পুরানো সেই দিনের কথা (৩) – “হাঁটি-হাঁটি পা-পা”

 
  যা চলে যায়, তা আর ফেরে না – এই প্রকৃতির নিয়ম। ডাইনোসরদের দিন গিয়েছে। যে থেরোপডরা একসময় পৃথিবীর রাজা ছিল, তারা আজ পাখি হয়ে রয়ে গেছে, দ্বিতীয় সারির জীব হয়ে। অতীতের সাক্ষ্য দেয় শুধু পাথর-হয়ে-যাওয়া হাড়। সময়ের নিয়ম, সবাই আসে, সবাই যায়। যারা গেছে তারা ফেরে না। 
 
কিন্তু মানুষ তো চিরকালই নিষিদ্ধ স্বপ্ন দেখে এসেছে, নিয়ম দেখিয়ে কবেই বা তাকে রোখা গেছে! প্রমিথিউস-ইকারাসের রক্ত বইছে যাদের শরীরে, তারা তো অসম্ভবকে চ্যালেঞ্জ জানাবেই। বেশীদিন আগেকার কথা নয় – কয়েকজন বিজ্ঞানী একটা প্রজেক্ট হাতে নিলেন। তাদের লক্ষ্য, চার হাজার বছর আগে চিরবিদায় নেওয়া Mammuthus primigenius-কে আবার এই পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনবেন।

 
 
ঊলি ম্যামথের যে হাড় আর দাঁত আমরা পেয়েছি, তা ফসিল নয়। ফসিল হলে তা আর হাড় থাকে না, পাথর হয়ে যায়, হাড়ের আকৃতিটুকু শুধু থাকে। কিন্তু ঊলি ম্যামথ আমাদের হলোসীন যুগের প্রাণী, তার হাড় এখনো হাড়ই আছে। সেই হাড় থেকে বিজ্ঞানীরা খুব, খুব সামান্য মাত্রায় টিকে থাকা জৈব পদার্থ উদ্ধার করতে পেরেছেন। জৈব পদার্থ মানে এখনো কোনোক্রমে রয়ে যাওয়া রক্ত বা মাংস, মোটামুটি অক্ষত কোনো কোষ, বা অন্তত কোষের নিউক্লিয়াসটুকু। নিউক্লিয়াসটুকু থাকলেই তার মধ্যে পাওয়া যাবে DNA, আর ডি এন এ পাওয়া মানেই আসল ব্লু – প্রিন্ট হাতে পাওয়া। ঊলি ম্যামথের ম্যামথ হওয়ার সমস্ত রেসিপিটা ওই ডি এন এ-র মধ্যে জীনে-জীনে রেকর্ড হয়ে আছে। তাই যেমন করে হোক – ডি এন এ উদ্ধার করা চাই। করাটা অসম্ভব নয়, কেননা বরফের মধ্যে যেসব ম্যামথের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, সেগুলো খুব একটা বিকৃত হয়নি। 
 
ডি এন এ পাওয়া যাচ্ছিল, তবে টুকরো টুকরো; শুধু তাই দিয়ে আস্ত একটা প্রাণী বানানো সম্ভব নয়। আস্ত প্রাণী বানাতে গেলে তার জীনের পুরো সেটটা চাই, একটা আস্ত genome চাই। পুরোনো ম্যামথের টিস্যু থেকে তা পাওয়া দুঃসাধ্য দেখে  হার্ভার্ডের গবেষক জর্জ চার্চ অন্য রাস্তা ধরলেন। ম্যামথের যে নিকটতম আত্মীয় এখনও বেঁচে আছে, সে হল এশিয়ান এলিফ্যান্ট – আমাদের ভারতীয় হাতি। হাতির তাজা কোষ থেকে চার্চ তার জীনোম বার করলেন, করে তার মধ্যে বিশেষ বিশেষ জায়গা কেটে বাদ দিয়ে সেখানে ম্যামথের জীনের টুকরো জোড়া লাগাতে লাগলেন। হাতি যেহেতু ম্যামথেরই মতো, তাই তাদের জীনের বেশীরভাগটাই একইরকম। শুধু কয়েকটা জায়গা আলাদা – ম্যামথের লম্বা লোম, শীত-সওয়া রক্ত, গা গরম রাখতে বাড়তি চর্বির স্তর – এগুলোয় হাতির সাথে তার তফাৎ। চার্চ বেছে বেছে সেই পার্থক্যের জায়গাগুলোয় হাতির জীন সরিয়ে ম্যামথের জীন বসালেন। – এক্সপেরিমেন্টটা উতরেও গেল, এই edit করা পূর্ণাঙ্গ জীনোম পরীক্ষা করে দেখা গেল, তা থেকে ম্যামথের মতো লোম, রক্ত, চর্বির স্তর পাওয়া যাবে। 
 
কিন্তু জোড়াতালির দরকার হল না। দু’হাজার পনেরোর এপ্রিলে, সুইডিশ মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির বিজ্ঞানী ডঃ লাভ ড্যালেন বিবিসির এক রিপোর্টে জানালেন – তাঁদের টীম ম্যামথের সম্পূর্ণ জীনোম তৈরী করতে পেরেছে। পুরো ডি এন এ সিকোয়েন্স উদ্ধার করা গেছে। ‘কারেন্ট বায়োলজি’ জার্নালে তাদের সেই স্টাডি প্রকাশিত হল। ম্যামথকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ড্যালেনরা গবেষণা করছিলেন না, কিন্তু পুরো জীনোম পত্রিকায় বেরোনোর পর সান ফ্রানসিসকোর অন্য একদল বিজ্ঞানী জানালেন, তাঁরা ম্যামথকে ফিরিয়ে আনতেই চাইছেন। হয়তো পুরোপুরি আসল ম্যামথ নয়, – এশীয় হাতি আর ম্যামথের হাইব্রিড। এই হাইব্রিড বানিয়ে তুন্দ্রা অঞ্চলের অরণ্যে ছাড়া হবে। তাঁরা ম্যামথের ডি এন এ নিয়ে, চিড়িয়াখানার পোষা হাতির গর্ভে তা স্থাপন করে, – সেই মা হাতিকে নতুন ম্যামথের ধাত্রী হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবছেন।
 
