“And the thing she wanted most to do was plant flowers—flowers that might bloom in the light. She did plant them, ordering bulbs and seeds from the East. The light brought them up, and then the wind tore them from her. The dirt she could hold her own with, sweeping it away each morning, but the wind was endless and fierce. It renewed itself again and again, curling out of the north to take her flowers from her, petal by petal, until nothing remained but the sad stalks.”
৭
ছাত্র পড়ানো অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। বাগান করার মধ্যে যে বিস্ময় থাকে তা এতেও পাওয়া যায়, যদিও তা পেতে গেলে তার যোগ্য হওয়া চাই। ভালোমন্দের ওজন করতে গেলে চলে না। মানুষ বাড়তে বাড়তে কীরকম বদলাতে থাকে, তাই দেখে যাওয়া।
ঈশিতা সিং বলে এক মেয়ে ছিল। দু’বছর আগে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন সে ক্লাস এইটে, আর আমি পড়াই ক্লাস সিক্স-সেভেনে। আমার সাথে আলাপ হয়েছিল অ্যানুয়াল কনসার্টের প্র্যাক্টিস করাতে গিয়ে। ঈশিতা কমপেয়ারদের একজন ছিল।
ঈশিতা ছিল মনিটরমার্কা মেয়ে। দায়িত্ববান, নেতাসুলভ, এবং টীচারদের কাছে পরিচিত মুখ। আমার প্রথমটা ভালো লাগলেও শিগগিরই খচখচানি শুরু হল, কারণ টের পেলাম যে ঈশিতা শুধু মনিটরমার্কা নয়, প্রবলভাবে প্রো-সিস্টেমও। নিয়মই সত্য এবং সত্যই নিয়ম, এই তার মনের ভাব। নিয়ম নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা যায় এবং সেই প্রশ্ন তোলা যে খুবই উচিত, এই ধারণার নিতান্ত অভাব। আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। ঈশিতা খুব ভালো লীডার হবে সন্দেহ নেই, তবে ভিশনারি যে হবে না সেই নিয়েও নিঃসন্দেহ থাকা যায়। কনফিডেন্ট বোকাদের ব্যাপারে আমি বরাবরই অধৈর্য্যশীল, ঈশিতা ছাত্রস্থানীয় হলেও ওকে পড়াই না, সুতরাং কোনো চেষ্টা-আত্তি করারও প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং, খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছিলাম।
মাঝেমাঝে দেখা হত, নানারকম অনুষ্ঠানে ‘দায়িত্বশীল’ কাজে দেখতে পেতাম। প্রতিবারেই মনে হত, ‘a waste of a good girl.’ (আমি কিছু লোককে চিনি যারা আমার এই জাজমেন্টাল মনে-হওয়া নিয়ে খুব ছিছি করবে, কিন্তু তারা নিজেরা যেহেতু বড়ো বাল, তাই তাদের ছিছিতে কিছু আসে যায় না। আর এই লাইনটা টাইপ করলাম কারণ অপছন্দের লোককে খিস্তি করতে আমার খুব ভালো লাগে, সে নাম না নিয়ে করলেও।)
