জীবনের বিশাল আবর্তনে ধীরে ধীরে সব সমান হয়ে যায়। যেসব পাহাড়েরা একদিন মহান হয়ে চোখে ধরা দিয়েছিল, নরম ও সুন্দর হয়ে সমুখ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল যেসব নদী, যেসব খাদ এড়িয়ে যেতাম, যেসব পাথরে পিঠ রেখে বসতাম, সব ধীরে ধীরে এক সমতলে মিশে যাচ্ছে, আর কোনোকিছু দেখে অন্যরকম বলে মনে হয় না।
ঋণ যদিও থেকেই যায়, যতদিন স্মৃতি থাকবে ততদিন, কিন্তু তার মধ্যে ঋণী হবার ভালোলাগাটুকু ছাড়া আর কোনো কৃতজ্ঞতার তাড়না থাকে না। যেমন এরকম রাত হলেই রাসপূর্ণিমার কথা মনে পড়ে, সত্যদা প্রেয়ার হলে বসেছেন, জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের চাঁদ, সত্যদা বলছেন – দেখ, কতযুগ কেটে গেছে, সেই বৃন্দাবন আজ আর নেই, সেই গোপিনীরা আজ নেই, সেই কৃষ্ণও আজ আর নেই, কিন্তু দেখ, সেই চাঁদ আজও একইরকমভাবে রয়ে গেছে।
মানুষ সারাজীবন তিল তিল করে কতজনের কাছে কতরকমভাবে শেখে! আমি যাঁর কাছে শ্লেটে অক্ষর লেখা শিখেছিলাম তিনি আমার দাদু। লাইনে লাইনে মিল দিয়ে ছড়া বানাতে শিখেছিলাম বাবার কাছে, লক্ষ্মীর প্রণামমন্ত্র শিখেছিলাম বড়পিসির কাছে, তাসের ম্যাজিক শিখেছিলাম সেজপিসনের কাছে, ইংরেজী হ্যান্ডরাইটিং শিখেছিলাম টীচারের কাছে, তাকে ‘টীচার’ সম্বোধনেই ডাকতাম। আর কড়া জান নিয়ে টিকে থাকতে শিখেছিলাম আমাদের এই বিদ্যাপীঠের কাছে। বিদ্যাপীঠের এক সাধুর কাছে ছাত্রপরায়ণতা শিখেছিলাম, বিদ্যাপীঠের এক শিক্ষকের কাছে শিরদাঁড়া সোজা রাখা শিখেছিলাম, বিদ্যাপীঠের এক কুকুরের কাছে ব্যথা সহ্য করা শিখেছিলাম, বিদ্যাপীঠের এক-দু’জন বৃদ্ধ কর্মী আর বেশ কয়েকটা গাছের কাছে মানুষের অকৃতজ্ঞতার কথা শিখেছিলাম। এই শিক্ষকদের কথা আর আমি নতুন করে বলতে চাই না, এদের স্মৃতি আর পাহাড়ের মতো মাথা উঁচু করে আমার সামনে দাঁড়ায় না।
কিন্তু বয়সে বড় হয়ে যাদের কাছে শিখছি, যাদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে নতুন করে ভালোবাসা শিখছি, সম্পর্ক শিখছি, নৈরাশ্য শিখছি, বিস্ময় শিখছি, যাদের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে এমনভাবে হৃদয়বত্তা অনুভব করছি যা আগে করিনি, এমনভাবে অকৃতজ্ঞতার পাঠ পাচ্ছি যা আগে পাইনি, এমনভাবে দায়িত্বের ধারণা তৈরী হচ্ছে যা আগে হয়নি, – তাদের স্বীকার করতে চাই।
এরা তো সংখ্যায় অনেক। সবার ছবি আমার কাছে নেই। একটা গ্রুপ ছবি আমার প্রিয়, পুণা থেকে চলে আসি যাদের ছেড়ে, সেই ক্লাসের ছবি। এটাই দিলাম। এরা সবাই ভালো থাকুক। সবার মনে সবার কথা বেঁচে থাকুক।
শুভ গুরুপূর্ণিমা