স্বাভাবিকভাবেই বির্তক উঠেছে। অনেকেই এইধরনের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কারণ দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং বেথ শাপিরো, যিনি ‘How to Clone a Mammoth’ বইটির লেখিকা। বেথ বলছেন, হাতিরা এমনিতেই বন্দীদশায় ভালো থাকে না, কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় প্রজনন তাদের পক্ষে আরও কঠিন হয়। একটা হাতিকে এভাবে জোর করে গর্ভে ম্যামথ নেওয়ানোটা নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছুই না। তাছাড়া, হাতিরা যূথবদ্ধ প্রাণী, সবসময় তারা দল বেঁধে থাকে। ম্যামথরাও তাই ছিল। একটা ম্যামথকে একলা জন্ম নিতে বাধ্য করা মানে তাকে বাঁচিয়ে তুলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। করতে হলে পুরো একটা দলকে তৈরী করা দরকার, নইলে একটাকেও নয়। দল তৈরী করলেও, তাদেরকে কে বড় করবে, একবয়সী একদল ম্যামথ – যাদের কোনো ম্যামথ অভিভাবক নেই – তাদেরকে কে নেতৃত্ব দেবে, এগুলোও বড় প্রশ্ন। হঠকারীর মত না ভেবেচিন্তে কোনো প্রাণীকে এভাবে ফিরিয়ে আনা সমর্থন করা যায় না। – ‘প্রগতিশীল’ বিজ্ঞানীরা অবশ্য এসব বিতর্কে কান দিচ্ছেন না। তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, ২০১৮ নাগাদ ম্যামথ ক্লোনিং-এর কাজ শুরু করে দেওয়া হবে।
 
কিন্তু ম্যামথই de-extinction-এর একমাত্র ক্যান্ডিডেট নয়। ২০০৮ সালের কথা, মনটানার জীবাশ্মবিদ জ্যাক হর্নার ফসিলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করতে করতে একটা টী-রেক্সের কঙ্কাল খুঁজে পেলেন।
 
ফসিল জিনিসটা ঠিক হাড় নয়। দু’তিন রকম ভাবে ফসিল হতে পারে। এক হয় trace fossil। দু’হাজার চোদ্দো সালে জয়সলমীরে তিরিশ সেন্টিমিটার লম্বা টেরোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া যায়। নরম মাটিতে পড়া পায়ের ছাপ কোটি কোটি বছরে জমে পাথর হয়ে অবিকৃত থেকে গেছে। টেরোসর উড়ুক্কু সরীসৃপ, ঠিক ডাইনোসরদের মধ্যে না পড়লেও তাদেরই সমসাময়িক। এখানে টেরোসরের শরীরের কোনো অংশ পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে তার পায়ের ছাপ। এই ধরনের ফসিল, যা প্রাণীর শরীরের অংশ নয়, কিন্তু তার ক্রিয়াকলাপের চিহ্ন ধরে রেখেছে, তাকে বলে ট্রেস ফসিল। আর যদি শরীরের অংশ বা গোটা শরীরটাই পাওয়া যায়, তাহলে তাকে বলে body fossil। বডি ফসিল আবার নানাভাবে হতে পারে। বরফে জমে গিয়ে হতে পারে; অ্যাম্বারের মধ্যে সংরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে; মাটিতে চাপা পড়ে শরীরের ছাঁচ রেখে গিয়ে থাকতে পারে, বা হাড়গোড় জমে পাথর হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। আমরা সাধারণত এই শেষ ধরনটাকেই ‘ফসিল’ বলে জানি। এক্ষেত্রে, হাড় মাটিচাপা থাকাকালীন তার ভিতরে এমনভাবে খনিজ যৌগ জমে যে তাতে হাড়ের আকৃতি হুবহু বজায় থাকে। ভিতরের জৈব গঠন লোপ পেয়ে যায়, খাপে খাপ মিলিয়ে অজৈব খনিজ তার জায়গা নেয়। এর থেকে শুধু শরীরের কাঠামোটাই জানা যায়, তার বেশী কিছু নয়। জ্যান্ত প্রাণীটার কোনোকিছু প্রকৃতপক্ষে জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থাতেই অবশিষ্ট থাকে না। শুধু হাড়ের গড়ন থেকে বিজ্ঞানীরা তার মালিক সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন, – যেমন দাঁত দেখে বলা যায় সে ঘাসপাতা খেত না মাংস, পায়ের গঠন দেখে বলা যায় সে দু’পায়ে চলত না চারপায়ে।
 
জ্যাক হর্নার যে কঙ্কালটা পেলেন, সেটা এরকম এক ফসিল। বিরাট ভারী টী-রেক্সের কঙ্কাল, হেলিকপ্টারে তুলে গবেষণাগারে আনার সময় তার একটা থাইবোন দু’টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। তার  থেকে একটা টুকরো জ্যাক দিলেন তার ছাত্রী মেরী শোয়াইটজারকে। 
 
শোয়াইটজার ল্যাবে বসে হাড়ের টুকরোটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস তাঁর নজরে পড়ল। হাড়টার গায়ে এমন একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে, যা একমাত্র অন্তঃসত্ত্বা পাখিদের হাড়ে দেখা যায়। শোয়াইটজারের রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট ছিলেন জেনিফার উইটমেয়ার, – জেনিফারকে ডেকে তিনি বললেন, হাড়টার বাইরের খনিজ আস্তরণটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করতে, যাতে ভালো করে ভেতরটা দেখা যায়।
 
ছ’ঘন্টা পরে শোয়াইটজারের দরজায় টোকা পড়ল। প্রায় হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকেছে জেনিফার। ‘য়ু আর নট গোয়িং টু বিলিভ দিস।’
 
পরিষ্কার করতে করতে ফরসেপ দিয়ে জেনিফার হাড়ের ভিতরের একটা টুকরোয় টান দিয়েছিলেন। ফরসেপের টানে টুকরোটা ইলাস্টিকের মতো লম্বা হয়ে এল! 
 