এই বছর ক্লাস টেনে উঠে ঈশিতা আমার ইংরেজী ক্লাসে পড়েছে। সেই এক স্বভাব। প্রবল নিয়মভক্ত, প্রবল সিস্টেমভক্ত, প্রবল গভর্নমেন্টভক্ত। মোদী অ্যান্ড কোম্পানীর লক্ষ লক্ষ তরুণ ফ্যানদের মধ্যে একজন। তার ওপর মুশকিল হল ঈশিতা মোটেই বই পড়ে না। কক্ষনো বই পড়ে না, ঈশিতার বন্ধুরা জানে ঈশিতা বই পড়ে না, ঈশিতা যে বই পড়ে না এটা ব্যাচের সর্বজনীন সত্যগুলোর মধ্যে একটা। এদিকে ডিবেট, মডেল-ইউনাইটেড-নেশনস (MUN), রচনা লেখা – এসবের মধ্যে হরদম লেগে আছে। পড়ার মধ্যে কাগজ পড়ে। এরকম মেয়েকে এখন কুয়োর মধ্যে থেকে বার করি কী করে? — কিন্তু এখন তো আর ‘আমি পড়াই না, আমার দায়িত্ব নয়’ বলে ছেড়ে দেওয়া যায় না! আমার ক্লাসে আছে। তাই যখন পারতাম তখনই দু’এক কথা বলতাম। সে ঠেলা হোক, খোঁচা হোক, যাই হোক না কেন।
একদিন ক্লাসের বাইরে ডেকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছিলাম, কেন বই পড়তে বলি। কেন ফিকশন পড়া দরকার। ভবিষ্যতের লীডার হতে গেলে কেন অবশ্যই ফিকশন পড়া দরকার। কেন না পড়লে তার পরিণাম সর্বনাশা। ওর জন্যে না হলেও, ও যাদের লীড করবে, তাদের জন্য।
বছর যেতে যেতে আমি একটা অদ্ভুত, প্রায় অবিশ্বাস্য জিনিস আবিষ্কার করি। ঈশিতার লেখার হাত অদ্ভুত ভালো। এমন নয় যে ওর লেখা পড়লে মনে হয় প্রতিভার সান্নিধ্যে আছি, – সেরকম আশ্চর্য সুন্দর কিছু নয়। কিন্তু তাও, ক্লাসের সেরা লিখিয়েদের মধ্যে ঈশিতা একজন। কোনোদিন বই পড়ে না বলে যে মেয়ের নাম, তার হাত দিয়ে এইরকম লেখা বেরোনো সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস ছিল না।
ক্লাসে পড়ার সময়েও দেখেছি, ঈশিতার ভাষা বা সাহিত্য বোঝার ক্ষমতা খুব ভালো। যেটা ছোটো থেকে বই পড়ার অভ্যাস থাকলে তৈরী হয়। এ বই পড়ে না, তা সত্ত্বেও কোনোভাবে এর মধ্যে জিনিসটা তৈরী হয়েছে।
আমিই অবশ্য একবার ওকে বলেছিলাম, বই পড়তে ভালো না লাগলে পড়িস না। গল্পের সাথে মিলজুল হওয়াটাই আসল। সেটা বই মারফত হল না স্ক্রীন মারফত, সেটা সেকেন্ডারি ব্যাপার।
এখন ঈশিতা আর দু’বছর আগেকার ঈশিতা নেই। এখন আর সিস্টেমকে প্রশ্নহীন আনুগত্যের সাথে মেনে নেয় না। দেশপ্রেম আর রাজভক্তিকে এক করে দেখে না। জাতীয়তাবাদকে মানবতাবাদের সহোদর বলে ভাবে না। মানবতাবাদকেও সবার উপরে বসানোর দরকার মনে করে না। ঈশিতা এখনও মনিটর, কিন্তু এখন দেখে মনে হয় ঈশিতা নিয়মকে ব্যবহার করছে। একসময় ছিল যখন ঈশিতাকে নিয়ম ব্যবহার করত। আমার দেখে ভালো লাগে।
যে শাসক, তার মধ্যে বিষাদ থাকা উচিত। কেন তা বলতে পারব না। কিন্তু শাসক হতে গেলে অনেককিছুকে গলা টিপে মেরে ফেলতে হয়। সেই বিষাদ মানুষের ভেতরে রয়ে যাওয়া উচিত। যদি না থাকে, তাহলে সেই শাসক মানুষ থেকে আস্তে আস্তে দানব হয়ে যায়।
৮
