই। মাটি-রঙ চাপানোর কথা বলছিলাম, সেই কাজটা এবারে বহুলাংশে বাচ্চারা নিজেরাই করবে, নিজেদের জন্য এবং পরস্পরের জন্য। সন্তানের জীবনে বাবা-মায়ের ভূমিকা আসলে একটা প্রক্সির ভূমিকা – সমাজের প্রক্সি। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যে কাজ করলে সমাজের কাছে দণ্ডিত হতে হবে, সেই কাজের শিশু-সংস্করণকে শৈশবেই শিশুমন থেকে উৎপাটন করতে হবে। কাজটা সোজা নয়, জটিল; শুধু ধমক বা মার দিয়ে এ কাজ হয় না। এর জন্য শিশুর জন্য একটা চওড়া জীবন তৈরী করে দিতে হয়, যা তাকে বড় হতে হতে অ্যান্টিসোশ্যাল হতে দেবে না (অ্যান্টিসোশ্যাল শব্দটা টেকনিক্যাল অর্থে নিতে হবে)। আমরা রামায়ণ দিয়ে শুরু করেছিলাম, এই সোশ্যালাইজেশনের প্রসঙ্গে আমরা একবার মহাভারতের কথা স্মরণ করব। কর্ণ যদি ছোটবেলা থেকে সব ক্ষেত্রে একা এবং বহির্ভূত হয়ে বড় না হত, পাণ্ডব এবং কৌরবদের মতো যদি তার শৈশব এবং কৈশোরে একরকম সামাজিক পরিপূর্ণতা থাকত, তাহলে হয়তো মহাভারতে সে সব-গুণ-থাকা-সত্ত্বেও-খলনায়ক হয়ে উঠত না। কর্ণের ট্র্যাজেডি আসলে অ্যাকসেপ্টেন্স-এর ট্র্যাজেডি – যা সে খুঁজে ফিরেছে সারাজীবন, যার সুযোগ নিয়ে দুর্যোধন তাকে দলে টেনে নিয়েছে অতি সহজে। যদি কর্ণ জন্মলগ্ন থেকে একা হয়ে না পড়ত, তাহলে তার মধ্যে একা-মানুষের সোশিওপ্যাথি তৈরীই হত না।
মানুষকে এক থেকে অনেক-এর মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে হয়, – আর তা সে করতে শেখে ওই চওড়া জীবনের পথে।
এবং এই প্রশস্ত জীবনে অবশ্যই শিশুর সঙ্গে শুভের পাশাপাশি মোলাকাত হবে অশুভের, কারণ জীবন-প্রভাতে সে আলাপ বাকি থেকে গেলে জীবন-মধ্যাহ্নের রণক্ষেত্রে অশুভের মুখোমুখি দাঁড়ানোর শক্তি মানুষের মধ্যে তৈরী হবে না। রাবণের সামনাসামনি হবার অনেকটা আগে তাড়কাকে অতিক্রম করে আসতে হয়, না হলে রামের বালক থেকে পুরুষ হয়ে ওঠা হয় না, রামায়ণের বালকাণ্ড অসমাপ্ত থেকে যায়। আমরা শিশুদের জন্যে স্যানিটাইজড জীবন চাইছি না, আমরা চাইছি, তারা বিপদে যেন করিতে পারে জয়।
এতক্ষণ ধরে যা কিছু আলোচনা হল, এর সবটাই কো-কারিকুলারের ফসল। পড়াশোনার পাশাপাশি আমরা খেলাধূলা-নাচগান-রঙছবি-কবিতানাটক-রান্না-বাগান এই সব রাখব এজন্য নয় যে সন্তান বড় হয়ে সেলিব্রিটি গায়ক হবে, ইন্ডিয়া টীমে খেলবে, বেস্টসেলার লিখে কোটিপতি হবে বা রান্না করে জি-বাংলা মাত করবে। কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি কোনো কেরিয়ারমুখী ‘প্ল্যান বি’ নয়। কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি ছাত্রের ব্যক্তিত্বের বিকাশের অন্যতম প্রধান শর্ত।