ফসিলাইজ্‌ড হাড়ে নরম টিস্যু??? 
 
শোয়াইটজাররা তখুনি বুঝে গিয়েছিলেন, তারা অসম্ভবকে আবিষ্কার করেছেন। আটষট্টি মিলিয়ন বছর আগেকার ডাইনোসরের ফসিলে তাঁরা নরম টিস্যু খুঁজে পেয়েছেন। যার অর্থ – ডাইনোসরের ডি এন এ। ব্যাপারটা এখানেই থামল না। ওই টিস্যুর আশপাশ ভালো করে দেখতে গিয়ে তাঁরা আরও একটা জিনিস পেলেন – রক্তনালী। মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে দেখা গেল, যেন রক্তকণিকার মতো কী একটা দেখাও যাচ্ছে। ল্যাবের স্টোরে আরও অনেক ডাইনোসরের হাড় রাখা ছিল, এবারে সেগুলো বের করে খোঁজ আরম্ভ হল। অনেক চেষ্টার পর একধরনের কোষ মোটামুটি উদ্ধার করা গেল – যে ধরনের কোষ দিয়ে হাড় তৈরী হয় – osteocyte। তা থেকে অল্প ডি এন এ পাওয়া যেতে পারে।
 
কিন্তু এত কমে কাজ হবে না। যদি এইভাবে ডাইনোসরের পুরো জীনোম বানাতে হয়, অনন্তকাল সময় লাগবে। কাজেই জ্যাক হর্নার পুরো গেমপ্ল্যানটাই উল্টে দিলেন। ডাইনোসরের টিস্যু পাওয়া যত বড় যুগান্তকারী আবিষ্কারই হোক না কেন, dinosaur-engineering তা থেকে সম্ভব নয়। যদি ডাইনোসর বানাতে হয়, তাহলে তার পথ একটাই; আধুনিক প্রাণীর জীনের গতি উল্টোমুখে ফিরিয়ে দিয়ে retro-engineering-এর মাধ্যমে তাকে ডাইনোসর করে তুলতে হবে। আর ডাইনোসর হয়ে ওঠার জন্য আদর্শ সাবজেক্ট কে হতে পারে – আজকের থেরোপড পাখি ছাড়া? জ্যাক ঠিক করলেন, এমু পাখির জীনোমের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করবেন। ‘Emus have all the features we need in order to make a Velociraptor-sized dinosaur. If I were to make a dinosaur, that is where I’d start.’ 
 
 
এদিকে ক্যানাডার জীবাশ্মবিদ হান্স লারসন তাঁর ল্যাবে আর এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন। 
 
দু’দিন বয়সী একটা মুরগীর ভ্রূণ মাইক্রোস্কোপের তলায় স্টাডি করতে করতে একটা অপ্রত্যাশিত জিনিস তাঁর চোখে পড়ল। মুরগীর লেজে চার থেকে আটটা অস্থিখণ্ড থাকার কথা। কিন্তু হান্স দেখলেন, ভ্রূণটার শিরদাঁড়ায় লেজের অস্থিখণ্ড রয়েছে ষোলোটা। লেজে ষোলোটা ভার্টিব্রা পাখিদের শরীরে থাকে না, থাকে সরীসৃপদের শরীরে। হান্সের মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল, তিনি বাড়ন্ত ভ্রূণের ওপর নিয়মিত নজর রাখলেন। দেখা গেল, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভার্টিব্রার সংখ্যা কমে আসছে। শেষে যখন ডিম ফুটে মুরগীছানা বেরোল, তখন তার লেজে মাত্র পাঁচটা ভার্টিব্রা, আর পাঁচটা সাধারণ মুরগীছানার মতোই! 
 
মানেটা কী দাঁড়াল? – মানে দাঁড়াল এই যে আজ দেড়শো মিলিয়ন বছর পাখির জীনের গভীরে ডাইনোসরের নকশা লুকোনো আছে। পূর্ণবয়স্ক পাখির মধ্যে তা অনুপস্থিত হলেও, ভ্রূণ অবস্থায় তা লক্ষ্য করা যায়। হান্স এবার কাজে হাত লাগালেন। মুরগীর ডিমের মধ্যে সামান্য জেনেটিক রদবদল ঘটিয়ে তিনি লেজের ভার্টিব্রার সংখ্যা পাঁচ থেকে বাড়িয়ে আট করলেন সফলভাবে। পাখির গায়ে ডাইনোসরের লেজ দেখা গেল। 
 
তা, ল্যাজা যদি হতে পারে, তাহলে মুড়ো হবে না কেন?
 
ইংরেজীতে একটা বাগ্‌ধারা আছে, ‘as rare as hen’s teeth’। মানে যেমন ডুমুরের ফুল, এত বিরল যে দেখাই যায় না। সত্যিই, মুরগীর কি আর দাঁত হয়? পাখির শরীরের নিয়মই তো তাই – দাঁতের বদলে শক্ত ঠোঁট। ‘কিন্তু -‘, উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট হ্যারিস আর জন ফ্যালন বলতে চাইলেন, ‘- কিন্তু হবে না কেন?’
 
ম্যাট আর জন মুরগীদের মিউটেশন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। অনেক সময়ে শারীরিক বিকৃতি বা অসুবিধার জন্য মিউট্যান্ট প্রাণীরা ভ্রূণ অবস্থাতেই মারা যায়। এরকম একটা চোদ্দো দিন বয়সী মুরগীর ঠোঁটের মধ্যে ম্যাট একটা অস্বাভাবিক গঠন পেলেন। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা গেল, জিনিসটা সত্যিই দাঁত, অ্যালিগেটরের ভ্রূণে যেরকম দাঁত দেখা যায়, প্রায় হুবহু সেই জিনিস। ম্যাট আর জন এবার নিজেরা চেষ্টা করলেন, মুরগীর মধ্যে ঘুমন্ত দাঁত-তৈরীর জীনকে জাগানো যায় কিনা। স্বাভাবিক (মিউট্যান্ট নয়) একটা ভ্রূণের মধ্যে ওই জীন তাক করে একটা ভাইরাস প্রয়োগ করলেন। সেটা সুপ্ত জীনকে খোঁচা মেরে সচল করে তুলবে। – দু’সপ্তাহ পর দেখা গেল, মুরগীটার ঠোঁটে দাঁত উঠেছে। কিন্তু এ দাঁত কুমীরের মতো দাঁত নয়। মুরগীর ঠোঁটে দেখা দিয়েছে বাঁকানো fang, যে জিনিস ম্যাটরা ডাইনোসরের কঙ্কালে দেখেছেন।  
 