আমার ক্লাসে একটি ছেলে আছে, নাম আভাস কালিয়া। এই বালকের জীবন অতি দুঃখের, সেই কথাই এখন শোনাব।
আভাস কালিয়া ভালো ছেলে। পড়াশোনা করে, নিয়ম মানে, কাজ দিলে সে কাজ দায়িত্ব সহকারে পালন করে, ডিবেট করে, MUN করে। এই সমস্ত গুণের জন্য সে স্টুডেন্টস কাউন্সিলের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছে, – সাদা বাংলায় যাকে বলে মনিটর, বিদ্যাপীঠে বলত সেবক।
স্কুলের ইউনিফর্ম কোড খুব কড়া, এসব প্রাইভেট স্কুলে এসমস্ত ঘটা থাকেই। চুলের মাপ ছোট, মেয়েদের ডাবল বিনুনি বা ডাবল ঝুঁটি, এবং স্কুলের নিজস্ব মোজা আর স্কুল-অ্যাপ্রুভড কালো জুতো পরে আসা চাই, তা না হলে বড় ম্যামের খ্যাঁকানি জুটবে। মাঝেমাঝেই মনিটরদের দেখা যায় ক্লাসে ঘুরে ঘুরে চেক করছে, কার জুতোমোজায় গণ্ডগোল আছে।
এখন ঘটনা এই যে আভাস অত্যন্ত লম্বা। ক্লাস নাইনে পড়ে, এখনো হাইট বাড়ার বছর চার-পাঁচ বাকি আছে, কিন্তু আভাস ইতিমধ্যেই ছয় ফুট ছাড়াচ্ছে। বালকের আদি নিবাস পাঞ্জাব, সে টিঙটিঙে তালঢ্যাঙা নয়, রীতিমতো লম্বাচওড়া চেহারা। বিদ্যাপীঠে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র রাহুলদা ছিল খুব লম্বা, এবং রাহুলদার বাবা-মাকে দেখলে বোঝা যেত যে রাহুলদা নেভার হ্যাড আ চয়েস অ্যাবাউট বিইং লম্বা, মেন্ডেলের ভাষায় দু’দিকেই “TT”। আভাসের সেরকম নয়, বাবা-মা দু’জনের চেয়েই ছেলে অনেক লম্বা।
সমস্যা হল আভাস এতটাই লম্বা যে তার পায়ের সাইজের জুতো এই দেশে পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় যে সাইজ দোকানে পাওয়া যায় তা মাপসই হয় না। আমেরিকায় আভাসের উপযুক্ত জুতো পাওয়া যায়, বাবা-মা অর্ডার দিয়ে সেখান থেকে ছেলের জন্য জুতো আনান। (এই লাইন পড়ে আঁতকাবেন না। এঁয়ারা আমার-আপনার মতো গরীব বাংগালি নন, দস্তুরমতো ফার্মহাউস-টাউস আছে।) সুতরাং আভাসের যখন নতুন জুতোর দরকার হয়, তখন সেটা আসতে দিনকতক সময় লাগে। আগে থেকে কিনে রাখার প্রশ্ন উঠছে না কারণ আভাসের এটা বাড়ের বয়স। ওই মাঝের কয়েকদিন আভাসকে চপ্পল পরে আসতে হয়।
পুরো ব্যাপারটার রেজাল্ট হল, আভাসের জুতো ইস্কুল-অ্যাপ্রুভড ডিজাইনের হওয়া অসম্ভব। স্কুলের জুতো যেখান থেকে কেনা হয় তাদের ওই সাইজ তৈরীই হয় না। আর চপ্পল-দশাও অনিবার্য, যতদিন না বিদেশ থেকে জুতো এসে পৌঁছচ্ছে ততদিন চটিই পরে আসতে হবে, অন্য জুতো দিয়ে চালানো যাবে না।
সুতরাং আভাস কখনোই কাউকে নিষিদ্ধ জুতা পরার জন্য গ্রেফতার করতে পারে না। করিলেই লোকে বলিবে, “লুক হু’জ টকিং।”
৯