ভেবে দেখতে গেলে, সিলেবাসের পড়াশোনার বাইরে যতরকম কাজ আছে, যা থেকে একজন মানুষ কিছু না কিছু শেখে, তার সমস্তটাই কো-কারিকুলার। গল্প এবং কবিতার বই পড়া – যাতে মানুষের মনে বৃহত্তর আমিত্ব তৈরী হয় এবং যা মানুষকে সুশিক্ষিত দানব হওয়া থেকে বাঁচায়; নাচ ও গান – যাতে মানুষের চারিত্রিক নিয়মনিষ্ঠতা তৈরী হয় (যে নিয়মনিষ্ঠতার সমান্তরাল প্রয়োগ আমরা গণিতেও পাব, ইউক্লিড যাকে বলছেন rigour), এবং তৈরী হয় শ্রম ও শিল্পের মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য যোগ আছে, তা সম্পর্কে বুনিয়াদী বোধ; নাচ ও খেলাধূলা – যাতে একদিকে শিশুমনের সোশ্যালাইজিং প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটে, এবং অন্যদিকে মোটর রিফ্লেক্স তৈরী হয় – যা সামাজিক পরিসরে সূক্ষ্ম এবং জটিল ভূমিকা নেয়; রান্না – এমন এক ট্রেনিং যা একাধারে পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস তৈরী করে, জটিল কাজকে ধাপে ধাপে ভেঙে নিয়ে অ্যালগোরিদমে ফেলে তাকে সমাধা করার পাঠ দেয়, এবং রক্ষণশীলতা ও সৃষ্টিশীলতাকে ব্যালান্স করার সাইকোলজি গড়ে তোলে (নুন/তেল/মশলা বেশী হবে না কম, কখন কোনটা কতটা মিশবে – এ নিয়ে যাঁরাই এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তাঁরাই এই ব্যালান্স করার সূক্ষ্মতা বুঝবেন); বাগান করা – যাকে বলা হয় মানবমনে মনুষ্যত্বের আবাদ করার সহজতম পন্থা, কারণ এতে পর্যবেক্ষণক্ষমতা, অপত্যস্নেহ, লালনক্ষমতা, পরিবেশবোধ, এই সমস্ত কিছু একসাথে তৈরী হয়।
এর একটাও আমরা ফেলতে পারি কি?
জানি, পারি না। সবগুলোর পরিসর তৈরী করে দিতেও হয়তো পারি না সমানভাবে, আমাদের সব সন্তানের জন্য। কিন্তু যেখানে সুযোগ রয়েছে, যেখানে সন্তান নিজে থেকে কোনো ‘বাইরের’ জিনিসে আগ্রহ দেখাচ্ছে, অথবা কোনো বহিরাগত ‘বিশ্বামিত্র’ তাকে অচেনার নেশা ধরাচ্ছেন একটু একটু করে, সেখানে সেই বেড়ে ওঠাকে বাধা দিয়ে সন্তানের ব্যক্তিত্বের কণ্ঠরোধ করি কী করে?
ডিজিট্যাল যুগের ছেলেমেয়েরা অনেকটা সময় অনলাইনে কাটায়, তা নিয়ে বড়রা নিয়ম করে হা-হুতাশও করেন, কিন্তু সেটা তাঁরা করেন অনলাইন কনটেন্টের প্রেক্ষিতে। কিন্তু কনটেন্টের চেয়ে বেশী ক্ষতিকারক অনলাইন মিডিয়মটা, কারণ তা মানুষে-মানুষে রক্তমাংসের মেলামেশাকে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করছে। অনলাইন বন্ধুত্ব হোক বা অনলাইন ক্লাস, তা বাস্তবের বিকল্প আদৌ নয়। বাস্তবের মেলামেশা, সোশ্যালাইজিং, rough-and-tumble play ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে জাক প্যাঙ্কসেপ থেকে শুরু করে পেলেগ্রিনি, ফ্রান্স ডে ওয়াল প্রমুখ অনেক বিজ্ঞানীর অজস্র কাজ রয়েছে, সেসব থেকে এই কথা বার বার উঠে আসে যে একান্তভাবে স্ক্রীনমুখী বা বইমুখী শৈশব হল যাকে বলে recipe for disaster। শিক্ষক ও অভিভাবকদের একটা বড় কাজ হল ছাত্রদের চোখ থেকে এই ডিজিট্যাল ও অ্যানালগ সিলেবাসের ঠুলি খুলে নেওয়া। নচেৎ ভবিতব্য – a society of highly educated sociopaths.
একটা কথা মাঝে মাঝে শোনা যায় – এসব করে সময় নষ্ট করলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না তো? বিশেষ করে উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের, যারা অনেক অনেক পড়ার চাপ?