 
এবার পালা পালকের। Silkie নামে একজাতের চীনা মুরগি হয়। এদের বৈশিষ্ট্য হল, এদের সারা শরীর – এমনকী পা-ও – গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা পালকে ঢাকা থাকে। নরম ঝাঁকড়া পালকের জন্য তার চেহারাটা লাগে অনেকটা লোমশ ভুটিয়া কুকুরের মতো। ম্যাট আর জন ভাবলেন, জীনের গতিপথ ঘুরিয়ে এই মুরগীর পালককে আঁশে রূপান্তরিত করা যায় কিনা দেখবেন। আঁশ বলতে dry scales, যা সরীসৃপদের গায়ে থাকে, পাখিদের পায়েও থাকে। – আগের মতোই, এবারেও একই ফল হল। ডিমের মধ্যে বৃদ্ধির সময় প্রথমে পাখির ভ্রূণে আঁশের লক্ষণ দেখা দেয়, পরে তা থেকে পালক রূপ পায়। ম্যাটরা দেখলেন, সঠিক জীনকে সঠিক সময়ে চালু করে দিতে পারলে ভ্রূণের শরীরে আঁশ থেকে পালক হওয়ার প্রক্রিয়া আটকে দেওয়া সম্ভব। তাতে যে প্রাণীটা পাওয়া যাবে, তার পালক থাকবে না, থাকবে আঁশ।
 
ওদিকে ক্যানাডায় লারসন আবিষ্কার করে ফেলেছেন, পাখিদের ডানার হাড়ে ডাইনোসরের সামনের থাবার মতো গঠন এখনো টিকে আছে। রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং করে পাখির ডানাকে ডাইনোসরের পায়ে বদলে ফেলা থিওরিটিক্যালি সম্ভব।
 
 
বছর আটেক এগিয়ে আসা যাক। দু’হাজার পনেরো সাল। জুন মাসের শেষদিকে, ‘Evolution’ পত্রিকার ওয়েবসাইটে একটা অনলাইন প্রবন্ধ বেরোল। ন’জন বায়োলজিস্টের একটা টীম পাখির ঠোঁটের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। প্রাচীন পাখিদের ঠোঁট হত না, অনেকটা ভেলোসির‍্যাপটরদের মতো মুখের আদল হত। সেই snout-এর মতো আদল থেকে কীভাবে beak এল, সেই ইতিহাস জানার চেষ্টা চলছিল। ঠোঁট এমন একটা প্রত্যঙ্গ যা পাখিদের জন্য চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ, – এই বৈশিষ্ট্য ছাড়া এতরকম পরিবেশে ওরা এতটা সাফল্য পেত না। অথচ ঠোঁট জিনিসটা নিয়ে সেই অর্থে তেমন গবেষণা হয়নি। 
 
কথা হল, – ঠোঁট থাকার গুরুত্ব কোথায়, কীভাবে তা পাখিদের জীবনকে প্রভাবিত করে, কেন সেটা এত বড় একটা অভিযোজন হয়ে দেখা দিল – এসবের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমে ঠোঁট কীভাবে তৈরী হল তা জানা দরকার। এই বিজ্ঞানীরা পাখির সাথে টিকটিকি, কুমীর, কচ্ছপ – এরকম অন্যান্য প্রাণীর জীন তুলনা করে দেখলেন, ঠোঁটওয়ালাদের মধ্যে এমন কিছু জীন পাওয়া যাচ্ছে যা ঠোঁটছাড়াদের নেই। সেই জীনগুলোই পাখিদের মুখে ঠোঁটের জন্ম দিচ্ছে। এবারে মুরগীর ভ্রূণের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এই বিশেষ জীনগুলোর প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা হল। তাতে দেখা গেল, ঠোঁট সহ পুরো করোটির গঠনে একটা উল্লেখযোগ্য বদল আসছে। পাখির মাথা আর পাখির মাথা থাকছে না, প্রায় যেন পাখি আর কুমীরের মাথার মাঝামাঝি এক ‘মিসিং লিঙ্ক’ হয়ে উঠছে। গবেষকরা আর এই সরীসৃপ-পাখিদের জন্মাতে দিলেন না, ভ্রূণের বৃদ্ধি স্থগিত থাকল। জন্মালে হয়তো এক বিচিত্র ধড়ে-মুড়ো সন্ধি হয়ে দাঁড়াত, একটা প্রাণ অনর্থক কষ্ট পেত। – কিন্তু বট্‌মলাইনটা যা পাওয়া গেল, তা খুব পরিষ্কার।
 
 
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’
 
 
 অনেকদিন আগে একটা বইয়ে একটা কথা পড়েছিলাম। ধরা যাক একজন মানুষকে মঙ্গলগ্রহে একা ছেড়ে দেওয়া হল। কোনো সঙ্গী নেই, কথা বলার কেউ নেই, চতুর্দিকে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। এরকম অবস্থায় যদি সেই লোকটা হঠাৎ একটা মাছিও দেখতে পায়, তাহলেও সে মহা আনন্দে চীৎকার করে উঠবে। কেন? কারণ মাছিটা তার মতোই পৃথিবীর জীব। এই ভিনগ্রহে ওটাই তার নিকটতম আত্মীয়, তার ‘দেশের লোক’। পরিচিত গণ্ডীর মধ্যে বসে বসে আমরা এই অনুভূতির স্বাদ পাই না, কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টালে আমাদের জৈবিক ধর্ম স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবিনসন ক্রুসো সাদা চামড়ার বর্ণবিদ্বেষী ইংরেজ ছিল, তবুও সেই পাণ্ডববর্জিত দ্বীপে আদিবাসী ফ্রাইডেকেই সে তার সবচেয়ে বড় বন্ধু করে তুলেছিল। মিল-বেমিলের হিসেবটা আসলে সম্পূর্ণ আপেক্ষিক। 
 