স্কুলে অ্যানুয়াল কনসার্ট চলছে, একই অনুষ্ঠানের দিনে তিনটে শো। দুপুরের শো শেষ হয়েছে, যারা পারফর্মার তারা এবার গুটিয়েপাটিয়ে বাড়ি ফিরবে। এদিকে সন্ধের শোয়ের কুশীলবেরা একে একে এসে হাজির হচ্ছে। ঘড়িতে প্রায় চারটে, তেসরা শোয়ের বাচ্চাদের রিপোর্টিং টাইম সাড়ে চারটে, শো শুরু (হওয়ার কথা) সাড়ে ছ’টায়। আমি ততক্ষণ থাকব না, চারটে পঁচিশের বাস ধরে ফিরব। আমার ক্লাসের অক্ষত, অনুষ্কা আর ঋদ্ধির দুপুরে শো ছিল, ওরাও এখন ফিরবে। ঋদ্ধি আমাকে খুঁজছিল। আমি পিঠে ব্যাগ নিয়ে
আমি পিঠে ব্যাগ নিয়ে নীচে নামছিলাম। লিফটে নামতে পারতাম, কিন্তু সিঁড়ি নেওয়াটা বেটার কারণ বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার চান্স বেশী থাকে, বেরোনোর আগে আমারগুলোকে গুডবাই করে যেতে চাই। নামতে নামতে সিঁড়িতে দেখি ঋদ্ধি ওপরে উঠছে, এমন সময় মুখোমুখি পড়ে আমরা দু’জনেই ‘এইত্তো!’ মার্কা হেসে ফেলেছি। জীবনে প্রথমবার স্টেজে অ্যাঙ্করিং করল আজকে, এবং যত লোক দেখেছে সবাই বলেছে খুব সুন্দর করেছে। ওর নিজের কিন্তু ধারণা ছিল ওর স্টেজ ফিয়ার আছে, নির্ঘাত ছড়াবে ধরে নিয়ে বাড়িতে বলে দিয়েছিল দেখতে এসো না। শুধু শোয়ের শেষে নিতে আসবে। এই ঋদ্ধিই ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’
এই ঋদ্ধিই ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ দেখে আমাকে বলেছিল, স্যার আপনি কি এরকম কোনোকিছু খুলবেন। যদি খোলেন, আমি তাতে থাকতে চাই। – যে কয়েকটা প্রতিশ্রুতি আমার সারাজীবন মনে থাকবে, তার মধ্যে ঋদ্ধির ওই কথাটা একটা। আমি বললাম, চল নীচে যাই। আমি তো বাস ধরব। তুই বাড়ি যাবি না? ঋদ্ধি জানাল ওর বাড়ির লোক পৌনে পাঁচটার আগে আসছে না। আপাতত বোর হচ্ছে, তাই আমাকে খুঁজছিল। আমি বললাম, আমি বাস ধরব ভাবছিলাম তো। তাহলে কি থেকে যাব? বলল না স্যার, আপনি যান। আমি বললাম আরে যদি চাস থাকি তো বল। পরের বাস ধরে নেব। তখন বলল তাহলে স্যার থাকুন। আমি বললাম, আচ্ছা। ভালোই হল, আমাদের একটা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার ছিল, কী প্রসঙ্গ বলা বারণ আছে কারণ সমিতির প্রথম নিয়ম হচ্ছে সমিতি সম্পর্কে কথা বলা যাবে না। সেই আলোচনা করে আধঘন্টা দিব্যি কেটে যাবে। – কিন্তু তার দরকার হল না, নীচে নেমে দেখি
নীচে নেমে দেখি রিয়া এসেছে। এই রিয়া আর ঋদ্ধি পার্টনার। রিয়া হচ্ছে মডেল ছাত্রী, হাতের লেখা থেকে শুরু করে আনতাবড়ি কেমিস্ট্রির ফর্মুলা, সবকিছুতেই চরম। এবং অতিশয় সুশীলা বালিকা, ভালো মেয়ে বলে সবাই চেনে। কিন্তু আমি আরো কিছু বেশী চিনি, কারণ আমার ক্লাসের মেয়ে, আমি যাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশী গল্প করি তাদের মধ্যে রিয়া পড়ে। রিয়া গত কিছুদিনের মধ্যে ‘দ্য টার্মিনেটর’ আর ‘টার্মিনেটর টু: জাজমেন্ট ডে’ দেখেছে। আমি দেখতে বলেছিলাম, তা সে সিনেমা-টিনেমা দেখে ফিরে এসে আমাকে আপডেট দিয়েছে যে ওর বাবা আর্নল্ডের ফ্যান। এবং ফেভারিট মুভি কী জিজ্ঞেস করলে টার্মিনেটরের নাম করছে। টি:টু দেখার পরের দিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “লাস্টের থাম্স-আপ সীনটায় কেঁদেছিলি?” উত্তর যা ভেবেছিলাম তাই, – “হুঁ।” রিয়া আবার মমতা ব্যানার্জীর
রিয়া আবার মমতা ব্যানার্জীর র্যাপ শুনে বলেছিল, দিস ইজ দ্য বেস্ট থিং ইন মাই লাইফ। – তাই বলছিলাম, রিয়াকে আমি ‘ভালো মেয়ে’-র চেয়ে আরো কিছু বেশী হিসেবে চিনি। তো রিয়া এসেছে, এদিকে পাশের ক্লাসের জিনয় ভোরা, যে কিনা নাটকে চান্স পায়নি, কিন্তু পুরো নাটকের স্ক্রীপ্ট মুখস্থ, কোনো অভিনেতা বাই চান্স ডুব মারলে বা কাটা গেলে সেই জায়গায় তাকে বেমালুম জুড়ে দেওয়া যাবে বলে আশা করে আছে। এরা, আরো গোটা দুই মেয়ে, আমরা দাঁড়িয়ে আছি প্রিন্সিপালের অফিসের একদম সামনেটায়, ভেতরে কেউ আছে কিনা কেউ জানে না, বিশেষ মাথাও ঘামাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। সবাই কনসার্টের এটা-সেটা নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত। প্রিন্সিপালের অফিসের সামনের রিসেপশনে মকবুল ফিদা হুসেন
প্রিন্সিপালের অফিসের সামনের রিসেপশনে মকবুল ফিদা হুসেনের একটা পেন্টিং-এর কপি ঝোলানো, সেটা যে নকল, তাই নিয়ে জল্পনা চলছে। এমন সময় কী থেকে খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গ উঠল, তখন ঋদ্ধি বলে, স্যার, আমাদের জৈনদের একটা ফেস্টিভ্যাল আছে, নাম ‘ওলা’। আমি বোনা ফাইড হারামজাদা বলে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আরে আমাদের বাঙালীদের একটা ফেস্টিভ্যাল আছে, নাম ‘উবের।’ তাইতে চারজন মেয়ে একজন ছেলে একসঙ্গে সবাই হেসে উঠল। আস্তে আস্তে সন্ধের অ্যাক্টর আর ডান্সাররা সবাই জুটছে। আমার ক্লাসের গুটিকয় মেয়েকে দেখলাম, হলুদ কস্ট্যুম পরিয়েছে, পঞ্জাবী ডান্স আছে ওদের, সেই পোশাক। লোকে যে ভাবে নাচ-টাচের ড্রেসে সেজেগুজে এলে মেয়েদের ভোল ম্যাজিকালি পালটে পরীর মতো হয়ে যায়, – এটা একদম বাজে কথা। সোফিয়া আর সিদ্ধিকে এমনিতে ক্লাসে যথেষ্ট ডিসেন্ট দেখায়, কিন্তু এই কস্ট্যুমে ওদের একদমই মানায়নি এবং অত্যন্ত হাস্যকর দেখাচ্ছে, আমরা তাকিয়ে আছি দেখে পান্তুয়ার মতো মুখ করে পাশের ঘরে ঢুকে গেল। এদের সঙ্গে আমি আরো ঘন্টা চারেক