প্রশ্নটার উত্তর নেই, কারণ প্রশ্নটার পেছনে একটা বড় ধরনের বোঝার ভুল আছে। কো-কারিকুলার জিনিস পড়াশোনা-করে-সময়-বাঁচলে-তবে করার জিনিস নয়। কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি ‘ঐচ্ছিক বিষয়’-এর মতো নয়, যে রাখলে ভালো, না রাখলেও ক্ষতি নেই। পড়ার চাপ যতই থাকুক, পড়ার বইয়ের বাইরের কাজের জন্য সময় রাখতেই হবে, স্বতঃস্ফূর্ত এবং আবশ্যিকভাবে। ছোটবেলায় হোমওয়ার্ক না করলে মাস্টারমশাইরা বলতেন, “স্নান-খাওয়ার সময় পাসনি? যদি সেটা পেয়ে থাকিস তাহলে হোমওয়ার্ক করারও সময় পেতে হবে।” যদি পড়া করার সময় পাওয়া যায়, তবে না-পড়া করারও সময় পেতে হবে। বরং উঁচু ক্লাসের পড়াকে কেন ছাত্রদের কাছে উদ্দীপক বলে মনে না হয়ে ‘চাপ’ বলে মনে হচ্ছে সে বিষয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা করা যেতে পারে। এবং সেই সাথে সাবধান হতে হয়, যাতে কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিকেও অভিভাবকেরা resume ভরানোর লক্ষ্যে সন্তানের ওপর জোর করে চাপিয়ে না দেন।
কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি থেকে কেরিয়ারে সাহায্য হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা মূল কথা নয়। মনে রাখা উচিত যে কারিকুলামে যা থাকে, তারও ৭০% আমাদের কেরিয়ারে সেভাবে কোনো কাজে লাগে না। ইংরেজীর ছাত্রের কাছে ত্রিকোণমিতি বাড়তি বোঝা মাত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রের কাছে বাংলা অলঙ্কার পড়া সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়, ভারতের কোন অঞ্চলে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায় তা জেনে নিউরোসার্জেন ডাক্তারের কিচ্ছু লাভ নেই। কিন্তু তাও আমরা এগুলো যত্ন করে পড়ি। কেন পড়ি? কারণ চাকরি ছাড়াও জীবনের অনেকগুলো স্তর রয়েছে, অনেকগুলো দিক রয়েছে। আমরা পৃথিবীতে বাঁচি, আপিসে নয়। এবং পৃথিবীতে বাঁচতে না জানলে অফিসের কাজও খুব বেশীদিন ভালোভাবে করে ওঠা যায় না – বিশেষ করে এই হিউম্যান-স্কিল ওরিয়েন্টেড একুশ শতকের দুনিয়ায়। ইতিহাস গবেষক হয়ে আমার পিরিয়ডিক টেবিল মুখস্থ না থাকলেও চলে, কিন্তু পিরিয়ডিক টেবিলের অস্তিত্বটুকু সম্পর্কে অনবহিত থাকা আমার মনুষ্যত্বের অসম্পূর্ণতাকেই প্রমাণ করে। প্রমাণ করে, আমি আমার নিজের পায়ের তলার মাটি চিনি না।
সেরকমই, যে মানুষ জীবনে অন্য মানুষদের সঙ্গে মিলে কোনোদিন খেলেনি, কোনোদিন গান ভালোবেসে নিজে নিজে সুর ধরেনি, রঙের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে ছবি আঁকেনি কখনো অথবা মাটিতে হাত ডুবিয়ে বাগান করার অলৌকিক আনন্দ অনুভব করেনি রক্তের ভেতরে, সে আসলে জীবন জানে না। নিজের আত্মজীবনীতেই পার্শ্বচরিত্রের সামিল সে, কারণ তার একমাত্রিক চরিত্রের কোনো গভীরতা নেই। সে তাসের দেশের লোক। নতুন প্রজন্ম নতুন প্যাকেটবন্দী হয়ে দোরে এসে গেলে তাকে অপ্রয়োজনবোধে সরিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে।
এখানেই রামচন্দ্রের জীবনে গায়ত্রীদ্রষ্টা ঋষি বিশ্বামিত্রের সার্থকতা। যে সুদীর্ঘ অরণ্যজীবন রামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণের জন্য অপেক্ষা করে আছে ভবিষ্যতের ধূসর দিগন্তে, তার সংক্ষিপ্ত অথচ সমার্থক অভিজ্ঞতাই কি বিশ্বামিত্র সাজিয়ে দিচ্ছেন না দুই ভাইয়ের সামনে, রাক্ষস-সমস্যা-সমাধানের মতো সামান্য অছিলার অবতারণা করে? বিশ্বামিত্র তো চাইলে অনায়াসে সুবাহু, মারীচ বা তাড়কাকে ব্রহ্মতেজে বিনষ্ট করতে পারতেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও রামকে সেই কাজ দেওয়ার অর্থ একটাই – তাকে প্রস্তুত করা। তার জন্য অপেক্ষা করে আছে অভূতপূর্ব অভিযান, চৌদ্দ বছর বনবাসের শেষে দ্বিতীয়বার সীতালাভের মধ্যে দিয়ে যা তাকে করে তুলবে মর্যাদা-পুরুষোত্তম, প্রবাদপ্রতিম প্রজাবৎসল অযোধ্যার রাজা রাম। বনবাস না হয়ে যদি অযোধ্যাকাণ্ডের শেষে রামের রাজাভিষেক হত, তাহলে যেমন আমরা রামায়ণের নায়ককে পেতাম না, তেমন বালকাণ্ডের শেষে কারিকুলাম ছেড়ে না বেরোলে রামচন্দ্র পেতেন না নিজেকে।