এই যে বিশাল বৈচিত্রপূর্ণ প্রাণীজগৎ, তার মধ্যে এতরকম বিভিন্নতা, – তবুও এর মধ্যে অনেকটাই আসলে একরকম। আমাদের জেনেটিক গঠন মিলিয়ে দেখলে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। পাখির মধ্যেকার জীন থেকে সরীসৃপকে জাগিয়ে তোলা, হাতির জীন থেকে ম্যামথের জীনের অসম্পূর্ণতা দূর করা – এসব সম্ভব হয় এই মিল থাকার জন্যেই। তুলনা করলে দেখা যাবে, মানুষ আর মৌমাছির জীনের মধ্যে 44%-ই এক। মানুষ আর মুরগীর মধ্যে এই মিলটা বেড়ে হয় ৬৫%, মানুষ আর কুকুরের মধ্যে ৮৪%, আর শিম্পাঞ্জীর সাথে মেলালে দেখা যায় ওদের জীন আমাদের সাথে ৯০% মেলে। যেটুকু তফাৎ, সেটা আসে ওই সামান্য না মেলা অংশটুকুর কল্যাণে। 
 
‘জুরাসিক পার্ক’ উপন্যাসে জন হ্যামন্ড ডাইনোসর বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। কোটি কোটি টাকা ঢেলে ডাইনোসর ডি এন এ-র জন্য খোঁজ লাগিয়েছিলেন। শেষে সেই ডি এন এ পাওয়া গিয়েছিল অ্যাম্বার থেকে। অ্যাম্বার একধরনের ফসিল, প্রাগৈতিহাসিক গাছের গা থেকে গড়ানো রস জমে তাই থেকে ফসিল হয়ে অ্যাম্বার হয়। হ্যামন্ড এমন ধরনের অ্যাম্বার জোগাড় করেছিলেন, যার মধ্যে গাছের রসে আটকা-পড়া প্রাগৈতিহাসিক মশাদের মৃতদেহ সংরক্ষিত হয়ে আছে। সেই পচন-না-ধরা মশার পেট থেকে বার করা হয়েছিল ডাইনোসরের রক্ত, আর সেই রক্ত ছেনে উদ্ধার করা হয়েছিল তার ডি এন এ। কিন্তু যতই হোক, ৬৫ মিলিয়ন বছর নেহাত কম সময় নয়। পুরো ডি এন এ হ্যামন্ড পেলেন না, কয়েক জায়গায় ফাঁক থেকে গেল। সেই ফাঁক ভরাট করার জন্যে হ্যামন্ডের ভাড়াটে বিজ্ঞানীরা অন্য প্রাণীদের জীনোম থেকে মালমশলা নিলেন। পাখি, কুমীর আর ব্যাঙের ডি এন এ দিয়ে ফাঁক ভরাট করা হল, তাই থেকে বানানো হল ডাইনোসর। ভাগ্যিস পাখি-কুমীর-ব্যাঙদের সাথে ডাইনোসরদের মিল ছিল, তা নাহলে তো এ কাজ করাই যেত না। খুব ভালো কথা।
 
কিন্তু খোদার ওপর খোদকারি চলে না। জুরাসিক পার্কের গতি কী হয়েছিল তা সবাই জানি। যেটা সবাই জানে না, সেটা সিনেমায় ভালোভাবে বলা নেই। উপন্যাসটায় আছে। বানানো ডাইনোসররা যাতে সম্পূর্ণভাবে মালিকদের ওপর নির্ভরশীল হয় – তাদের আওতায় থাকে, তার জন্যে জুরাসিক পার্কের কর্মকর্তারা কিছু safety measures নিয়েছিলেন। পার্কের যত ডাইনোসর সবাই ছিল মেয়ে। এতে সুবিধা হল, ওরা নিজেরা বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না, বন্য পরিবেশে স্বাধীন জীবন খুঁজে নিতে পারবে না। একমাত্র হ্যামন্ডের এয়ারকন্ডিশনড ল্যাবেই নতুন ডাইনোসর বাচ্চা জন্ম নেবে। এরকমটাই ভাবা হয়েছিল। গোলমাল রয়ে গিয়েছিল অন্য জায়গায়। 
 
 
আফ্রিকায় একধরনের ব্যাঙ পাওয়া যায়, তার নাম common reed frog। এই ব্যাঙদের একটা চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য আছে। এরা প্রয়োজনমত লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে। কোনোরকম ছুরিকাঁচি বা কৃত্রিম হরমোনাল ট্রিটমেন্ট ছাড়াই। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যদি একদল কমন রীড ফ্রগের মধ্যে থেকে সব পুরুষ ব্যাঙ সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে কিছুক্ষণ বাদে বড় বড় কয়েকটা মেয়ে ব্যাঙ লিঙ্গ পাল্টে ছেলে হয়ে যায়। প্রকৃতিতেও যদি কখনো কোনো কারণে তাদের মধ্যে single sex environment দেখা দেয়, তাহলে তারা এইভাবেই তার সমাধান করে। 
 
জুরাসিক পার্কে ডাইনোসরদের জন্যে যে ব্যাঙের ডি এন এ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা ছিল এই কমন রীড ফ্রগ। ডাইনোসরদের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধি রোখা গেল না। অ্যালান গ্র্যান্ট জঙ্গলের মধ্যে ভেলোসির‍্যাপটরের ডিমের খোলা পেলেন। হ্যামন্ডের সাধের স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। 
 