এদের সঙ্গে আমি আরো ঘন্টা চারেক কাটিয়ে দিতেই পারতাম, কিন্তু নাঃ, একটু রেস্ট দরকার বাড়ি ফিরে, কাল আবার কনসার্ট আছে। তাই বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু বাসে ফিরতে ফিরতেও যে জিনিসটা বার বার মনে পড়ছিল আর ভাবছিলাম বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব, সেটা হল ওই পাঁচজনের একসঙ্গে হেসে ওঠার আওয়াজটা। আসলে প্রিন্সিপালকে
আসলে প্রিন্সিপালকে সবাই খুব ভয় পায়। ওই অফিসের আশপাশে সবাই কথা বলে গলা নামিয়ে, হাঁটে আস্তে, থামে ধীরে। ভেতরে যারা বসে তারা সবাই কর্পোরেট পণ্ডিতমূর্খ, তাদের চেম্বার কাঁচ-আঁটা, তাদের অ্যালুমিনিয়াম জীবনও কাঁচ-আঁটা। সেই দরজাটার সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় হঠাৎ যখন ছেলেমেয়েগুলো সমস্বরে হেসে উঠল, – আমি কেন জানি এক খণ্ডমুহূর্তের জন্যে একটা ঝলসানি টের পেয়েছিলাম, একটা বিদ্যুৎ, একঝলক একটা সূর্যের মতো, উঁকি দিয়েই লুকিয়ে পড়া ঝকমকে কী যেন একটার মতো। আমি কেমন যেন টের পেলাম, ওদের হাসির শব্দটা শার্সি-ভাঙা বলের মতো বেমানান, উটকো হয়ে ওই অফিসের ভেতর পৌঁছেছে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, কিন্তু আমি বাঘের গন্ধ পাওয়ার মতো সেই ঝলসানিটা দেখতে পেয়েছিলাম। – এর পেছনে আরো গল্প আছে, সে কথা আবার পরে লিখব। এখন আমাকে আরো তিনবার হুইস্কি ইন দ্য জার শুনতে হবে, আর লেখার সময় নেই।
১০
ঈশিতা সেদিন জিজ্ঞেস করছিল, “কিন্তু আপনি স্কুলটীচার হলেন কেন। মানে আরো এত কিছু থাকতে টীচার হলেন কীজন্য।”
এর প্রচুর উত্তর আছে, আমরা যা, আমরা কেন তা – সেটা অনেকরকম আপতনের টানাটানি আর ঠোকাঠুকির ফল। আমি কেন টীচার হলাম সেটাও সেরকম অ্যাক্সিডেন্ট অফ রীজনস। কিন্তু না হলে ভালো হত। আমি বললাম, “কেন হলাম সেসব তো লম্বা গল্প। কিন্তু হয়েছি বলে এখন আফসোস হয়।”
ক্লাসে বহুবার বলেছি, “টীচার হোস না। ডোন্ট বী আ টীচার ইন ইন্ডিয়া।” অবশ্য ইন্ডিয়া শুধু না, বিদেশেও অবস্থা এরকমই, অন্তত আমাদের প্রিয় বিদেশ আমেরিকার বেশ কিছু গল্প প্রতিদিন শুনতে পাই। একই পরিস্থিতি।
কিন্তু কোনো ছাত্র যদি সত্যিই কখনো জিজ্ঞাসা করে, টীচারি করতে গেলে কী করব, ভালো টীচার হতে গেলে কী মনে রাখব, – সেই প্রশ্নেরও সুদীর্ঘ উত্তর মনের ভেতরে রাখা আছে। যত দিন যায় তত অল্প অল্প রদবদল হয়, কিন্তু মোদ্দা কথাটা একই থাকে।
শিক্ষকতা শব্দটা আমার পছন্দ হয় না। বড্ড বেশী ওজন শব্দটায়। একদিকে তাতে মানুষের শ্লাঘা বাড়ে, অন্যদিকে সমাজ এই ট্যাগটার সুযোগ নিয়ে তার ওপর মহাপুরুষত্বের দায় চাপায়।
কিন্তু শিক্ষকের অসীম ক্ষমতা থাকে। অসীম বলছি এইজন্য কারণ সে তার ছাত্রদের মধ্যে দিয়ে সত্যিই সীমাহীন বিস্তৃতি পেতে পারে। শিক্ষকতা সবচেয়ে ফান্ডামেন্টাল কাজ। ওটার জায়গা ঠিক থাকলে পৃথিবীর অধিকাংশ সমস্যা সোজা হয়ে যায়। – এটা গেল থিওরির কথা, কিন্তু প্র্যাকটিকালিও যদি ভাবি, তাহলেও এটা মিথ্যা হয়ে যায় না।
