================
ধ: কী ব্যাপার, বসে বসে ভাবছ কী?
চ: হুম?
ধ: রাস্তায় কয়েকটা বই কিনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। – এই নাও ধর।
চ: সিঙাড়া?
ধ: হ্যাঁ। তলায় জিলিপিও আছে, গরম গরম নামিয়ে দাও। তা খবর কী? চিন্তিত মনে হচ্ছে?
চ: ভাবছি যে আমেরিকার সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্টের মতো এখানেও একটা কিছু করলে জিনিসটা ভালো হবে কি না।
ধ: আচ্ছা! কদ্দূর ভাবলে?
চ: বুঝতে পারছি না। তুমি তো আবার লিবারাল চিন্তাভাবনার মানুষ, এসব কথা তোমাকে বলতে যাওয়া ঝামেলা। দেখো, খুব প্র্যাকটিকাল ব্যাপার। এখন দেশে সবচেয়ে বেশী দরকার হল জনসংখ্যার ড্রাস্টিক হ্রাস। যদি সাধারণ মানুষকে লেজিটিমেট বন্দুক-পিস্তল রাখতে দেওয়া হয়, তাহলে এই জিনিসটা অনেক কম সময়ের মধ্যে অ্যাচিভেবল।
ধ: তা জনসংখ্যা কমানোর জন্য এদের দাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করার দরকার কী? এমনিই যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে তো আর ক’মাস পরে গ্যাসিং করেই মেরে ফেলতে পারবে।
চ: সেটা পারবে। কিন্তু সেটা করলে কাজটার এজেন্সি হাতবদল হয়ে যায়। এসবের পাবলিক রেজোন্যান্স আছে ভাই। দেশের লোকেরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে ভলান্টারিলি লড়াই করে মরল, আর স্টেট অর্ডার জারি করে লোকজনকে ক্যাম্পে ভরে মারল, এ’দুটোর অনেক ফারাক আছে। একটা হিউম্যান ট্র্যাজেডি, আরেকটা ক্রাইম এগেনস্ট হিউম্যানিটি। কোন সালে আছো সেটা দেখতে হবে তো।
ধ: নো ডাউট, নো ডাউট, নো ডাউট। কিন্তু যদি এত বড় – কী বলি, গৃহযুদ্ধ তো নয়, গৃহদাঙ্গা বলা ভালো – কিন্তু এত বড় স্কেলে যদি এটা হয়, তার শেষ কীভাবে হবে, সেটাকে কীভাবে হ্যান্ডল করবে সেসব ভেবেছ?
চ: সমস্যার কী আছে? লজিস্টিকসটা কোনো ইস্যু নয়, সেটা বাদ দাও। যদি স্টেবিলিটি রিস্টোর করার কথা বল, সে জিনিস একটা সময়ের পর আপনা আপনিই আসবে। ব্লাড-ফেটিগ। সে জিনিস তোমার অজানা থাকার কথা নয়।
ধ: তা নয়।
চ: ব্যাস, দ্যাটস ইট। ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি। লজ্জা, শোক। তারপর নতুন করে গড়া হবে নতুন দেশ। – এই যে তোমরা আদর্শ-আদর্শ করে মরো, কিন্তু সেটা কীভাবে অ্যাচিভ করতে হয় জানো না। রক্ত ছাড়া কিছু কেনা যায় না ভাই।
ধ: রক্ত ছাড়া কিছু কেনা যায় না জানি। কিন্তু এক জিনিসের জন্য কতবার রক্ত দিতে হবে? আর, কার ভোগের জন্য কে রক্ত দেবে, সেটাও তো প্রশ্ন। এগুলোর জবাব কোথায়?
চ: (দম ফেলিয়া) জবাব। আচ্ছা, বেশ। এই যে তুমি আমার জন্য সিঙাড়া কিনে আনলে, এর জন্য তোমার অপরাধবোধ নেই?
ধ: আমি নিজের জন্যেও কিনেছিলাম, কাজেই খামোকা অপরাধবোধ থাকতে যাবে কেন?
চ: ওয়েল, তুমি আমার জন্য কিনলে, অথচ অজুর জন্য আনলে না।
ধ: অজু কি এই মেসে থাকে, যে ওর জন্য আনব? আর, অজু আমার তেমন কিছু পেয়ারের লোক নয় যে ওর জন্যে আমাকে সিঙাড়া আনতে হবে!
চ: শুধু নিজের লোক নয় বলে ওর জন্য ভাগ রাখবে না? এটা অন্যায় নয়?