বিজ্ঞানীরা যে ব্যাঙের লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারটা হিসেবে ধরতে ভুলেছিলেন, সেটা তাঁদের পক্ষে নিতান্তই কাঁচা কাজ হয়েছিল। প্রাণীদের মধ্যে এটা একেবারে বিরল নয়। ‘Finding Nemo’-খ্যাত ক্লাউনফিশদের মধ্যে এ জিনিস হামেশাই হচ্ছে। একদল ক্লাউনফিশের মধ্যে সবচেয়ে বড় জন হয় মেয়ে। আকারে তার পরেই যে, সে ছেলে। বাকিদের কারো জননাঙ্গ থাকে না, তারা ‘আন্ডার-এজ’ হয়ে দলে থাকে। স্ত্রী-পুরুষ জুটি বেঁধে ডিম পাড়ে। যদি স্ত্রী কোনো কারণে মারা যায়, তখন পুরুষ ক্লাউনফিশ নিজেকে বদলে ফেলে, ‘বাবা’ থেকে ‘মা’ হয়ে যায় (‘ফাইন্ডিং নিমো’-তে মা-মরা নিমোর বাবা মার্লিনের মাতৃস্নেহ স্মরণীয়), আর ওই মাইনর ক্লাউনফিশদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়, সে পুরুষ মাছের জায়গা নেয়। ক্লাউনফিশ ছাড়াও আরো অনেক মাছ, কয়েকজাতের তারামাছ, কিছু শামুক – এদের মধ্যেও লিঙ্গবদল দেখা যায়। কমন রীড ফ্রগ ছাড়াও অন্য কোনো কোনো উভচরদের মধ্যেও এটা আছে, যেমন আফ্রিকান বুলফ্রগ। 
 
উভচররা এক বিচিত্র শ্রেণীর জীব। এরা না জলের, না ডাঙার – দুইয়ে মিলে এদের জীবন কাটে। সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র এদেরই গায়ে কোনোরকম আত্মরক্ষার বর্ম থাকে না। বাকি সবার চামড়ায় কিছু না কিছু আবরণ আছে – মাছের আঁশ আছে, সরীসৃপেরও আঁশ আছে, পাখির পালক আছে, স্তন্যপায়ীর লোম আছে, – একমাত্র উভচরদের ত্বক অনাবৃত। ভেজা স্যাঁতসেঁতে গায়ের চামড়া, পিচ্ছিল মিউকাসে ঢাকা। এরকম ব্যবস্থার পেছনে কারণ আছে। বিবর্তনের ইতিহাসে উভচররা হল প্রথম মেরুদণ্ডী প্রাণী যারা জল থেকে ডাঙায় উঠে এসেছিল, মাছ থেকে চতুষ্পদ হয়েছিল। ডাঙায় উঠে এসে তাদের প্রথম সমস্যা ছিল dessication – ডাঙার অনার্দ্র পরিবেশে শরীর শুকিয়ে মৃত্যু। সিলুরিয়ানে যখন গাছেরা প্রথম ডাঙায় এসেছিল, তখন তাদেরও এই সমস্যা হয়েছিল। গাছেরা তার সমাধান করেছিল মোমের মতো কিউটিকল দিয়ে। মাছের শরীরেও আঁশ ছিল, কিন্তু তা দিয়ে ডেসিকেশন ভালো আটকায় না। এর সমাধান করতে উভচররা ত্বকে পিচ্ছিল মিউকাসের ব্যবস্থা করল। মিউকাসের আস্তরণ থাকার ফলে শরীরের জল শুকিয়ে ওঠার হার অনেকটা কমে। মেছো আঁশকে বিদায় দিয়ে শরীর নিরাবরণ হওয়ায় আরো একটা বড় সুবিধা হল। ডাঙার প্রাণীদের শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র হল ফুসফুস। উভচরদের ফুসফুস সরীসৃপ-পাখি-স্তন্যপায়ীদের মতো অতটা উন্নত নয়, তার অক্সিজেন টানার ক্ষমতা কম। এই চাহিদা পূরণ করল উভচরদের নগ্ন ত্বক। খোলা চামড়ার মাধ্যমে বাতাসের আদানপ্রদান চালিয়ে তারা অক্সিজেনের খামতি মেটাল। 
 
চামড়া ছাড়াও শরীরে আরো পরিবর্তন এলো। সমুদ্রের যারা থাকে, তাদের শরীর অনেক বড় হলেও তা বয়ে বেড়ানো তেমন কঠিন হয় না, কারণ জল নিজেই সেই ভার অনেকটা বহন করে। কিন্তু ডাঙায় এই সুবিধা নেই। বাতাসের প্লবতা এত কম যে তা হাড়মাংসের শরীরকে ভাসিয়ে রাখতে পারে না। এদিকে উভচরদের দেহে ফুসফুস দেখা দিয়েছে, তা যাতে বাকি শরীরের ভরে চুপসে না যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা ডাঙায় হেঁটে চলে বেড়াতে হবে, তার জন্যে পা চাই। একটা ঢালাও কাঠামোগত বদল দরকার। ধাপে ধাপে সেই বদল এল। শুরুটা হয়েছিল মাছ থেকেই।
 
 
সিলুরিয়ান পর্যায়ের শেষ, ডেভোনিয়ান আসন্ন। প্রথম চোয়ালওয়ালা মাছের দল – শক্ত হাড়ের বর্মে মাথা ঢাকা শিকারী প্ল্যাকোডার্মরা তখন সমুদ্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এইরকম সময়ে নতুন একধরনের মাছ দেখা দিল। অন্যদের চেয়ে এদের পাখনার ধরন আলাদা। এমনিতে মাছের পাখনা তাদের মূল শরীরের সাথে লাগানো থাকে; পাখনায় কোনো মাংস থাকে না, হাড়ও থাকে না। কিন্তু এই নতুন মাছদের একরকম ‘হাত-পাখনা’ দেখা দিল। যেন শরীর থেকে ছোটো ছোটো হাত-পা বের হতে হতে শেষে পাখনা হয়ে গেছে। এই পাখনায় মাংসল অংশ থাকল, হাতের মতো হাড়ও থাকল। এদের আমরা বলি lobe-finned fish। এদের থেকে আবার দুটো শাখা বেরোল। একদিকে গেল শিলাকান্থ মাছের দল। এই শিলাকান্থ বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত মাছ, সেই কথায় পরে আসছি। দু’নম্বর যে শাখা ‘হাত-পাখনা’ মাছদের থেকে বেরোল, তারা সমুদ্রে আর রইল না, ডাঙার নদী নালা জলা-জায়গায় ঠাঁই নিল। এদের মধ্যে থেকে উঠে এল মিঠা জলের লাংফিশ সম্প্রদায়, আর চতুষ্পদ প্রাণীদের প্রথম পূর্বপুরুষ। 
 