সমাজে টীচারির দাম যে আজকে এত কম, টীচারদের অবস্থা যে এত খারাপ, – এটা ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরী করা একটা পরিস্থিতি। ম্যান-মেড-ফেমিনের মতো।
আমার কাছে ধর্ষণ কমানোর একটা খুব ভালো সমাধান আছে। স্কুলটীচারিকে টপ প্রোফাইল জবে রূপান্তরিত করুন তো দেখি। টপ ক্লাস বাছাইব্যবস্থা, টপ ক্লাস সুযোগসুবিধা, টপ ক্লাস মাইনে, টপ ক্লাস সোশ্যাল স্টেটাস।
তারপর দেখবেন ব্রাহ্মণদের টপে রাখলে কেন সেটাকে সত্যযুগ বলে।
১১
এক স্কুলের বন্ধু – যার সাথে স্কুল পাশ করে বেরোনোর পর থেকে যোগ নেই – একদিন হঠাৎ মেসেজ করল, কী করছিস? অটোয় চাপাচাপি বসে আছি হাতে মোবাইল নিয়ে, হঠাৎ আন্তরিক মেসেজ। কেন হঠাৎ মেসেজ করে কে জানে, পুরোনো বন্ধুত্বের টানে বোধহয়, আমি স্কুলটীচারি করি সেটা জানত, সম্ভবত শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করার বাই উঠেছিল। আমি মেসেজ পেয়ে পুরোনো বন্ধুত্বের টান অক্ষুণ্ণ রেখে রিপ্লাই দিলাম, ‘মাস্টারবেট।’ ব্যাস, পাতলা কাপ মাটিতে পড়ে চুরমার।
লম্বা লম্বা মেসেজে মোটামুটি যা বলে পাঠাল তার সারার্থ হচ্ছে এই যে আমি এরকম নোংরা কথা কেন বললাম, বিশেষ করে একজন শিক্ষক হয়ে এইরকম কথা আমি মুখে আনলাম কী করে, এটা কি একজন শিক্ষককে মানায়? – আমার ঝগড়ার ভ্যাজরভ্যাজর ভালো লাগে না, আমি সংক্ষেপে কথা শেষ করে গুডবাই জানিয়ে দিয়েছিলাম। কেন, ঠিক-বেঠিক, রীজন-জাস্টিফিকেশন কোনোকিছুই দর্শানোর প্রয়োজন দেখিনি।
গত পোস্টের কমেন্টেও একই ব্যাপার ঘটেছে, কিন্তু এটা অপরিচিতের সাথে। কেন যে লোকে ভদ্রতা আশা করে বুঝিনা। “মানুষ হারামি” বলে যে পোস্ট দিই, তাতে লাইক মেরে লোকে ভাবে আমি বড় ভালো, এ শালা আচ্ছা মুশকিল! কিন্তু প্রসঙ্গ সেটা না। এইসবের অবতারণা করছি ওয়ার্নিং হিসাবে। কারণ ক্লাসে আপাতত যা চলছে সেটা শুনলে আবার অনেকের আমার নামে থানাপুলিশ করার ইচ্ছে হতে পারে।
সিবিএসই-র টেনের বইয়ে যেক’টা কবিতা আছে, তার মধ্যে চারটে আমার বিশেষ যত্নের পাত্র। যত্ন এইজন্য যে কবিতা চারটে একটু চ্যালেঞ্জিং, শুধু বুঝতে কঠিন বলে নয়, তার চেয়ে বড় কথা হল বুঝলে পরে আরোই কঠিন অবস্থা হয়। কবিতাগুলো হল ওয়াল্ট হুইটম্যানের “অ্যানিম্যালস”, ইয়টসের “ফর অ্যান গ্রেগরি”, এড্রিয়েন রিচের “দ্য ট্রীজ”, আর জন বেরিম্যানের “দ্য বল পোয়ম”।
এগুলো নিয়ে টেনে যা হবার হয়েছে। কিন্তু আগেই বলেছি যে নাইনে এদের ইংরিজীর চাপ কম, তাই আমার নাইন-এফে আনঅফিশিয়ালি আমি এই চারটে কবিতা নিয়ে একটু আলুচানা ফাঁদার চেষ্টা করছি।