ধ: না নয়। এবার আসল কথাটা খোলসা কর।
চ: কথা হচ্ছে এই যে মানুষের প্রাকৃতিক স্বভাব হল নিজের এবং নিজের ঘনিষ্ঠজনের স্বার্থে কাজ করা – অ্যাট দ্য কস্ট অফ আদার্স, যারা এই ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরের লোক। এতে কোনো অন্যায় নেই। তুমি জিনোসাইড নিয়ে যে প্রশ্নটা তুলছ, তারও ওই একই উত্তর। এক শ্রেণীর লোক মরবে; আর এক শ্রেণীর লোক সেই মরার লড়াইটাকে কাটিয়ে, সেই লড়াইয়ের ফলআউটের সুবিধাটা ইউটিলাইজ করবে। ফর দ্য গ্রেটার গুড। শুধু নিজের স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থে। – দাঁড়াও, আদর্শের রিফ্লেক্সে আপত্তি করে বোসো না। তুমি বেতের চেয়ারে বসে বসে চা খাচ্ছ, তোমাকে কে রাইট দিয়েছে মৃত বেতগাছের শরীরে ভর দিয়ে বসার? কে রাইট দিয়েছে চা-গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে, তার পাতা আর কুঁড়ি মুচড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে তার রস বার করে খাবার? এগুলোর বেলা অন্যায় মনে হয় না কেন? – হয় না কারণ এগুলো পৃথিবীর নিয়ম। তোমার চায়ের জন্য জঙ্গল কেটে সাফ করে সেখানে বাগান করা হয়েছে। কীজন্য? তোমার যাতে সুবিধা হয় সেজন্য। আমরা গাছকে ঘৃণা করি বলে গাছ কাটি না। পৃথিবীর কোনো কাঠুরে গাছকে হেট করে বলে গাছ কাটে না। আমরা গাছ কাটি কারণ ইটস ইউজফুল। সেরকমই, তোমার এই একশো-ত্রিশ কোটির দেশে যদি কয়েক কোটি লোপ পায়, ইটস গোয়িং টু বি ইউজফুল। সেখানে চা-গাছের সম্মতিক্রমে চায়ের জল ফোটানো হবে না।
ধ: (কাপ নামাইয়া) তোমার মেটফর অনুযায়ী এই একশো-ত্রিশ কোটির মধ্যে কারা চা-পায়ী, আর কারা চা-পাতা?
চ: যারা মরবে, তারা চা-পাতা। যারা সেই পাতা শুকিয়ে তা থেকে রস বের করে চা বানাবে, তারা এখন ক্ষমতায়। আর সেই চা খাবে যত সারভাইভার থাকবে তারা সবাই। শুধু বানানেওয়ালারা নয়।
ধ: বেশ ক্যানিবালিস্টিক থ্রিল, কেমন?
চ: ক্যানিবালিস্টিক আবার কী। এখন যেটা চলছে সেটাকে কি খুব সুন্দর পরিস্থিতি বলা চলে? কেউ কারো ক্ষতি করছে না, সবাই হেসেখুশে বেঁচে আছে? জঙ্গল বাড়লে মাঝে মাঝে তাতে আগুন লাগে, ব্রাদার। তাতে আখেরে ইকোসিস্টেমের ভালোই হয়।
ধ: সবই বুঝলাম, কিন্তু তুমি ইকোসিস্টেম আর পপুলেশনের মধ্যে প্যারালাল টানছ কীভাবে সেটা বুঝলাম না। তোমার এই এক্সপেরিমেন্ট অলরেডি এর আগে হয়েছে, এবং ফেল করেছে। তুমি যেমন খুশি একপাতা ডারউইনিজম তুলে সেটা মানুষের সমাজে ফেলে দেবে, তা তো হয় না। আমরা বায়োলজিক্যাল ইভলিউশনের পরের স্টেজে আছি, এবং সেই সামাজিক বিবর্তনে গণতন্ত্র বলে একটা জিনিস এসেছে।
চ: না, অশোক। তুমি ভুলে যাচ্ছ যে বিবর্তন কোনো লিনিয়ার ‘উন্নতি’-র গল্প নয়। মাছ থেকে উভচর হয়ে যারা ডাঙায় উঠে এসেছিল, তাদের একদল আবার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাখনা গজিয়ে সমুদ্রে ফিরে গেছে। যুগ যেমন দাবী করবে, পরিবর্তন তেমনটাই হবে। তুমি গণতন্ত্রকে সামাজিক বিবর্তনের শেষ ধাপে ফেলতে চাইছ, কিন্তু ট্রাইবাল সোসাইটির প্রথম ধাপটাই তো গণতন্ত্র। সবচেয়ে জোরালো যে ফাইটার হত, তাকে সবাই মিলেই নেতা বলে মেনে নিত। তার শাসন খুব অসহ্য হলে তাকে সবাই মিলেই পিটিয়ে মেরেও ফেলত – যে জিনিসটা আজকের দিনের