 
২০০৪ সালে কানাডায় একদল গবেষক এক অদ্ভুত জানোয়ারের ফসিল পেলেন। মাছের মতো প্রাণী, পাখনা আছে, ফুলকা আছে, গায়ে আঁশও পাওয়া গেল। কিন্তু তবুও একে ঠিক মাছ বলা গেল না। জানোয়ারটার মাথা মাছের মতো দু’পাশ থেকে চাপা নয়, বরং কুমীরের মতো ওপরে-নীচে চ্যাপ্টা, তার উপরে দুই চোখ বসানো। বুকের পাশে পাঁজরের হাড় মিলল, ডাঙায় শরীরের ভার নেবার মতো উপযুক্ত পাঁজরের হাড় – যা জলচর মাছের থাকে না, থাকার দরকার হয় না। মাছের শরীরে ঘাড় বলেও কিছু থাকে না, মাথা সরাসরি বুকের সাথে লাগানো। এই জানোয়ারের শরীরে ঘাড় পাওয়া গেল, কাঁধের সাথে তা জোড়া লাগানো নয়। তার মানে এ স্বাধীনভাবে এদিকে-ওদিকে মাথা ঘোরাতে পারত। মাছ তা পারে না। মাত্র কয়েকটা হাড়ের পার্থক্যে এই জীব বিবর্তনের পরের সোপানে পা রেখেছে। সত্যিই ‘পা’। কারণ এই নতুন মাছের পাখনার ভিতর হাড় পাওয়া গেল। পায়ের হাড়। এমনকী হাতও বলা চলে। গবেষকরা স্পষ্ট দেখলেন, – কাঁধ, কনুই, কব্জি সমেত আস্ত হাত তৈরী হয়েছে এর পাখনার মধ্যে। তাহলে না-মাছ না-চতুষ্পদ এই নয়া জীবকে কী বলে ডাকা যায়? জীবাশ্মবিদ নীইল শুবিন একটা মাঝামাঝি রফা করে বললেন: মাছ-পদী!
 
 
এই ‘মাছপদী’ জীবের নাম রাখা হয় Tiktaalik, – সে আমাদের স্থলচরদের সবারই ‘অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ’, বস্তুত তার চেয়েও অনেক বেশী। ঘাড়-ওয়ালা শরীরের এই নকশা পরবর্তী সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে রক্ষিত হয়েছে, – ব্যাঙ, সাপ, ডাইনোসর, ময়ূর, হরিণ, মানুষ – সবাই এই একসুতোয় বাঁধা। ৩৭৫ মিলিয়ন বছর আগেকার প্রথম স্থলচর টিকটালিক, – ছোটো ছোটো পাখনা-পায়ে ভর দিয়ে সে জল থেকে ডাঙায় উঠে আসত, খানিকটা যেন সীলমাছের মতো হামাগুড়ি দিয়ে, সামনের পাখনার জোর লাগিয়ে মাটির ওপর শরীর টেনে টেনে চলতে পারত। এর থেকেই উভচরদের উৎপত্তি।  ডাঙার জীবনের জন্য প্রাথমিক অভিযোজন হিসেবে ঘাড় এর মধ্যেই দেখা গিয়েছিল, এর পরে Acanthostega আর Ichthyostega-দের মধ্যে দেখা গেল শরীরের ভর বইবার জন্যে মজবুত বুকের খাঁচা, শক্তপোক্ত শিরদাঁড়া, আর হেঁটে বেড়ানোর মতো সক্ষম হাত-পা। এরা এতদিনে মোটামুটি ‘উভচর’-পদবাচ্য হয়েছে। এটা ডেভোনিয়ান পর্যায়।
 
ডেভোনিয়ান পৃথিবীতে স্থলভাগ তখন গাছে গাছে ঢাকা, বাতাসে ভরপুর অক্সিজেন, পোকামাকড়ের দল জলাজঙ্গল ছেয়ে ফেলেছে, ডাঙায় তখনো মেরুদণ্ডীদের দেখা নেই। কীটপতঙ্গ মানেই প্রচুর পুষ্টিকর খাবার, আর জল ছেড়ে এলে অন্য কোনো শিকারী জানোয়ারের ভয়ও নেই – তাই অ্যাকান্থোস্টেগারা মাঝে মাঝেই ভূরিভোজনের লোভে ডাঙায় উঠে আসত। অপোনেন্ট-বিহীন মাঠে টেনিদা এক এক করে বত্রিশ গোল দিয়েছিল, অবস্থা হল ঠিক তাই। কাজেই যতদিনে ডেভোনিয়ান পেরিয়ে কার্বনিফেরাস পড়ল, ততদিনে দেখা গেল উভচরের দল ডাঙায় ভালোভাবে আসন পাকা করে নিয়েছে।
 
 
কার্বনিফেরাস পর্যায় থেকে পার্মিয়ান পর্যায় – এই সময়টাকে বলা হয় Age of Amphibians। জল-ডাঙা মিলিয়ে যাদের জীবন, তাদের জন্যে আদর্শ প্রতিবেশ কার্বিফেরাস অরণ্যে তৈরী হয়েছিল। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, উষ্ণ তাপমান আর অক্সিজেনের আধিক্যের ফলে পোকামাকড়ের বাড়বাড়ন্ত, অন্য কোনোরকম শিকারী প্রাণীর অনুপস্থিতি – উভচরদের আর কী চাই? অনুকূল পরিবেশ পেয়ে তাদের মধ্যেও এবার নানারকম শাখাপ্রশাখা দেখা দিল। একদল আকারে ছোটোখাটো, পিচ্ছিল ত্বক, জলের আশেপাশেই তাদের বেশীরভাগ সময় কাটে। এদের মধ্যে Diplocaulus বলে একজন ছিল, তার মাথার আকৃতি ঠিক বুমেরাং-এর মতো! খুব সম্ভব জলের তলায় দিক ঠিক করতে এতে তার সুবিধা হত। আর এক দল উভচর আকারে বড়সড় – লম্বা শরীর, বেঁটেখাটো মজবুত পা, বড় মাথা, অনেকের গায়ে একরকম আঁশও থাকত। শরীরের তলার দিকে বুক আর পেট ঢাকা থাকত আড়াআড়ি-টানা চওড়া প্লেটের মতো আঁশে – যেমন সাপদের থাকে। কিন্তু এই বর্ণনা শুনে তো উভচরের কথা মনে হয় না, এ চেহারা গিরগিটি-কুমীরদের মার্কামারা reptilian চেহারা। ডাইনোসররা কি তাহলে এই শ্রেণীর উভচরদের বংশধর? উত্তর পেলাম – না, তা নয়।
 