শিম্পাঞ্জীরা এখনও করে। তোমার গণতন্ত্রের রূটস ভুলে যেও না। এ তো নাহয় ছেড়ে দিলাম। গণতন্ত্র তো আমাদের দেশেই ছিল কিছু কিছু জায়গায়, আমাদের বহু যুগ আগেই ছিল। সেটা আস্তে আস্তে ঘুচে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদ উঠল কেন? উঠল কারণ তার ওঠার সময় এসেছিল। এখন দু’হাজার একুশে যদি চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পাও যে গণতন্ত্র ধুঁকছে, তাহলে তোমাকে মেনে নিতে হবে যে গণতন্ত্রের সময় ঘনিয়েছে। সামাজিক বিবর্তনও সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট মেনে চলে।
ধ: তুমি বলছ যে যেহেতু আমাদের গণতন্ত্র পার্ফেক্ট নয়, তাই একে বিসর্জন দিয়ে আবার রাজতন্ত্রকে খাড়া করা হোক। সিগারেট খাওয়া যেহেতু অস্বাস্থ্যকর, তাই এবার সায়ানাইডে চুমুক দেওয়া হোক।
চ: বিসর্জন দিতে তো আমি বলছি না! বিসর্জনের প্রয়োজন কোথায়? তুমি খেয়াল করছ না, যে জিনিসটাকে তুমি রাজতন্ত্র বলে দাগিয়ে দিচ্ছ সেটা জন্ম নিচ্ছে কীসের গর্ভে! গণতন্ত্র নিজে নিজেকে মেরামত করে একনায়কতন্ত্র করে নিচ্ছে, মেরে ভাই। প্রধানমন্ত্রী কি জোর করে গদীতে বসেছে? মিডিয়া কি তোমাকে ঘাড়ে ধরে চ্যানেল দেখতে বাধ্য করছে? পাবলিক স্বেচ্ছায় কাঁধ থেকে জোয়াল নামিয়ে দিচ্ছে ভায়া, এবার কাউকে তো তুলে নিতেই হবে। নেপোলিয়ন তলোয়ারের আগায় ফ্রান্সের মুকুট তুলে নিয়েছিল, এরা টিভির রিমোটে ভারতের ব্যালট তুলে নিচ্ছে।
ধ: নেপোলিয়ন মুকুট তুলে নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রাখতে পেরেছিল কি?
চ: রাখতে চাইছে কে? আমরা কি দেশের গার্জেন হয়ে চিরকাল বসে থাকব নাকি? দ্যাখো, এই দেশের অবস্থা – ভালো না। আমরা যেটা করছি সেটা একটা নেসেসারি ঈভিল। – নাও, মেনে নিলাম যে ঈভিল। কিন্তু, নেসেসারি ঈভিল। এ ছাড়া তুমি দেশ টেকাতে পারবে না। আরে ভাই যদি তোমার ডেমোক্রেসি এতই ভালো হয়, তাহলে সে ডেমোক্রেসির ফসল এরকম হল কেন? সক্রেটিস ভুলে গেলে?
ধ: না, কিন্তু সক্রেটিস বলেছিল যে অজ্ঞান জনগণ ডেমোক্রেসি ডিজার্ভ করে না। এখানে তো সজ্ঞান জনতাকে ড্রাগ দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলা হচ্ছে! তার পর তারা যদি ভুল করে, তাহলে সেই দায় শাসকের নয়?
চ: শাসক তো বাইরে থেকে আসেনি, ব্রাদার। এটা তো কোনো উপনিবেশ নয়। তোমার সজ্ঞান জনগণ সম্পূর্ণ সজ্ঞানে এই শাসককে ক্ষমতায় এনেছে, এনে তার হাতে ড্রাগের সিরিঞ্জ ধরিয়ে, তার সামনে শার্টের হাতা গুটিয়ে বসে গেছে। এই তোমার দায়িত্ববান নাগরিক? দ্যাখো, যারা কোনোদিন ভেড়া থেকে মানুষ হয়ইনি, তাদেরকে ভেড়া হিসেবে ট্রিট করা ছাড়া উপায় নেই। এদেশে আদর্শ গণতন্ত্র কোনোদিন তৈরীই হয়নি, এখানে এই ডিকটেটরশিপ দিয়েই আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে।
ধ: এবার অযৌক্তিক কথা কে বলছে? তুমি মানুষের অটোনমি কেড়ে নিয়ে তাকে গড়েপিটে কারেক্ট করে তুলবে, তারপর তার অটোনমি তাকে ফিরিয়ে দেবে! একশো কোটি মানুষ, সবাই সম্পূর্ণ কারেক্ট, সবাই সম্পূর্ণ অটোনমাস! এটা তো রোবোটিক ডিসটোপিয়ার ফার্স্ট চ্যাপ্টার। পরের চ্যাপ্টারেই একটা ফ্ল’ড, স্বাধীনচেতা রোবোট দেখা দেবে, আর গল্পের শেষে কমপ্লিট ব্রেকডাউন!
চ: মানে?
ধ: মানে এই যে তুমি একটা অদ্ভুত অ্যালগোরিদম ভাবছ, অশোক। তুমি ভাবছ ইমপার্ফেক্ট ডেমোক্রেসি থেকে ডিকটেটরশিপ ডিরাইভ করে তা থেকে তুমি পার্ফেক্ট ডেমোক্রেসি আনবে। এ কখনো হয়? পারফেক্ট ডেমোক্রেসি যখন আসবে – যদি কখনো আসে – তখন সেটা একমাত্র ইমপার্ফেক্ট ডেমোক্রেসি থেকেই আসতে পারে। সেটা ছাড়া অন্য যেকোনো রাস্তায় যদি তাকে আনা হয়, তাহলে সেটা অ্যাডপ্টেশন নয়, এনফোর্সমেন্ট – এবং এনফোর্সমেন্টের পরমুহূর্ত থেকে তার ব্রেকডাউন আরম্ভ হয়ে যাবে। – আমাদের সংবিধানের বোধহয় এটাই ফ্যাটাল ফ্ল ছিল, জানো। লেখা হয়েছিল আমরা ভারতের জনগণ হিসেবে এই সংবিধান বরণ করে নিচ্ছি। কিন্তু সংবিধানটা তৈরী করেছিল কয়েকজন মাত্র আলোকিত, শিক্ষিত মানুষ। এদেশের জনগণ কোনোদিন সংবিধানের ছায়াও দেখেনি। We didn’t give to ourselves this constitution; it was merely given to us.
চ: It is always given to the people. তুমি নিজে কী করেছিলে? তোমার এনভয়দের কথা লোকে শুনত কেন জানো? বিকজ দে হ্যাডন্ট ফরগটেন মি। তুমি জানতে সে কথা। ক্ষমতাহীনের কথা এই পৃথিবীর মানুষ কোন্ দিন শুনেছে?
ধ: জানি। আজকের তারিখটায় আরো বেশী করে মনে পড়ে। – কিন্তু জিওর্দানোরা আজকে সংখ্যায় অনেক বেড়ে গেছে যে! আজকে না হয় আমরা বিপন্ন ডেমোক্রেসি, কিন্তু ঘুঁটি ওলটানোর পর এই বিপন্নতা যে এই ডিকটেটরশিপের ওপরেই বর্তাবে ভায়া। চারশো বছর আগে একজনকে পোড়ানো হয়েছিল, আজকে চারশোজনকে পোড়ালেও জিওর্দানোর বাচ্চারা বেঁচে থাকবে।
চ: হয়তো থাকবে। কিন্তু সে তো পরের কথা। আজকের এই ভাঙা সময়কে কি তুমি জোড়া লাগাতে পারবে, অশোক? এই ডেমোক্রেসির ডিম ফুটে তো ছানা বেরিয়ে গেছে। তাকে এখন তুমি আটকাতেও পারবে না, মেরেও ফেলতে পারবে না।
ধ: (ম্লান হাসিয়া) আমি মারব না। এর মরার প্রয়োজন হয় না। তুমি সেদিন বলছিলে না, ধর্মের চাকা আসলে কালের চাকা, রেভলিউশন মানে আসলে আবর্তন? … এই দেশটাকে দেখে আমার সেই ফিনিক্স পাখিটার কথা মনে হয়। বুড়ো, পালক-ওঠা, কুৎসিত। এখন নিজেই নিজের পালক খুঁটে খুঁটে তুলে ফেলছে। এবার একদিন দপ্ করে জ্বলে যাবে। – আর তারপর…
চ: তারপর আত্মদীপ। কিন্তু যারা যাবে, তারা যে আর ফিরবে না ভায়া। এই আমাদের বেথ্লহেম, এই আমাদের গলগোথা।
========================