 
 সরীসৃপরা প্রথম যখন উভচরদের থেকে নিজেদের আলাদা করে নিতে শুরু করল, সেটা কার্বনিফেরাসের শেষ দিক। সবচেয়ে বড় যে উন্নতি তারা করল, তা হল ডাঙায় পাড়বার মতো খোলা-ওয়ালা ডিম। উভচরদের নিয়ম হল, জীবন যেখানেই কাটাক না কেন – ডিম তাদের পাড়তে হবে জলেই। তা না হলে পাড়ার সাথে সাথে ডিম শুকিয়ে যাবে; নরম খোলাওয়ালা ডিম ডাঙার শুকনো পরিবেশে বাঁচে না। উভচরের জীবন যে জলের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে বাঁধা, এটাই তার সবচেয়ে বড় কারণ। প্রথম সরীসৃপরা এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠল। সরীসৃপদের ডিমের খোলা জলনিরোধক হয়, তা নিরাপদে ডাঙায় পাড়া যায়। পাখির ডিমও তাই। তফাতের মধ্যে পাখির ডিমের আবরণ শক্ত হয়, আর সরীসৃপের ডিমের আবরণ রবারের মতো নমনীয়। ব্যতিক্রম আছে, সে আমাদের অনেকেরই নিজের চোখে দেখা। ছোটবেলায় উঁচু বইয়ের তাকে মাঝেমাঝে দু-তিনটে টিকটিকির ডিম খুঁজে পেতাম। মটরদানার মতো ছোট্ট ধবধবে সাদা ডিম, ভারী সুন্দর দেখতে। কোনো কোনো ডিম আস্ত পেতাম, অনেকগুলো পেতাম ভাঙা। বাচ্চা টিকটিকি ডিম ফুটে বেরিয়ে শিকার খুঁজতে চলে গেছে। পড়ার টেবিলে কখনো কখনো সেই ইঞ্চিখানেক লম্বা খুদে টিকটিকিদের দেখা পাওয়া যেত, সিলিং থেকে খসে পড়ে আবার তাড়াতাড়ি দৌড়ে পালাত।
 
 
সবে জাতে-ওঠা সরীসৃপরা তো সেই যুগে তেমন কেউকেটা ছিল না। বড় বড় অ্যাম্ফিবিয়ানদেরই রাজত্ব তখন, যদিও কার্বনিফেরাস রেইনফরেস্ট কোলাপ্সে তারা একটা বড় ধাক্কা খেল। কিন্তু তাও, পার্মিয়ানেও শিকারী উভচর আর সরীসৃপদের দাপট পাশাপাশি চলেছিল। Prionosuchus বলে একরকম প্রাণী হত, জাতে সে উভচর হলেও চেহারায় অবিকল কুমীরের মতো ছিল। মাপে তিরিশ ফুট লম্বা হত, ওজন হত প্রায় দুই টন। এ হেন উপস্থিতির পাশে ওদিকে ছিল পেলিকোসর জাতের সরীসৃপরা। Dimetrodon নামে একরকম পেলিকোসর হত, তাদের পিঠের ওপর বড় পালের মতো পাখনা ছিল। এরাও কম বড় হত না, প্রায় পনেরো ফুট লম্বা আর আড়াইশো কেজি ওজন হত। 
 
 পার্মিয়ানের মাঝামাঝি এসে বিশেষ একদল সরীসৃপ উভচরদেরকে বেশ খানিকটা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল, সুযোগ পেলে হয়তো এদের হাত ধরেই পৃথিবীতে সরীসৃপদের রাজত্ব কায়েম হত। এদের পোশাকি নাম Therapsid, জাতে পেলিকোসরেরই উত্তরপুরুষ। থেরাপসিডদের শরীরে এখন একটা লক্ষণ দেখা গেল, যা পেলিকোসরদের ছিল না। পেলিকোসরদের পা ছিল কুমীরের মতো – শরীরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে কনুইয়ের কাছে ভেঙে মাটির দিকে নেমেছে। থেরাপসিডদের পা বেরোল সরাসরি শরীরের তলা থেকে, সোজা নেমে মাটি ছুঁল। এই ছোটো পার্থক্যটার দাম অনেক, থেরাপসিডদের এই পায়ের গঠন পরবর্তী আড়াইশো মিলিয়ন বছর পরেও সফলভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকবে; কারণ, ছড়িয়ে থাকা চার পা নিয়ে কুমীরের মতো প্রাণীরা ডাঙায় হাঁটতে পারলেও দৌড়তে পারে না। কিন্তু থেরাপসিডের এই নতুন ধরনের পা নিয়ে দৌড়োনো যায়। 
 
 
 
ট্রায়াসিকের শেষে এসে থেরাপসিডদের থেকেই জন্ম নিয়েছিল প্রথম স্তন্যপায়ী। 
 
 
 
পার্মিয়ানের অন্তিমপর্ব সমাসন্ন, কিন্তু মেসোজয়িকের সিংহদুয়ার পেরোবার আগে অন্তত একটা প্রাথমিক পরিচয়পর্ব সেরে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথম ‘উন্নত উভচর’ থেকে শুরু করে আজকের টিকটিকি পর্যন্ত যত সরীসৃপ, তাদের সবাইকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগটা করা হয় তাদের মাথার খুলির ভিত্তিতে।
 
 
 
(চলবে)
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *